Homeসাহিত্যসুবর্ণরেখার কথা-২ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখার কথা-২ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখার কথা-২
উপেন পাত্র
(‘সুবর্ণরেখার কথা’র আজ দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব যাঁরা পড়েননি তাঁদের জন্য জানাই, আধুনা ঝাড়খণ্ডে উৎপত্তি হয়ে ওড়িশার মোহনা মুখে পতিত এই সুবর্ণরেখা নদীর বিস্তার ও মধ্যভাগ দক্ষিন-পশ্চিম বাংলায়। প্রথম পর্বে লেখক নদীটির সেই ভূগোলকে তুলে ধরেছেন। এরপর শুরু এই নদীর বাঁকে বাঁকে ও চরে চরে বিস্তৃত কথা ও উপকথা সমূহ। নদী বিধৌত বঙ্গভূমির মানুষ মাত্রই জানেন নদীর কোলে কালের পরিসরে যে পলি লালিত মৃত্তিকাভূমি জেগে ওঠে তাকে চর বলে, স্থান বিশেষে তা পাল নামেও অভিহিত। এক বৈশাখ মাসে জেগে ওঠা এরকমই এক চরের নাম বৈশাখী পাল। সেই পালের দখল নিয়ে লড়াই, আজকের পর্বে। লেখক উপেন পাত্র নিজস্ব মুন্সিয়ানায় স্থানীয় উপাদানে এই কথার পরত সাজিয়েছেন। তিনি যেভাবে লিখেছেন সেভাবেই এই কথা পরিবেশন করা হল। সে মুন্সিয়ানায় কলমপাত করার দুঃসাহস আমরা দেখাইনি। প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক।)

বৈশাখী পালের যুদ্ধ                                                                ১৯৪৩ সালের বৈশাখ মাসে এক প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড়ের সাথে মুষল ধারে বর্ষণ চলে,যার ফলে সুবর্ণরেখা নদীতে প্রবল বন্যা আসে।ঐ বন্যায় সুবর্ণরেখা নদীতে কাঠুয়াপাল গ্রামের আছে এক বিশাল চর বা পাল জেগে ওঠে,যা বৈশাখী পাল নামে খ্যাত।এই বৈশাখী পালের দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়।যুদ্ধে শতাধিক লোক হতাহত হয়।
আমি যখন স্কুল ছাত্র,তখন কিছু লোক খঞ্জনি বাজিয়ে বৈশাখী পালের গান গেয়ে ভিক্ষা করতো–
“বিধি যাহা লেখিথিলা কপালে,
বৈশাখীর পালে গো বৈশাখীর পালে।”
পরে আমাদের গ্রামের কুবের খাঁড়ার,গাঁয়ের লোকে তাঁকে সরকারজী বলতো, কাছ থেকে বৈশাখী পালের যুদ্ধের কথা জানতে পারি।
কাঠুয়াপাল গ্রামের সন্তোষ দাস পাঁচালি আকারে
“বৈশাখী পালের গান” লিখেন।লেখক নলিনী বেরা মহাশয় তাঁর “সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা” বইতে বৈশাখী পালের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন।
একালের ছেলেমেয়েরা ঐ পুরাতন কথা জানে না।তাই তাদের অবগতির জন্য এটা লেখা–
সুবর্ণরেখার বুকে গড়ে ওঠা বিশাল চরটি পলি মাটি দিয়ে গড়া,তাই খুব উর্বর ছিল।স্থানীয় ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীরা ঐ বৈশাখী পালে আবাদ শুরু করে।গ্রাম্য প্রবাদ আছে– “হাতি বনে বাঢ়নে কার? না, রাজার।” আর “জমি বাপের না দাপের।” এক্ষেত্রেও তাই হলো।

রোহিণীর জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ ষড়ঙী বৈশাখী পাল তাঁর জমিদারির মধ্যে পড়ে,এই দাবিতে পাইক লাঠিয়াল পাঠিয়ে জমি জরিপ করান।সব চাষ আবাদ তছনছ করা হয়।জরিপ থেকে জানা যায় বৈশাখী পালের মোট জমির পরিমান ১২৫ বিঘা।
রোহিণী থেকে বৈশাখী পাল অনেকটাই দুরে,তাই জমিদার ঐ জমি বিক্রি করতে মনস্থ করেন।একথা শুনে কাঠুয়াপাল গ্রামের কয়েকজন সম্পন্ন চাষী ঐ জমি কিনতে চান।কিন্তু তাদের সাধ্যে কুলোবে না ভেবে তারা রোহিণী স্কুলের প্রধান শিক্ষক রগড়া গ্রামনিবাসী উমেশ চন্দ্র দে মহাশয়ের কাছে যান, উমেশবাবু রাজি হন।
উমেশবাবু কয়েকজনকে সাথে নিয়ে রোহিণীর জমিদার কাছারিতে যান।দরাদরি করে চৌদ্দ হাজার টাকা জমির দাম নির্দিষ্ট হয়।(সেকালের পক্ষে এটা কম টাকা নয়)।জমির বায়নানামা লিখিত হয়।ক্রেতা চাষীরা বৈশাখী পালের জমিতে চীনাবাদাম চাষ করেন।
কিন্তু জমি রেজিষ্ট্রী হওয়ার পূর্বেই জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ ষড়ঙী মারা যান।জমিদার অপুত্রক ছিলেন।তাঁর কন্যা শৈলবালার বিবাহ হয় বনডাহি গ্রামের নগেন্দ্রনাথ মহাপাত্রের সাথে।কন্যা জামাতা শ্রাদ্ধকার্যে রোহিণী আসেন।শ্রাদ্ধকার্যে গিয়ে নগেনবাবু জমিদারবাড়ির বিপুল পরিমান অর্থ বনডাহির নিজ বাড়িতে গোপনে পাচার করে দেন।
শ্রাদ্ধশান্তির পরে নগেনবাবু বাড়ি ফিরে দেখেন ঐ অর্থ চুরি হয়ে গেছে।এই শোকে তিনি পাগল হয়ে যান।অতঃপর জমিদারকন্যা শৈলবালা জমিদারীর সত্ত্বাধিকারী ঘোষিত হন।বনডাহির পাট চুকিয়ে কন্যা জামাতা রোহিণী আসেন।
শৈলবালা বুদ্ধিমতী ছিলেন।স্বামী পাগল,একা জমিদারি সামলানো বেশ কঠিন কাজ।এই ভেবে তিনি শ্রীকান্ত আচার্য নামে এক অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে জমিদারির ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।

ম্যানেজারের কূটবুদ্ধিতে উমেশবাবুদের প্রদত্ত বায়নানামা গায়েব হয়ে তার স্থলে শৈলবালার নামে বৈশাখীপাল জমির নকল দানপত্র তৈরী হয়ে যায় এবং বৈশাখী পালের জমিকে পুনরায় বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এই কথা জানতে পেরে বহড়াদাঁড়ি গ্রামের গয়াপ্রসাদ দত্ত মহাশয় বৈশাখী পাল কিনতে আগ্রহী হন।কিন্তু তিনি এত জমি সামাল দিতে পারবেন না ভেবে রগড়া গ্রামের কয়েকজন সম্পন্ন চাষীকে সাথী করেন।রোহিনী জমিদারের কাছারিতে গিয়ে এই চাষীরা জমি কেনার জন্য দরদাম করেন।জমির দাম ষোল হাজার টাকা নির্দিষ্ট হয়।কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে বায়নানামা লিখিত হয়।
জমিদারীর এই তঞ্চকতার কারণে পূর্বের ক্রেতা ও পরের ক্রেতার মধ্যে বিবাদ বাধে,শেষে যুদ্ধ বাধে। এর ফলে শতাধিক লোক হতাহত হয়।গয়াপ্রসাদ বাবুর দল বৈশাখী পালের জমিতে বিশ হাল নামিয়ে জমিতে লাঙ্গল চালিয়ে চীনাবাদাম চাষ তছনছ করে সরিষা বুনে দেয়।
উমেশ বাবুদের দল মাঠে নেমে প্রতিবাদ না করে তারা ভাড়াটে সেনা সংগ্রহ করে।বর্তমান বেলিয়াবেড়া থানা এলাকার তারাডিহা ও মাটিহানা ছাড়াও বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাঠিয়াল ও তীরন্দাজ সংগ্রহ করা হয়।এ কথা জানতে পেরে গয়াপ্রসাদ বাবুর দল নেগুড়িয়া গ্রামের গোলাপ খাঁর কাছে যায়।মোটা টাকার বিনিময়ে তারা যুদ্ধে যোগ দিতে স্বীকৃত হয়।
ঐ বছর দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে উমেশ বাবুদের দল যুদ্ধে নামে এবং মাঠে লাঙ্গল চালিয়ে সরিষা চাষ তছনছ করে দেয়।গয়াপ্রসাদ বাবুর দল কিছুটা দেরিতে পৌঁছে কুলকুলি দিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে।কিন্তু বিপক্ষের তীরবর্ষণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে পিছু হটে আসে।উমেশ বাবুদের সেনারা মদ মাংস খেয়ে মাঠে বিজয় উৎসব পালন করে।
গয়াপ্রসাদ বাবুর দল পালিয়ে না গিয়ে বৈশাখী পালের এক পাশে শিবির গাড়ে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।অন্য পাশে বিপক্ষ সেনারাও সেনা ব্যুহ রচনা করে।দুই পক্ষের যুদ্ধের প্রস্তুতিতে পরদিন অষ্টমীতে যুদ্ধ বন্ধ থাকে।
পরের নবমী দিন সকালে উভয় পক্ষ কুলকুলি দিয়ে মাঠে নেমে পড়ে।এদিন গয়াপ্রসাদ বাবুদের সেনারা এক নতুন যুদ্ধকৌশল নেয়।একটা বিশাল ত্রিপল সামনে ধরে তারা ধীরে ধীরে বিপক্ষ সেনার দিকে এগিয়ে যায়।বিপক্ষের ছোঁড়া তীর ত্রিপলে গেঁথে যায়,গায়ে লাগে না।কাছাকাছি গিয়ে গোলাপ খাঁর সেনারা ত্রিপল ফেলে দিয়ে বিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু হয়। গোলাপ খাঁর দলের তলোয়ার ও বিপক্ষ দলের টাঙির কোপে উভয় পক্ষের বহু লোক হত ও আহত হয়।

অতঃপর দুই দলই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।দুরে দাঁড়িয়ে যারা যুদ্ধ দেখছিল তারাও দৌড়ে পালাতে শুরু করে।ছিন্নভিন্ন কত লাশ বৈশাখী পালের মাটিকে রক্তে সিক্ত করে।সারা এলাকায় শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে আসে।
যুদ্ধের পর সাঁকরাইল ও গোপীবল্লভপুর থানার পুলিশ বাহিনী আসরে নামে।লাশগুলি চালান দেওয়া হয়।পুলিশী টহল চলে।ইতিমধ্যে গয়াপ্রসাদ বাবুর দল উমেশবাবু সহ একুশ জনের বিরুদ্ধে ঝাড়গ্রাম কোর্টে ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। ধরপাকড় শুরু হয়।
মোকদ্দমার জন্য গয়াপ্রসাদ বাবুর দল নামীদামী উকিল নিয়োগ করে।কিন্তু উমেশবাবু তাঁর দলের পক্ষে নিজেই সওয়াল করেন।একনাগাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চোস্ত ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন।সাহেব জজও অবাক হন।
ঐ মামলায় উমেশবাবুদের পক্ষে রায় হয়।বিপক্ষ দল মেদিনীপুর জজকোর্টে আপিল করে।সেই মামলাতেও উমেশ বাবুদের পক্ষে রায় হয়।এরপর মামলা হাইকোর্টে গড়ায়।দীর্ঘ মামলা মোকদ্দমায় উভয় পক্ষ জেরবার।ওদিকে বৈশাখী পালের জমি অনাবাদী পড়ে থাকায় স্থানীয় ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীরা কিছু এলাকা দখল করে চাষ আবাদ শুরু করেছে।

এই অবস্থায় তৎকালীন ইউনিয়ন বোর্ড় এর প্রেসিডেন্ট বিশিষ্ট সমাজসেবী অবধুত হাটুই মহাশয় উভয় পক্ষকে এক সালিশী সভায় আহ্বান জানান।ঐ সভায় উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে অবধুতবাবু কিছু পরামর্শ দেন।যুদ্ধে হতাহত পরিবারগুলিকে যথাযথ জমি দিয়ে এবং বর্তমান দখলী চাষীদের কিছু জমি দিয়ে অবশিষ্ট জমি উভয় পক্ষকে সমানভাবে ভাগ করে নিতে পরামর্শ দেন।উভয় পক্ষ এই পরামর্শ স্বীকার করে নেওয়ায় দীর্ঘকাল ধরে চলা বৈশাখী পালের জমি বিবাদের পূর্ন সমাপ্তি ঘটে।                                                                               প্রচ্ছদ: রামকৃষ্ণ দাস

 

RELATED ARTICLES

Most Popular