Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ২১ ॥ চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২১ ॥ চিন্ময় দাশ

                

   জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২১

                                        চিন্ময় দাশ 

          নব-রত্ন মন্দির, পাথরা        
 (মেদিনীপুর কোতোয়ালী )

বাংলার বড়লাট কর্নওয়ালিশ যখন ‘ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ‘ প্রচলন করেন, তখন ২৯টি প্রাচীন জমিদারবংশ ছিল মেদিনীপুর জেলায়। ইতিহাসে আছে, সেসময় এই জেলাতে অনেকগুলি তালুকদারবংশও ছিল। তেমনই একটি তালুকদারবংশের জমিদারি ছিল পাথরা গ্রামে।
মেদিনীপুর জেলা শহর ছাড়িয়ে কংসাবতীর সামান্য নিম্নস্রোতে পাথরা গ্রাম।

মজুমদার পদবীর জমিদার পরিবারের বসবাস ছিল সেখানে। অবশ্য পরে দৌহিত্রসূত্রে ভট্টাচার্য্য আর চট্টোপাধ্যায় পরিবারও এসে জমিদারির শরিক হয়েছিলেন। জানা যায়, তিন বংশের হাতে এক সময়ে একশ’রও বেশি মন্দির গড়ে উঠেছিল পাথরা ও তার আশেপাশে। প্রায় ৪০টি মন্দির এখনও আছে এখানে।

পাথরার সব মন্দিরের সেরা হল– নব-রত্ন মন্দিরটি। হ্যাঁ, এই নামেই পরিচিত হয়েছে মন্দিরটি। তবে, এটি আদতে তৈরী হয়েছিল নব-গ্রহ মন্দির হিসাবে।

“সূর্য্যশ্চন্দ্রো মঙ্গলশ্চ বুধশ্চাপি বৃহস্পতি। শুক্র: শনিশ্চয়ো রাহু: কেতুশ্চেতি নবগ্রহা: ।।”  মাঝখানে সূর্যদেবের বড় আকারের মূল মন্দিরটি। তার দক্ষিণে চারটি আর উত্তরে চারটি– ন’টি গ্রহের জন্য মোট ন’টি মন্দিরের নৈবেদ্য সাজিয়েছিলেন জমিদার।
পাথরার একশ’ সৌধের মন্দিরমালায় এই যে মন্দির, যেটি স্থাপত্যগুণে আর আভিজাত্যে সকলের সেরা, দেবতার বিগ্রহ ধারণ করবার সৌভাগ্য জোটেনি তারই  কপালে। শতাধিক মন্দিরের আর সবগুলিতে দেবতার বিগ্রহ স্থাপিত ছিল, সেবা-পূজা চলতো রাজকীয় সমারোহে। কিন্তু যে মন্দিরটি সকলের সেরা, সকলকে ছাড়িয়ে যার মাথা আকাশ ছোঁয়া, ন’-ন’টি রত্ন (চূড়া) যে মন্দিরের, সৌন্দর্যে সুষমায় মোড়া যে সৌধের গর্ভগৃহ সবচেয়ে প্রশস্ত, সেখানেই

কোনদিন আসন পাতা হয়নি কোন দেবতার।
দেবদর্শনের আকাঙ্খা নিয়ে কোন দিন কোনও ভক্ত আসেনি এখানে। কাঁসর-ঘন্টা বাজেনি কোনদিনই। কেবল আড়াই শ’-তিন শ’ বছর ধরে কংসাবতীর বুক ছুঁয়ে বয়ে আসা দক্ষিণের বাতাস এসে হাহাকার করে আর মাথা কুটে মরে গর্ভগৃহের শূন্য বেদীতে।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কেন এমনটা হল, তা নিয়ে এক লোকশ্রুতি শোনা যায়। জমিদারবাবু যে সময় মন্দির গড়ায় ব্যস্ত, তাঁর গর্ভধারিনী মা গুরুতর পীড়িত হয়ে পড়েন। কিন্তু জমিদার মেতে ছিলেন মন্দির নিয়ে। মায়ের সেবার ভার তুলে দিয়েছিলেন নায়েব-গোমস্তাদের হাতে ।

ফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতে। নির্মাণ কাজ মিটেছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার সব আয়োজন সারা হয়েছে তখন। পরদিন প্রভাতে শুভকাজ– নির্ঘন্ট জানিয়ে গেছেন পন্ডিতমশাই। হঠাৎই সূর্যদেব পাটে না বসতেই, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সারা রাত জুড়ে ভয়ানক দুর্যোগ।
দিনের আলো ফুটলে, জমিদারবাবু দৌড়ে এলেন। ততক্ষণে তুমল বর্ষণে সব আয়োজন ধুয়ে মুছে সাফ। মেরাপের চিহ্নটুকুও নাই। আর, মন্দিরের গায়ে আঁকা হয়ে আছে বজ্রপাতের চিহ্ন।
পুরোহিতের নিদানে, অপবিত্র মন্দিরে দেবতার আসন পাতা হয়নি সেই থেকে। সেই থেকে মন্দির শূন্যগর্ভা।

মূল মন্দিরের উত্তরে দক্ষিণে চারটি করে মন্দির ছিল। দক্ষিণের চারটি কংসাবতীর স্রোতে কবেই ভেসে গিয়েছে। তবে, উত্তরের মন্দির চারটি টিকে আছে। মোটামুটি ১০ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বর্গাকার দালান-মন্দির। সবগুলিই দক্ষিণমুখী। প্রতিটিতেই পশ্চিমে একটি করে অতিরিক্ত দ্বারপথ।পৃথিবীমণ্ডল থেকে দেখা যায়, পূবে উদয় হয়ে, পশ্চিমে চলেছেন সূর্য্যদেব।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
তাই মূল মন্দিরটি গড়া হয়েছিল পশ্চিমমুখী করে। ইটের তৈরী নব-রত্ন রীতির।এখনও দু’ ফুটের বেশি উঁচু পাদপীঠ। তার উপরে চারদিক জুড়ে প্রদক্ষিণ-পথ। নীচে সামনে একটি অলিন্দ, তাতে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। দ্বিতলে একটি সংকীর্ণ অলিন্দ গর্ভগৃহকে চারপাশ জুড়ে বেষ্টন করে আছে। তার সামনের অংশে তিনটি দ্বারপথ। মাথার রত্নগুলি কলিঙ্গশৈলীতে রথবিন্যাস করা। কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চ-রথ, বাকিগুলিতে ত্রি-রথ বিন্যাস।

মন্দিরটি বেশ অলংকৃত। ইমারতি-রীতির থামগুলি টেরাকোটা ফলকে সাজানো। টেরাকোটায় সাজানো হয়েছিল সামনের পুরো দেওয়ালটিই। পাদপীঠ থেকে কার্নিশের তলা পর্যন্ত। পঙ্খের কাজও আছে মন্দিরে।
দীর্ঘদিন অনাদরে অবহেলায় ভারী করুণ দশা হয়েছিল সৌধটির। পাথরার অন্য মন্দিরগুলির সাথে এটাকেও বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এক ভিন্ন ধর্মের সাহসী উদ্যমী যুবক– মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান। তাঁর ২৫ বছরের লড়াই মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে মন্দিরটিকে। পুরাতত্ব দপ্তর অধিগ্রহণ করে সংস্কার কাজ করিয়েছে এখানে। পুনর্জীবন প্রতিষ্ঠা হয়েছে মন্দিরের।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
এখন নিত্য আনাগোনা লেগে আছে পর্যটকদের। প্রতিবেদন ছাপা হয় নামি-দামি পত্র-পত্রিকায়। জাঁকজমক করে আসর বসে নানা অনুষ্ঠানের। হরেক যাত্রীর মেলা।
নিত্যদিন সূর্য্যদেব তাঁর পরিক্রমার পথে চলে যান মন্দিরটির মাথা ছুঁয়ে। একদিন তো তাঁরই জন্য আসন পাতা হয়েছিল এখানে। অভিশপ্ত সৌধটি কোনও দিন মুহূর্তের জন্যও কি আনমনা করে না তাঁকে?


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে মাত্রই ৮/১০ কিমি পূর্বে পাথরা গ্রাম। কংসাবতী নদীর উত্তর তীর বরাবর। নিয়মিত সবরকম ছোট গাড়ি যাতায়াত করে এই পথে। চার চাকার গাড়ি ভাড়া করেও পাথরা ঘুরে আসা যায়। এক লপ্তে ৩০/৪০টি মন্দির দর্শন হয়ে যায় পাথরা পরিক্রমায়। প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস

RELATED ARTICLES

Most Popular