Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ২০ ॥ চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২০ ॥ চিন্ময় দাশ

             

        জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ২০

                                           চিন্ময় দাশ 

গোপীনাথ মন্দির, রাধাকান্তপুর (দাসপুর)
আজ এমন এক মন্দিরের কথা, যার দেওয়ালে সবিস্তারে লেখা আছে এক রাজার নৃশংসতার কাহিনী। দেবালয়ের দেওয়ালে কত রকমের লিপিই না দেখা যায়। কিন্তু রাজা তাঁর নিজেরই দরবারের এক কর্মীর মুনডু কেটে নিয়েছেন, সেই ইতিহাস দেবালয়ের দেওয়ালে লিখে রাখা হয়েছে, এমনটা কোথাও দেখা যায় না। সারা বাংলায় অন্তত এমন উদাহরণ আছে বলে জানা নাই আমাদের।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
মেদিনীপুর জেলার পূর্ব সীমানা ঘেঁষা চেতুয়া-বরদা পরগনা। তার রাজা ছিলেন শোভা সিংহ। ইতিহাস তাঁকে আখ্যা দিয়েছিল– বাংলার শিবাজী। নিম্নবঙ্গে, গঙ্গার পশ্চিমে, বিশাল এক রাজ্য গড়েছিলেন তিনি। বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে হত্যা ও বর্ধমান অধিকার তার এক উদাহরণ।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ, অমিত পরাক্রম শোভা সিংহ প্রজাবৎসলও ছিলেন। গ্রামীণ হস্তশিল্পের বিকাশ, শিল্পের বিপণনের জন্য হাট আর বাজারের পত্তন, দীঘি-জলাশয় খনন, নিকাশীর জন্য নদী-খাল সংস্কার, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ– কী করেননি শোভা?
কিন্তু এই মানুষটির দুরাচারেরও শেষ নাই। দুটি উল্লেখ করা যাক।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আখ্যান এক– বীরসিংহের লাগোয়া গ্রাম– যদুপুর। “শিবায়ন” রচয়িতা কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের সুন্দরী পত্নী পুকুরে স্নান করছেন।  প্রকাশ্য দিবালোকে শোভা তাঁকে ঘোড়ায় তুলে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন। ক্রূদ্ধ রামেশ্বর পঞ্চমুন্ডি আসনে বসে শোভার মৃত্যু কামনায় যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। এমনিতেই শোভার পত্নী অপহরণের কাজটি সমর্থন করতে পারেননি।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
এই সংবাদ জেনে, তিনি রামেশ্বরের পায়ে পড়ে স্বামীর জীবন ভিক্ষা করেছিলেন। ক্রূদ্ধ শোভা নিজের পত্নিকেই হত্যার হুকুম দেন। রাজার আদেশ পালন করেনি ঘাতক। রানীকে নিয়ে গঙ্গা পার হয়ে গভীর বনের ভিতর এক মন্দিরে সাধুর কাছে রেখে, নিজেও নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। প্রাণ ভয়ে জীবনে আর রাজার সামনে আসেনি। এদিকে শোভাও  রামেশ্বরকেই ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছিলেন।

মূল আখ্যান– শোভার দরবারে উঁচু পদের এক কর্মচারী ছিলেন জনৈক শ্যাম দাস (মতান্তরে– জনানন্দ দাস)। গড়খাই দিয়ে ঘেরা বাস্তু তাঁর। গোপীনাথের মন্দিরও গড়েছেন। একটি পুকুর খননের জন্য একবার বহু আদিবাসী শ্রমিক লাগিয়েছিলেন। সেসময়ই রাজা শোভা সিংহের কাজের জন্য কিছু শ্রমিকের দরকার পড়েছিল। কিন্তু শ্যাম দাসের কাজে যুক্ত থাকায়, শ্রমিক পাওয়া যায়নি। এতে ভয়ানক ক্রূদ্ধ হয়ে শোভা হুকুম দিলেন– শ্যাম দাসটাকে ধরে নিয়ে আয়।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ভরা দরবার। শ্যাম দাস গিয়ে হাজির হয়েছেন।  কেন এত্তেলা, কারণ জানা নাই। রাগে কাঁপতে কাঁপতে শোভা হুকুম দিলেন– হতভাগার মুনডুটা কেটে আমার হাতে দে।
মুখের কথা খসলো না। সিপাইর এক কোপে শ্যাম দাসের কাটা মুন্ডু মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
বিস্ময়ে ত্রাসে গোটা দরবার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুখে কথা ফোটেনি কারও। প্রতিবাদ তো অনেক দূরের কথা। তবে, সেই ঘটনা নিয়ে গান বেঁধেছিল কোনও এক গেঁয়ো কবি। সে গান গেয়ে দোরে দোরে ভিক্ষা করে বেড়াত ভিখিরিরা।

তারপর কেটে গিয়েছে দু’ শ বছর। বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে শিলাবতী, কংসাবতী আর রূপনারায়ণের বুক বেয়ে। শ্যাম দাসের সেই মন্দিরও জীর্ন হয়েছিল কালের আঘাতে।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ইং ১৮৪৪ সাল। দাস বংশের জনৈক যজ্ঞেশ্বর দাস.মন্দিরটির সংস্কার করিয়েছিলেন। সেসময় তিনি বড় আকারের একটি পদ্য লিখিয়ে নিয়ে সেঁটে দিয়েছিলেন মন্দিরের সামনের দেওয়ালে। সেই পদ্যেমন্দির নির্মাণ, নির্মাতার পরিচয়, জীর্ণ মন্দির সংস্কার হবে না কি নতুন তৈরী হবে– কত কথাই  না লেখা হয়ে ছিল। তবে, তার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল শোভা সিংহ রাজার দুরাচারের কাহিনীটিও।

মন্দিরের সামনের দেওয়ালে কার্নিশের ঠিক নীচে রয়েছে পদ্যটি। বড় বড় ৯টি সারিতে ফলকটি বিন্যস্ত। শোভার কুকীর্তি হিসাবে তার এক অংশে লেখা হয়েছে– ” লবাব প্রিথিবিপতি / তার ভএ বেস্ত ওতি / সিমানা ঘেরিআ খোলি গড়। / দামামা দরোজা পরে / জয়চোন্ডী ক্রিপা বরে / পুস্কণ্যি খোলিল তারপর।। / সন্ধান পাইল যদি / সভাসিংহ নরোপতি / এই হেতু কড়া না আইসে।/ কম্পবান-ক্রোধ ভরে / আঙ্গা দিল ওনুচরে / হান সির পদাতিক রোষে।। / বিপক্ষ হইল কাল / কাল হইলো পরোকাল / কিছু না জানিল মহাসঅ। /  তাহাতে ছেদিল মুন্ড / দুগ্গা দুগ্গা ডাকে তুন্ড / সুনি রাজা মানিল বিস্বয়। । কোবিতা কোরিতে তার / এই স্তানে আটা ভার / হোইল দুই সতেক বৎসর। রিত নিত পিত্রি কিত্তি / ওই বংসে অদ্যাবোদি / বন্দনা হোইতেছে সুন্দর।। …”   (পদ্যের বানান হুবহু রাখা হয়েছে। একটি অক্ষরও বদল করা হয়নি। কড়া– আদিবাসী এক সম্প্রদায়। )   

‘ এক-রত্ন ‘ রীতির দক্ষিণমুখী মন্দির। সামনে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ যুক্ত একটি অলিন্দ। পিছনে এক-দ্বারী গর্ভগৃহ। বিষ্ণুপুর ঘরানার আদলে তৈরী। বাঁকানো প্রান্তের চালা-ছাউনি দেওয়া গর্ভগৃহ। তার মাথায় রত্নটি স্থাপিত। চারকোণা গর্ভগৃহ, কিন্তু উপরের রত্নটি আট-কোণা। এই মন্দিরের বিশিষ্টতা হল, রত্নটি মন্দিরের মাথায় উত্তরের দেওয়াল ঘেঁষে স্থাপিত, কেন্দ্রীয় স্থানে নয়। মন্দিরের অন্য বৈশিস্ট হল এর সামনের দেওয়ালের অলংকরণ। অজস্র টেরাকোটা ফলকে সাজানো হয়েছে দেবালয়টি।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
যাওয়া-আসা : হাওড়া-খড়্গপুর রেলপথের পাঁশকুড়া স্টেশন। সেখান থেকে ঘাটাল গামী পথে টালিভাটা স্টপেজে নেমে, সামান্য দূরে রাধাকান্তপুর গ্রাম ও মন্দির।
সমীক্ষা সহযোগী : প্রাবন্ধিক সুগত পাইন , দাসপুর।                  প্রচ্ছদ -রামকৃষ্ণ দাস

RELATED ARTICLES

Most Popular