Homeএখন খবরশ্রদ্ধা ! অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ।। আশিস মিশ্র

শ্রদ্ধা ! অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ।। আশিস মিশ্র

আর একটিও কবিতা লিখবেন না “যৌবন বাউল ”      আশিস মিশ্র

প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর হয়ে জার্মানি। তিন ভুবনের গল্প। শেষ হয়েও হলো না শেষ। এতো দ্রুত সমাপ্তি আমরা তো কেউ চাইনি। তবুও মহাকালের কাছে নতজানু হয়ে চিরঘুমে চলে গেলেন বাংলা কবিতার বিশ্ব বাউল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সাতাশিতেই তাঁর যৌবন থমকে দাঁড়ালো অদৃশ্য মরমি করাতের কাছে। আর কোনো দিন তিনি দৃশ্যমান হবেন না। কিন্তু তাঁর মৌলিক ধ্বনির ভেতর ডুব দিয়ে কবিতা পাঠক খুঁজে যাবেন অলোকময় কাব্যভাষা। যা চির রঞ্জিত করে তিনি রেখে গেলেন একের পর এক কবিতার বাকপ্রতিমায়। যা আজ বাংলা কাব্য সাহিত্যের সম্পদ।

রবীন্দ্র উত্তর পর্বে যখন বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ বাংলা কবিতাকে নতুন ভাষা দিয়ে নির্মাণ করেছেন,তারপর আমরা পেলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ,অরবিন্দ গুহ, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, মনীন্দ্র গুপ্ত, উৎপল কুমার বসু, আলোক সরকার, নবনীতা দেবসেন,প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে। এই পর্বে আরও অনেকেই আছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক নক্ষত্রের মৃত্যু হয়েছে। কেউ ষাটের পর,কেউ সত্তরের পর,কেউ আশি, নব্বই পেরিয়ে। অনিবার্য এই মৃত্যু থেকে কারুর রেহাই নেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন লিখছেন–” ও চিরপ্রণম্য অগ্নি আমাকে পোড়ও…” ; তেমনি অলোকরঞ্জন লিখছেন –” একদিন স্বরচিত সূর্যের গহ্বরে / সানন্দে যাপন করে ছ’ হাজার লিখেছি কবিতা, /এক – একবার ঈশ্বরের শীর্ণ সিংহাসনে / তাঁর স্নিগ্ধ সন্নিধানে জায়গা করে নিয়েছি, অন্তত / এরকম ঠাউরে নিয়ে ; / একদিন অরবিন্দ গুহ/ আমায় বললেন যেন পুনরাবৃত্তির ঘোর থেকে / সরে এসে অনীশ্বর হয়ে উঠি প্রকাশ্য চত্বরে। ” কবি অরবিন্দ গুহকে আমরা জানি। তাঁকে অনুসঙ্গ করে এমন একটি কবিতা তিনি লিখে গেছেন। যা মৃত্যুর পরেও সূর্যসত্য হয়ে থাকে।

নির্জনতা, সংযত নির্মাণ ছিলো তাঁর স্বভাবগুণ। সর্বোপরি বাকসংযম ও কথপোকথনে তিনি ছিলেন এক অন্য মানুষ। কিন্তু তাঁর মৌলিকত্বেও প্রতিবাদের কন্ঠ শুনেছি। তাঁর গদ্যেও দেখেছি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগত সম্পর্কে শ্লেষ। কিন্তু তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি লেখক হয়েও বিশ্ব আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে যে বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, সেই বাংলা ছিলো তাঁর নিজের নির্মিত। সেই বাংলা ভাষার ধ্বনি মাধুর্য ও বাক্যগঠন তাঁর সমসাময়িক কোনো কবির পক্ষে তেমন করে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর কাব্যভাষা ও গদ্যভাষায় অবগাহনপর পর মনে ও প্রাণে যে আনন্দ ধ্বনিত হয়, তা অন্য কোনো কবির সঙ্গে তাকে তুলনা করা যায় না। এসবই তিনি নিজের মতো করে আয়ত্ত করেছিলেন। সেই জন্য তিনি অতুলনীয়। পাশ্চাত্যের মাটি ও হাওয়ায় ভেসে বেড়িয়েও প্রাচ্য বাংলার অন্তরাত্মাকে আজীবন হৃদয়ে বহন করে গেছেন। না হলে বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিনে তরুণ কোনো কবিকে নিয়ে কবিতা লিখতেন না। কলকাতা এলেই এখানকার কবিদের সঙ্গে তাঁর আড্ডা হতো। তিনি লেখা দিতেন লিটল ম্যাগাজিনে।

তবে কবিসম্মেলনগুলিতে যেতেন খুব কম। বেশ কয়েক বছর আগে হলদিয়ার বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে তিনি এসেছিলেন কবি তমালিকা পন্ডাশেঠের আমন্ত্রণে। এক মঞ্চে সেবার আমরা পেয়েছিলাম এক সঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে। সে এক বিরল মুহূর্ত ছিলো। তাঁর বাচনিক বিন্যাসে আমরা সবাই সেদিন মগ্ন হয়েছিলাম। সে এক মধুর স্মৃতি।

স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি ” উৎসবের সে – এক পরিবেশ ” গদ্যে লিখেছেন –” এতদিন একযোগে দুই বন্ধুর আর্টস বিল্ডিং – এর সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ক্লাস নিতে যাওয়ার মুখে তাদের নতুন কোনো স্বপ্নকে প্রকল্পে অনুবাদ করতে চাওয়ার পরম্পরা ছিল অব্যাহত। এরই মধ্যে আচমকা একদিন আন্তর্জাতিক একটি লেখক সমবায়ের আমন্ত্রণে একজন বন্ধুকে চলে যেতে হল আইওয়ায়। আমাদের সকলেরই তখন মাথায় হাত, যদিও যৌথ সংহতির গরজে সবাই সিদ্ধান্ত নিল, তাঁর হাওয়াই উড়ান সুসম্পন্ন হওয়ার আগেভাগেই তাঁকে দূর থেকে চমকে দেওয়ার জন্য কিছু – না – কিছু একটা করতেই হবে। আমাদের সেই বাংলা বিভাগের পড়ুয়ারা রাতারাতি ওই মাঙ্গলিক ষড়যন্ত্রে আমার সতীর্থ হয়ে উঠল।… “। ওই প্রসঙ্গে তিনি তারপর লিখেছেন –” উৎসবের এই পরিবেশই ঘরানার ঐতিহ্য নিয়ে দ্রুতলয়ে কবিপক্ষের মুখে রূপগ্রহ করল আরদ্ধ প্রকল্পনা –‘ কবিতা ও কবিকথা’ ( ২৫ – ২৭ এপ্রিল, ১৯৬৮)। মনে পড়ে , বিশ্ববাজারে তখনও এই থীম, অর্থাৎ কবিতার মুকুল থেকে মুঞ্জরণে রচয়িতা কতটুকুই বা ধাত্রী দেবতা– অথবা আদৌ কিনা– এসব নিয়ে আদপেই কোনো শোরগোল ওঠেনি। আমরাও যে তা নিয়ে প্রবর্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলাম সেটা বললে সত্যের নিদারুণ অপলাপ হবে। সেদিন আমাদের আসন্ন লক্ষ্যমাত্রা হয়তো কবিতার মূল্যায়নে অ্যাকাডেমিক আর নান্দনিকের মধ্যবর্তী বেড়াটাকে খসিয়ে দেওয়া। আমাদের অব্যবহিত অভিপ্রায় তখন, কোত্থেকে আমরা ঘটিয়ে তুলব এমনতরো কবিসমাবেশ যা, হ্যোল্ডারলীনের ভাষায়, প্রমাণ করে দেবে কবিরা কোনো অপ্রাপনীয় দুর্লভ দেবদূত নন, তাঁরা পরস্পরের নিকট প্রতিবেশী..”।
এটুকু পাঠের পর নিশ্চয় আমরা সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতটি বুঝতে পারি। এবং কোন সময়, তাঁর ও তাঁদের অবস্থানের আভাস পাই৷ আজ তিনি নেই। তাঁর প্রাণের বন্ধু শঙ্খ ঘোষ এখন কী ভাবছেন!  স্মৃতি কাতর হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু উপায় নেই। কিছুদিন আগেই আর একজন চলে গেছেন। তিনি অশ্রুকুমার সিকদার।

কবিকথা বলতে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছিলেন–” প্রেসিডেন্সি কলেজের জীবনেই লেখাজোখার ব্যাপারটা আমার ভেতরে কেমন চারিয়ে গিয়েছিল।” —” অকস্মাৎ দীপকের সঙ্গে পরিচয়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে — দীপেন তখনো পর্যন্ত আমাদের কলেজে আছে। তারপর দীপকের মাধ্যমেই তদানীন্তন তরুণ মহলের যতসব বাঘাবাঘা কবিদের সঙ্গে। এই আনন্দ বাগচী,সুনীল, ফণিভূষণ,উৎপল, প্রণব প্রভৃতির সঙ্গে পরিচয়, ঠায় আড্ডা। সন্দীপনের সঙ্গে তারই আগে পরিচয় হয়েছে –মোহিত, মতি, শিবশম্ভু, বরেন, শংকর চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ। আমি নিজে তো গাঁইয়া, টর্পেডো আমার চেয়ে ঢের বেশি গাঁইয়া ছিলো। বিনয় আমাদের কলেজের ছাত্র, পরে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, এখন বাংলাদেশের বিস্ময়কর কবি। অলোকরঞ্জন আমাদের কলেজের উঁচুতে পড়তেন, শঙ্খ ঘোষ আরো। মাত্র ছাত্র হিসেবে ওঁদের সঙ্গে সামান্যই আলাপ ছিল তখন। ”

সেই সব পুরনো দিনের ইতিহাস, যা বাংলা সাহিত্যেরই ইতিহাস। তার মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ভার্চুয়াল জগতের তখনও কোনো সাড়া নেই। মুদ্রিত মাধ্যম ও শ্রবণ মাধ্যমই ভরসা। তার মধ্যে থেকে উঠে আসা এক কবি যখন ডিজিটাল মাধ্যমে এলেন, তখনও তিনি বদলের ভেতরেই হাঁটতে থাকলেন। একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থে এক নতুন ভাষ্য। ছন্দের চলাচলে তা ছিল একেবারে নিখুঁত। এমন কবির মৃত্যুর পর তাঁর পার্থিব শরীর নিয়ে আমি বা আমরা শ্মশান পর্যন্ত যেতে পারলাম না। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর পর শ্মশানে যে কেঁদে হৈচৈ বাঁধিয়ে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তরুণ কবি দল যেভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, শক্তি বা সুনীলের মৃত্যুতে যেভাবে শোকাহত হয়েছিল কবিদল, তেমনি আজও আমরা শোকবিহ্বল এই বিশ্ব বাউলের জন্য।
তিনি শুধু কবি নয়, তিনি কথকও বটে। তাঁর একটি গল্প বইয়ের নাম ” যে সব গল্প দেরাজবন্দি ছিল “। এই বইয়ের একটি গল্পের চরিত্রের নাম সেঁজুতি। লেখক এই গৃহবধূকে পড়াতে যেতেন। একটি বর্ণনায় লেখক লিখেছেন –” গাছগুলি স্ব- ইচ্ছায় উড়তে পারে ঠিকই, কিন্তু মানুষের কাছে ফিরে আসে মানুষ। আমি স্টেশনে পৌঁছিয়ে দেখি রাত দশটার আগে কলকাতাগামী কোনো ট্রেনই নেই। কারা নাকি আগের স্টেশনে ফিশ প্লেট সরিয়ে নিয়েছে,… অথবা এমনও হতে পারে ‘ মানুষ হয়ে জন্মেছি। মানুষ হয়েই মরতে হবে ‘ আমার রক্তকোষে এই অঙ্গীকারের তাড়নাই মারমুখী হয়ে উঠেছিল অগত্যা আমি সেঁজুতির কাছেই ফিরে এসেছিলাম৷ ”
সেঁজুতি কোথায় এখন? তারও কি চোখ ভিজে যাচ্ছে আজ….।

RELATED ARTICLES

Most Popular