Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ৮৮, চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ৮৮, চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                                                চিন্ময় দাশ
কাশীশ্বর শিব মন্দির, কাশীপুর-ঔরঙ্গাবাদ                                  (কেশিয়াড়ি)
শ’-তিনেক বছর আগের কথা। তখন কেশিয়াড়ি বলতে একটি মৌজাকেই বোঝাতে না। ৩৬টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেদিনের কেশিয়াড়ির পরিচিতি। রেশমশিল্পের সুবাদে, তখন কেশিয়াড়ি এলাকার অর্থনীতি পুষ্ট হয়েছিল বিপুলভাবে। ৩৬টি গ্রাম ভাগ করা ছিল ১২টি ভাগে। প্রত্যেক ভাগের কেন্দ্রস্থলে ছিল ১টি করে শিবমন্দির। সেই ১২টি মন্দির বা মাড়ো পরিচিত ছিল ‘ বারো মাড়ো ‘ নামে।
মেদিনীপুর জেলায় রেশম শিল্পের বিকাশ হয়েছিল অনেকগুলি কেন্দ্রে। চন্দ্রকোণা, দাসপুর, কিংবা আনন্দপুর ইত্যাদির মত, কেশিয়াড়িও ছিল তেমনই একটি কেন্দ্র। রেশম উৎপাদন এবং তার বাণিজ্য থেকে বহু পরিবার বিশেষ সম্পন্ন হয়ে উঠেছিল কেশিয়াড়িতে। বিশেষ করে কেশিয়াড়ি সদর গঞ্জটিতে। সেখানে অনেকগুলি দেবমন্দির নির্মিত হয়েছিল বিত্তশালী পরিবারগুলির হাতে। ৩টি জগন্নাথ মন্দির। দামোদর, গৌরাঙ্গ ইত্যাদি নামের কয়েকটি বিষ্ণু মন্দির। ১টি শীতলা মন্দির। আর তৈরী হয়েছিল শিব মন্দির। অনেক নামে অনেকগুলি শিব মন্দির। একই ‘কাশীশ্বর’ নামে ২টি শিবমন্দির আছে এখানে। একটি আছে ভবানীপুর গ্রামে। কাশীপুর-ঔরঙ্গাবাদ গ্রামে আছে বর্তমান আলোচ্য অন্য মন্দিরটি। গ্রামের কাশীপুর নাম থেকেই দেবতার নাম হয়েছিল– কাশীশ্বর শিব।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন, সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে একটি তামার প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে মন্দিরে। ভারী বিচিত্র বয়ান সেটির– ” শ্রী রঘুনাথ দাসদাস তথা শ্রী ভোলানাথ দা/ স তথা শ্রী মোহনদাসদাস তথা শ্রী মধুসূ/ দন দাসদাস তথা শ্রীহরিচরণদাসদাস/ তথা শ্রীকানাইচরণ দাস তথা শ্রী শ্রীনাথ/ দাসদাস সাকিনীন কাসীপুর তঃ কাসীয়াড়ী/ সন ১২৪৯ সাল তাঃ ৪ মাগ বৃহস্পতিবার “।
আরও দুটি নাম আছে ফলকটিতে। ফলকের দুই প্রান্তে আড়াআড়ি ভাবে লেখা। ডাইনে– ” শ্রী স্বরূপমোহন মিস্তরী/ কারিকর “। আর, বামে– ” শ্রী বৈদ্যনাথ কামীলার/ খোদিত “।
লিপির বয়ান থেকে এটি জানা গেল যে– বাংলা ১২৪৯ সন, বা ১৭৬৪ শকাব্দ, কিংবা ইং ১৮৪২ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। কারিগর ছিলেন শ্রী স্বরূপমোহন মিস্ত্রী। ফলক খোদাইকার– শ্রী বৈদ্যনাথ কামিল্যা। বর্তমানে মন্দিরের আয়ু হয়েছে প্রায় পৌনে দু’শ বছর। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় সঠিকভাবে জানা যায় না। স্থানীয় দাস পদবীর পরিবারগুলিতে ঘুরে ঘুরে প্রশ্ন করেও, কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। আমাদের অনুমান, ফলকে উল্লিখিত ৬ জন ব্যক্তির যৌথ উদ্যোগে শিবের এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকতে পারে।
যাই হোক, কাশীপুর গ্রামটি ২টি পাড়ায় বিভক্ত– উপর কাশীপুর, নীচ কাশীপুর। দুটি পাড়া বছরে ৬ মাস হিসাবে মন্দিরে সেবাপূজার দায় বহন করে। কিছু সম্পত্তিও আছে দেবতার। তার উপস্বত্ত্ব থেকে নিত্যপূজা ছাড়াও, শিব চতুর্দশী এবং গাজন আয়োজিত হয় বেশ আড়ম্বরের সাথে। বারোটি মাড়ো-র কথা আমরা পূর্বে বলেছি। প্রত্যেক মাড়ো-র জন্য প্রচলন হয়েছিল নিজস্ব নিশান। নিশানে সিংহ, বাঘ, ময়ূর, কুমির ইত্যাদি পৃথক পৃথক বিভিন্ন প্রতীক (বা, লাঞ্ছন-চিহ্ন) আছে প্রত্যেকের। গাজনের সময় ‘আলমস্বামী’ নামের সন্ন্যাসীরা সেই নিশান নিয়ে শোভাযাত্রা করেন। আজও প্রচলিত আছে সেই রীতি। গাজনের শেষ দিন– মেল। সেদিন বারোটি মাড়ো-র বারো দল সন্ন্যাসী নিজেদের প্রতীক-লাঞ্ছিত নিশান নিয়ে শোভাযাত্রায় সামিল হন। পাট বা মহামেল-এর দিন অগ্নিশুদ্ধি, জলভরা, গৌড়িয়া ভার, জামডালি ইত্যাদি কতকগুলি কৃত্যক পালন করতে হয় সন্ন্যাসীদের। উল্লেখ্য করা দরকার, এইসব কৃত্যকের অধিকাংশই সীমান্ত-রাজ্য ওডিশার প্রভাবে সৃষ্ট। কেশিয়াড়ির বর্ণাঢ্য গাজন উৎসব আজও তার প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
এবার মন্দিরের কথা একটু বলা যাক। দালান, শিখর, রত্ন এবং চালা– বাংলায় প্রাচীন মন্দিরগুলি মূলত এই ৪টি ধারায় নির্মিত। অবশ্য এর সাথে, ‘ পীঢ় ‘ রীতিরও সামান্য কয়েকটি মন্দির দেখা যায়। তবে, সেগুলি মূলত বাংলার ওডিশা-সীমান্তলগ্ন দক্ষিণ এলাকায় নির্মিত হয়েছিল।
মন্দিরময় গ্রাম কেশিয়াড়ি। কয়েকশো বছরের প্রাচীন অনেকগুলি মন্দির আছে কেশিয়াড়িতে। লক্ষণীয় বিষয় হল, মুখ্য ৪টি ধারার মন্দির তো আছেই। ‘ পীঢ় ‘ রীতির মন্দিরও আছে এখানে। কাশীশ্বর শিবের এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে ” চালা-রীতি”তে।
চালা-রীতির পশ্চিমমুখী এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে আট-চালা হিসাবে। দুটি তলের আটটি চালই সুন্দর গড়ানো। ফলে, কার্ণিশগুলি ভারী সুদৃশ্য। মাথায় চূড়াটি বেঁকি, আমলক, কলস আর ত্রিশূল দিয়ে সাজানো।
মন্দিরের ভিত্তিবেদীটি বর্তমানে সামান্যই উঁচু। তবে, বেদীর চতুষ্কোণ ব্লকগুলি দেখে অনুমান করে নেওয়া যায়, ভিত্তির অনেকখানি অংশই কালের আঘাতে ভূমিগত হয়ে গিয়েছে। পরবর্তী কালে পৃথক একটি নাটমন্দির নির্মাণ করেছেন গ্রামবাসীগণ। মন্দিরের একেবারে সামনে সেটি অবস্থিত।
গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বারপথ। সেটি খিলান-রীতির। তবে দ্বিতলের চার দিকের দেওয়ালে, চারটি প্রতিকৃতি-দ্বার রচনা করা হয়েছে।
একেবারে সাদামাটা গড়ন। কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। তিন দিকের দেওয়ালে কয়েকটি মিথুন-মূর্তি দেখা যায় কেবল। তবে, ভারী কাঁচা হাতের কাজ সেগুলি। তবুও আজকের জার্নালে এই মন্দির স্থান পেয়েছে কয়েকটি বিশেষত্বের কারণে :
১. ১. একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে মন্দিরে, পূর্বেই বলেছি আমরা। ফলক তো বহু মন্দিরেই থাকে, আছেও। সেসব ফলক অধিকাংশই টেরাকোটা কিংবা পাথরে খোদাই করা। কিন্তু প্রাচীন মন্দিরে ধাতু-ফলক প্রায় দেখাই যায় না। সেই বিরল দৃষ্টান্ত এই মন্দিরে দেখা যায়। এখানে লিপিটি তাম্র-ফলকের উপর খোদাই করা।
২. মন্দির সাধারণভাবে নির্মিত হয় স্থানীয় ভাবে পাওয়া যায়, এমন উপাদান ব্যবহার করে। ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথর কেশিয়াড়িতে সহজলভ্য। বেশ কয়েকটি মন্দির তা দিয়েই নির্মিত হয়েছে এখানে। কিন্তু এই কাশীশ্বর মন্দিরে পাথরের ব্যবহার করা হয়নি। নির্মাণ করা হয়েছে ইট পুড়িয়ে, চুন আর সুরকির মর্টারদিয়ে।
৩. চালা-রীতির একক মন্দির। কিন্তু সরাসরি গর্ভগৃহে প্রবেশ নয়। সামনে, দ্বারপথের উপরে একটি প্রতিকৃতি-জগমোহন’ নির্মাণ করা হয়েছে। সেটি চালা-রীতির নয়, নির্মিত হয়েছে ‘শিখর-দেউল’ রীতিতে। এছাড়াও, সেই দেউলের মাথার ছাউনি বা গন্ডী অংশে ‘পীঢ়-রীতি’ প্রয়োগ করে ৮টি থাক কাটা হয়েছে। এমনটিও কমই দেখা যায়।
৪. লিপির কথা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এমন বয়ান একান্তই বিরল।
৫. শিবের মন্দিরে বিগ্রহ অধিষ্ঠিত থাকেন ৩টি রীতিতে– গর্ভগৃহের ভূতলে, ভূতলে বেদীর উপর কিংবা একটি গম্ভীরার ভিতর। সেই গম্ভীরা গোলাকার বা চতুষ্কোণ– দুই-ই হয়ে থাকে। এই মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্পূর্ণ অংশ জুড়েই গম্ভীরা। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে, তবে দেবতার লিঙ্গ-বিগ্রহটি স্থাপিত আছে।
যাত্রাপথ : মেদিনীপুর কিংবা খড়্গপুর থেকে সুবর্ণরেখা নদীর ভসরা ঘাট অভিমুখী পথের উপরেই কেশিয়াড়ি। এছাড়াও, ৬০ নং জাতীয় সড়কে খড়গপুর থেকে বালেশ্বর মুখী পথে বেলদা হয়েও, কেশিয়াড়ি পৌঁছানো যাবে। বাজার থেকে সামান্য দূরেই মন্দিরটির অবস্থান।

RELATED ARTICLES

Most Popular