Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                                                   চিন্ময় দাশ            জগন্নাথ মন্দির, গোপীনাথপুর                                   (থানা– কেশপুর, মেদিনীপুর) মেদিনীপুর নগরীর গা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে চিরপ্রবাহিনী কংসাবতী। বইতে বইতে একখানে পৌঁছে, দুটি শাখায় ভাগ হয়েছে নদী। সেখানে তার ডাইনে ডেবরা থানার …. গ্রাম। আর, অশ্বখুরের মত নদীর জলরেখা দিয়ে ঘেরা বামের গ্রামটি হোল…..। তার থানা কেশপুর। এর পর, নদী তার দুই বাহুর বেষ্টনীতে যে ভূমিভাগকে ঘিরে বয়ে গিয়েছে দু’দিকে, সেটি দাসপুর থানা। এই হল এলাকার ভূগোল। এই বিভাজনভূমিতে পৌঁছুবার আগে, নদী তার বাম তীরে অনেকখানি পথ এসেছে কেশপুর থানার মাটিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। বিভাজনের কিছু আগে, পরপর অনেকগুলি গ্রাম, গোপীনাথপুর, বাদাড় ইত্যাদি। সেখানে গোপীনাথপুর আর বাদাড় গ্রামে আছে দুটি প্রাচীন মন্দির। ইতিপূর্বে বাদাড় গ্রামের মন্দিরের বিবরণ আমরা শুনিয়েছি পাঠক-পাঠিকাদের। আজ গোপীনাথপুরের কথা।

গোপীনাথপুরেও আছে সুন্দর দর্শন একটি জগন্নাথ মন্দির। আজ এই জার্নালে, রাজার হাতে তৈরী আর প্রজাদের বুক দিয়ে আগলে রাখা, সেই মন্দিরের কথকতা। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কর্ণগড়ের খ্যাতকীর্তি রাজা যশোবন্ত সিংহ। প্রজাদের দেবার্চনার সুবিধার জন্য। তাঁর শাসনকাল ইং ১৭১১ থেকে ১৭৪৮ সাল। মন্দিরের কার্ণিশের গায়ে লাগানো একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক এবং পূর্ববর্তী পুরাবিদগণের বিবরণ থেকেও জানা যায়, ১১১৯ বঙ্গাব্দ বা ইং ১৭১৯ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। যশোবন্তের পর, তাঁর পুত্র অজিত সিংহ ৭ বৎসর রাজত্ব করে মারা গেলে, তাঁর পত্নী ইতিহাসখ্যাত রানি শিরোমণি সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি ৩৬৫ বিঘা লাখেরাজ সম্পত্তি দিয়েছিলেন এই মন্দিরকে। পরিচালনার জন্য, পুরী নগরীর ‘রাঘব দাস মঠ’ নামের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার কাজে যুক্ত করেছিলেন।

জেলার বিভিন্ন ইতিহাস বইতে লেখা হয়েছে, একবার ম্যালেরিয়া মহামারীতে কংসাবতীর দু’পারের বহু গ্রাম একেবারে উজাড় হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে ঘন জঙ্গলে পরিণত হচ্ছিল জনহীন গ্রামগুলি। গোপীনাথপুর, বাদাড় ইত্যাদিও ছিল সেই তালিকায়। বহু বছর পরে, মেদিনীপুর জেলার পূর্ব এলাকার কিছু ভাগ্যসন্ধানী মানুষ এসে হাজির হয়েছিলেন এখানে। প্রধানত রূপনারায়ণ অববাহিকার রাধামণি, কেলোমাল ইত্যাদি গ্রামের (তমলুক থানার অন্তর্ভুক্ত) মানুষ ছিলেন তাঁরা। এই দুটি এলাকায় অন্তত, একেবারে নতুন করে জনপদের সৃষ্টি হয়েছে তাঁদের হাত ধরে। একজন গোমস্তাকে মন্দিরের দায়িত্বে রেখে, মঠের মোহান্তরা চলে গিয়েছিলেন আগেই। সেই গোমস্তাও চলে গিয়েছেন ১৯৬৫ সালে। তখন থেকে ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীরাই এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন দেবতা আর মন্দিরের পাশে। বুক দিয়ে আগলেছেন মন্দিরটিকে। তাঁরাই চালু রেখেছেন দেবতার সেবাপূজার ধারাটিকেও।

ইতিমধ্যে “গোপীনাথপুর জগন্নাথজীউ সেবা সমিতি ” নাম দিয়ে একটি পরিচালন কমিটিও রেজিস্ট্রী এখানে। নুতন করে রথযাত্রার প্রচলন হয়েছে মন্দিরে। সংস্কার করা হয়েছে বিশালাকার দেবালয়টির। চোখ ফেরানো যায় না মন্দির থেকে। বিশ্বাস করা কঠিন, ৩০০ বছর আয়ুষ্কাল পূর্ণ করেছে এই মন্দির। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি দারুমূর্তি পূজিত হয় মন্দিরে। পার্শ্বদেবতা হিসাবে আছে মহাদেব, নারায়ণ বিগ্রহ এবং ৫১টি শিলামূর্তি। নিত্যপূজা তো আছেই। বারো মাসে তেরো পার্বণ এই মন্দিরে। তার ভিতর জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, ঝুলন, রাস ইত্যাদি প্রধান। বিশেষ আড়ম্বরে আয়োজন হয় দোল উৎসবের। পাঁচ দিন ব্যাপী বিস্তার সেই উৎসবের। দোলের শেষ দিন– দধিমঙ্গল। ‘অন্নকূট’ উৎসবের আয়োজন হয় সেদিন। ৩০ হাজারের বেশি ভক্তকে পাত পেড়ে জগন্নাথদেবের প্রসাদ খাওয়ানো হয় এখানে।

রাজার হাতে গড়া এই মন্দিরের গড়নটিও বেশ রাজকীয়। মাথায় ৫০ ফুট উঁচু, আড়ে আর বহরে প্রায় ২৪ ফুট বিস্তার। তিন-দুয়ারী অলিন্দ পার হয়ে, পিছনে গর্ভগৃহ। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট হল, গর্ভগৃহটি ভূতল থেকে বেশ গভীরে অবস্থিত। রামনগর থানার পানিপারুল গ্রামে শিবের মন্দিরেও এমনই উদাহরণ দেখা যায়। ত্রিতল পর্যন্ত উঠবার সিঁড়ি, তিনদিক জুড়ে চাপা-অলিন্দ আছে এই মন্দিরে। নব-রত্ন রীতির ইটের তৈরী পূর্বমুখী মন্দির। কোণের রত্নগুলিতে ত্রি-রথ এবং মাথার রত্নে পঞ্চ-রথ বিন্যাস করা। এছাড়া, প্রতিটি রত্নের গন্ডী অংশে পীঢ়-রীতি প্রয়োগ করা হয়েছে।

এই মন্দিরের গর্ব এর টেরাকোটা ফলকের অলংকরণ। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ কাহিনী, কৃষ্ণকথা ইত্যাদির মোটিফ সেগুলিতে। আছে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা মূর্তিও। কয়েকটি মিথুন-মূর্তি আর ফুলকারি নক্সার কাজও দেখা যায়। সাক্ষাৎকার : শ্রী মহাদেব সামন্ত, শিক্ষক — মেদিনীপুর শহর। শ্রী সুদর্শন মাইতি, বরুণ চক্রবর্তী (পুরোহিত)– গোপীনাথপুর। পথনির্দেশ– রেলযোগ বালিচক স্টেশন কিংবা ৬নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের ডেবরা থেকে ছোট গাড়িতে খানামোহন পৌঁছে, নদীর অন্যপারেই মন্দির। এছাড়া, মেদিনীপুর শহর থেকে ঘোষডিহা গামী পথের মুক্তিকেন্দ্র স্টপেজ। সেখান থেকে নদীর বাঁধে ৪ কিমি পাড়ি দিয়ে মন্দিরের সাক্ষাৎ। এলাকাটি একটু প্রত্যন্ত। কিন্তু, দুটি পথেই, একদিনের সফর বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে।

RELATED ARTICLES

Most Popular