Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ৯৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ৯৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                                       চিন্ময় দাশরাধামাধব মন্দির, আনন্দপুর (থানা– কেশপুর, মেদিনীপুর)
পূর্বে বহু প্রাচীন কালের ‘বাদশাহী সড়ক’, আর পশ্চিমে ‘অহল্যাবাই রোড’। এই দুই বিখ্যাত রাজপথের বেষ্টনীতে সেকালের একটি সমৃদ্ধ গ্রামের অবস্থান। নাম– আনন্দপুর। গ্রামটি সমৃদ্ধ হয়েছিল বয়নশিল্পের সুবাদে। একসময় রেশম, তসর আর সুতিবস্ত্রের উৎপাদনে বিপুল উন্নতি ঘটেছিল এর। বয়নশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত, এরকম শত শত শিল্পী এসেছিলেন আনন্দপুরে। তাঁদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন অন্যান্য সহকারী কর্মীরা। আর, বয়নশিল্পের বিকাশের একেবারে সূচনা পর্বে এসে হাজির হয়েছিলেন সম্পন্ন বণিকের দল।

বাণিজ্যের বিস্তারের পথ সুগম হয়েছিল একদিকে দুটি বিখ্যাত রাজপথের সুবাদে। দুটি পথ ধরে, পূর্ব এবং মধ্য ভারতের সাথে যোগাযোগ করা যেত। পাশাপাশি, পথ দুটি মেদিনীপুর নগরীতে মিলিত হয়ে, প্রসারিত হয়েছে দক্ষিণে। সেই পথে কলিঙ্গ হয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্য এলাকায় পৌঁছানো সহজ হতো।
এছাড়াও ছিল একটি জলপথ। আনন্দপুরের গা বেয়ে, বয়ে গিয়েছে ছোট একটি পাহাড়ি নদী। ভারি মিষ্টি নাম তার– তমাল। সেই নদী পথে প্রথমে শিলাবতী এবং পরে রূপনারায়ণের স্রোত বেয়ে গঙ্গায় পড়ে, কলকাতায় পৌঁছে যাওয়া যেত। ইংরেজ আসবার পর কলকাতার বাজার জমজমাট হয়ে উঠলে, এই জলপথটি শিল্পবিস্তরের বেশ সহায়ক হয়েছিল।

আনন্দপুরের এই সমৃদ্ধির কথা মেদিনীপুর জেলার সমস্ত ইতিহাসকারগণই উল্লেখ করে গিয়েছেন। একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে। ‘BENGAL DISTRICT GAZETTEERS MIDNAPORE’ গ্রন্থে Mr. L. S. S. O’Malley বলেছেন– ” The village (Anandapur) formerly had a considerable tusser silk-weaving industry and was the headquarters of several reach merchants : it is said, indeed, to have been larger than Midnapore. ”
স্বদেশের লেখকগণও স্বীকার করেছেন, একসময় মেদিনীপুর নগরীর চেয়েও, আয়তন ও লোকসংখ্যায় বড় ছিল আনন্দপুর। আর্থিক সমৃদ্ধির কারণেই, ইং ১৭৯৯ সালে পর পর দু’বার আনন্দপুর লুন্ঠিত হয়েছিল ‘চুয়াড় বিদ্রোহী’দের হাতে। প্রকৃতপক্ষে বহুসংখক অর্থবান পরিবারের বসত গড়ে উঠেছিল এই গ্রামে। পরবর্তীকালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথার সুবাদে, বেশ কয়েকটি পরিবার জমিদারি স্থাপন করেছিল এখানে। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে, যোগেশচন্দ্র বসু বলেছেন– আনন্দপুরে বাগ, মন্ডল, কুন্ডু এবং সরকার পদবীর জমিদাররা ছিলেন বিখ্যাত।
অন্য অনেকের মতো, কুন্ডু পদবীর পরিবারটিও বহিরাগত, আনন্দপুরের আদি বাসিন্দা নন। তবে তাঁরা বয়নশিল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন না। লবনের ব্যবসা ছিল পরিবারটির। আলোচ্য মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই বংশের জনৈক জয়কৃষ্ণ দাস অধিকারী। মন্দিরে কোনো প্রতিষ্ঠালিপি নাই। পুরাবিদগণ অনুমান করে গিয়েছেন– অষ্টাদশ শতকের শেষ কিংবা উনবিংশ শতকের প্রথমে মন্দিরটি নির্মিত হয়ে থাকবে।

কিন্তু আনন্দপুরেরই অধিবাসী, জনৈক পুরাপ্রেমী তমাল কলামুড়ি মহাশয় দুটি প্রাচীন দলিল এবং একটি সনন্দ (বাংলা ১১১১ সনের ১৫ই ভাদ্র তারিখের ১৩৩৩২ নং) থেকে সাল তারিখ উদ্ধার করে দেখিয়েছেন– ইং ১৭০৪ সালে দেবতার ভূসম্পত্তি এবং মন্দিরটির অস্তিত্ব ছিল। অর্থাৎ সেই হিসাবে, বর্তমানে ৩০০ বছরের বেশি হয়েছে মন্দিরটির আয়ু।
মন্দির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জয়কৃষ্ণ দাস অধিকারী। তাঁর একমাত্র পুত্র– চৈতন্য চরণ তাঁদের বংশের ‘দাস অধিকারী’ পদবী বদল করে, ‘কুন্ডু অধিকারী’ ব্যবহার শুরু করেছিলেন। বর্তমানে এই বংশ কেবল ‘কুন্ডু’ পদবীই ব্যবহার করেন।
যাক সে কথা। বিগত তিনশ’ বছরে, পরিবার অনেক বড় হয়েছে। সেবাইতের সংখ্যা বিশাল। সেকারণে, দেবতার সেবাপূজা এবং মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য, সেবায়তগণ একটি ট্রাস্ট গঠন করে নিয়েছেন– ‘ আনন্দপুর শ্রীশ্রীরাধামাধবজীউ ট্রাস্টি বোর্ড’। বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ৪০ জন।

রাধা এবং মাধব(শ্রীকৃষ্ণ)-এর মূর্তি ছাড়াও, কয়েকটি শালগ্রাম শিলা এবং গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দের পূর্ণাবয়ব মূর্তিও মন্দিরে পূজিত হয়। নিত্য ৩ বার পূজা। এ ছাড়াও, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, ঝুলন, দোল ইত্যাদি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। তবে, বিশেষ আড়ম্বর দেখা যায় ‘উত্থান একাদশী’ তিথির আয়োজনে।
‘এক-রত্ন’ রীতিতে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। রত্ন-রীতিতে বহুসংখ্যায় মন্দির নির্মিত হয়েছে মেদিনীপুর জেলায়। পঞ্চ-রত্ন, নব-রত্ন, ত্রয়োদশ-রত্ন এমনকি, সপ্তদশ রত্ন মন্দিরও আছে এই জেলায়। কিন্তু এক-রত্ন মন্দির সংখ্যায় খুব অল্প।
যে কয়েকটি এক-রত্ন মন্দির নির্মিত হয়েছে, তাদের মধ্যেও গঠনমূলক পার্থক্য দেখা যায়। কয়েকটি মন্দির আছে, যেগুলির রত্নটি মন্দিরের ছাউনির উপর কেন্দ্রীয় স্থানে না হয়ে, পিছনের দেওয়ালের লাগোয়া করে স্থাপিত। কেন্দ্রীয় স্থানে স্থাপিত হয়েছে, এমন মন্দিরগুলিতেও গড়নের পার্থক্য দেখা যায়।

বাংলায় এক-রত্ন মন্দিরের আদর্শ স্থান বিষ্ণুপুর। নিজস্ব গড়নের কারণেই তৈরী হয়েছে তার বিশিষ্টতা। আমাদের আলোচ্য, আনন্দপুর গ্রামের এই মন্দিরটি বিষ্ণুপুরী গড়নের একটি প্রতিরূপ।
ইট এবং পাথর– দুই উপাদানই ব্যবহার করা হয়েছে এই মন্দিরের নির্মাণে। পাথর বলতে, পশ্চিম সীমান্ত বাংলার মাকড়া পাথর বা ল্যাটেরাইট। মন্দিরের ভিত্তিবেদী এবং গর্ভগৃহের মাথার ছাউনি পর্যন্ত, যাকে পরিভাষায় ‘বাঢ়’ বলা হয়, পাথর দিয়ে গাঁথা। এর উপরের অংশ নির্মিত হয়েছে পোড়ানো ইটের সাহায্যে।

সম্পূর্ণ বর্গাকার পূর্বমুখী মন্দির। পাদপীঠ বা ভিত্তিবেদীটি বেশ উঁচু। তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৫ ফুট হিসাবে। মন্দিরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১৯ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট।
সামনে অলিন্দ এবং পিছনে প্রশস্ত গর্ভগৃহ নিয়ে সৌধটির গঠন। ‘ইমারতি রীতি’র স্তম্ভের সাহায্যে রচিত ‘দরুন রীতি’র খিলানের তিনটি দ্বারপথ– অলিন্দে প্রবেশের জন্য। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বারপথ, খিলান রীতিরই। অলিন্দের ভিতরের ছাদ বা সিলিং তৈরী হয়েছে ‘টানা খিলান’ রীতিতে। গর্ভগৃহের সিলিংয়ে কারিগরী কৌশল একটু জটিল রীতির– প্রথমে দুই দিকের দেওয়ালে দুটি করে খিলান নির্মাণ করে, সেগুলির মাথায় ভল্ট বা গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে।
এই মন্দিরের বৈশিষ্ট এর উপরের অংশে। মন্দিরের ছাউনি ‘চালা রীতি’র। তবে, চালার ঢাল এবং প্রান্তভাগ বা ‘কার্নিশ’-এর বক্রতা অত্যন্ত কম। চালাগুলির চারটি জোড়-মুখ হস্তীপৃষ্ঠের মত উত্তল নয়, হুবহু বিষ্ণুপুরী চাল ও জোড়মুখের অনুরূপ।
একটিই রত্ন বা চুড়া। ছাউনির একেবারে কেন্দ্রীয় ভাগে রত্নটি স্থাপিত। কলিঙ্গ প্রভাব প্রকট তার গড়নে। রত্নটির বাঢ়, বরণ্ড ও গন্ডী– তিন অংশ জুড়ে, ‘রথপগ বিন্যাস’ রীতিতে ‘পঞ্চ-রথ’ বিন্যাস করা। এছাড়াও, গন্ডী অংশে প্রয়োগ করা হয়েছে ‘পীঢ়-রীতি’র। ১২টি ‘পীঢ়’ বা থাক রচনা করা হয়েছে এই অংশে। গন্ডীর মাথায় ক্রমান্বয়ে বেঁকি, সুদর্শন একটি আমলক, দুটি কলস এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত। এতে ভারী সৌন্দর্যমন্ডিত হয়েছে শীর্ষক অংশটি।
সবার উপরে রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড-এর সযত্ন এবং সতর্ক দৃষ্টি। নিয়মিত সংস্কার এবং সুরক্ষাদৃষ্টির কারণে, জীর্ণতার তেমন কোনও ছাপ পড়তে পায়নি মন্দির সৌধটিতে।
মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গণে বিশিষ্ট গড়নের একটি তুলসীমঞ্চ নির্মিত আছে। আছে একটি গরুড়-মূর্তিও। পূর্বে ছিল কি না, জানা যায়নি। বর্তমানে তেমন কোনও অলংকরণ নাই এই মদিরে।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী হলধর কুন্ডু, অমিয় কুন্ডু, আনন্দ গোপাল কুন্ডু, কেশব কুন্ডু, শ্যামসুন্দর কুন্ডু এবং অভিজিৎ মন্ডল– আনন্দপুর। তরুণ কুমার মিশ্র– কানাশোল।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর শহর থেকে অনেক গাড়ি আছে, যেগুলি আনন্দপুর হয়ে যাতায়াত করে। শহর থেকে উত্তরে রানিগঞ্জ রোড ধরে গোদাপিয়াশাল। সেখান থেকে ডাইনে বাঁক নিয়ে, শাল-সেগুনের জঙ্গল আর ছড়ানো-ছিটানো গ্রাম ফুঁড়ে, আনন্দপুর গ্রাম। মোট দূরত্ব ২২/২৩ কিমি। এছাড়া, উত্তরের ক্ষীরপাই হয়ে চন্দ্রকোণা থেকে, কিংবা পূর্বের পাঁশকুড়া থেকে নাড়াজোল হয়ে, কেশপুর আসা যাবে। কেশপুর থেকে ৬/৭ কিমি পশ্চিমে আনন্দপুর।

RELATED ARTICLES

Most Popular