Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০৫ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০৫ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                                             চিন্ময় দাশ
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, পলাশী (ডেবরা)
এক সময় ছিল, যখন মেদিনীপুর নগরীর চেয়েও আয়তনে বড় ছিল আনন্দপুর গ্রামটি।ইতিহাসে উল্লেখ আছে একথার।রেশমের ব্যবসা থেকে বিশেষ রকম আর্থিক সমৃদ্ধি হয়েছিল এখানকার অধিবাসীদের। রেশম উৎপাদক, রেশম শিল্পী, মহাজন, ফড়ে, ব্যবসায়ী– নানান জনের হাতে প্রচুর অর্থের যোগান আসছিল।গ্রামের অধিবাসীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির কারণে, অন্যান্য নানান জীবিকার মানুষজনও এসে বসত শুরু করেছিল আনন্দপুরে। জনসংখ্যা এবং জনবসতি এলাকা– দুইয়েরই বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল সেকারণেই।অধিবাসীদের আর্থিক স্বাচ্ছল্য এতটাই বেড়েছিল যে বর্গীরাদু’-দু’বার এই গ্রাম লুন্ঠন করেছিল।
রেশমছাড়া, আনন্দপুর গ্রামে অন্যান্য জীবিকার মধ্যে একটি ছিল লবণের ব্যবসা।

নন্দী পদবীর একটি পরিবার লবণের ব্যবসা থেকে ধনী হয়ে উঠেছিলেন। আমরাজানি, পরে, ইংরেজরা  লবণ ব্যবসায় হাত দিয়ে, এ দেশে লবণের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ‘লবন আইন অমান্য আন্দোলন’-এর সূচনা।যাইহোক, সে অন্য প্রসঙ্গ।ইংরেজরা যখন জাহাজে করে লবণএনে, এদেশে বিক্রি শুরু করে, তখন নন্দীরা আনন্দপুর ছেড়ে, ডেবরা থানায় চলেএসেছিল।এর কারণ ছিল পরিবহনের সুবিধা।প্রাচীন জগন্নাথ সড়ক বা কটক রোড তো ছিলই, পরে কলকাতার এক রাজার দেওয়া টাকায় মেদিনীপুর খাল নির্মিত হয়েছিল। ডেবরার বুক চিরে তৈরী এই জলপথ বিস্তৃত ছিল একেবারে মেদিনীপুর পর্যন্ত।এসবের সাথে পরে যুক্ত হয়েছিল রেলপথও।

যোগাযোগের এই ত্রিবিধ সুবিধায় কপাল খুলে গিয়েছিল নন্দী বংশের। কলকাতা বন্দরে। লবণের জাহাজ ভিড়লে, নিলামে পুরো জাহাজ কিনে নিতেন নন্দীরা। তারপর বস্তাবন্দি করে বাজার জাতকরাই ছিল তাঁদের ব্যবসা।কলকাতাতেই ব্যবসার দপ্তর ছিল এই বংশের।প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন নন্দীরা। অচল লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখতে, সেই অর্থে একটি জমিদারীও প্রতিষ্ঠা করেছিল এই বংশ।
সে কালে মেদিনীপুর জেলার বিশেষ ভাবে বিখ্যাত জমিদারদের নিয়ে কত ছড়া শোনা যেত।তার মধ্যে নন্দীদের নামও উঠে এসেছিল একটি ছড়ায়।ছড়াটি এরকম–                                                   দে নন্দীর টাকা / কুচল ঘোড়াইর পাকা /       কাশী জোড়ার মান / ময়না রাজার ধান।
ঘোষপুর গ্রামের দে বংশ এবং পলাশী গ্রামের এই নন্দী বংশ– উভয়েরই বাস ছিল ডেবরা থানায়।প্রকৃত পক্ষে দুই জমিদারই বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক ছিলেন। পলাশীর জমিদার নন্দীরা বিশাল দোতলা প্রাসাদ গড়েছিলেন নিজেদের বসবাসের জন্য।আর দেবতার আবাস হিসাবে যে মন্দিরটি গড়েছিলেন, সেটিও বেশ বড় মাপের।
নিজেদের প্রাসাদের লাগোয়া করে, ঘেরা অঙ্গনের ভিতর গড়া হয়েছিল মন্দিরটিকে।তখন মেদিনীপুর জেলা জুড়ে চৈতন্যদেব প্রচারিত প্রেম ধর্মের প্রবল স্রোত বইছে।জেলার সমস্ত রাজবাড়ী আর জমিদার বাড়িতে নতুন করে বিষ্ণু বা রাধাকৃষ্ণের আরাধনার প্রচলন হয়েছে বা হচ্ছে।নন্দীরাও সেই স্রোতে অবগাহন করেছিলেন। বিগ্রহ হিসাবে কোন মূর্তি নয়, শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠা করে পূজার প্রচলন করেছিলেন তাঁরা। ৫১টি শালগ্রামের ভিতর, যে ১৮টি শিলা প্রধান, তার দ্বিতীয়টিই হল– লক্ষ্মীজনার্দন।সেই শিলাটিকেই কুল দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে, সেবা পূজার প্রচলন করা হয়েছিল। নন্দী বংশের ৮ পুরুষের বংশলতিকা আছে আমাদের কাছে।সেই বিশদ বিবরণের অবকাশ এখানে নাই। তবে, এটি বলা যায়, দেবতার সেবা পূজার ধারাটি সূচারু ভাবে বহাল রেখেছেন সেবাইতগণ। নিত্যপূজা এবং সম্বৎসরের বিশেষ পূজাগুলি সাধ্যমত আড়ম্বরের সাথেই আয়োজন করা হয় এখানে।নিজেদের খাদ্য আর বাসস্থানের সংকট দেখা দিলেও, এই এক সেবাইত পরিবার, যাঁরা দেবতার সেবা পূজায় তার কোনও ছাপ পড়তে দেয়নি।

মন্দিরটি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।যেন এটিকে গড়া হয়েছে দক্ষিণ ভারতের দুর্গ-মন্দিরের অনুসরণ করে।উঁচু বেদির উপর ইটের তৈরী পূর্বমুখী মন্দিরটি দালান-রীতিতে নির্মিত। অলিন্দ এবং গর্ভগৃহ– দুটি অংশ এই মন্দিরের। সামনের অলিন্দে তিনটি দ্বারপথ।। পিছনে তিনটি কক্ষ– তার মাঝখানেটিতে দেবতার অধিষ্ঠান, সেটিই গর্ভগৃহ।

অলংকরণের কাজ হয়েছে টেরাকোটা ফলকে।কার্ণিশের নিচে এবং দুই প্রান্তের দুটি কোনাচ অংশ বরাবর ফলকগুলি সাজানো। এছাড়াও, সামনের দেওয়ালের মাথায় আলসে অংশেও একই রীতিতে ফলক দেখা যায়।বিষ্ণু মন্দিরের দ্যোতক একটি গরুড়-মূর্তি স্থাপিত আছে এই আলসের কেন্দ্রীয় ভাগে।
রাজকীয় নির্মাণ এই মন্দিরের বারো-দুয়ারী রাসমঞ্চটি। বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়।
সাক্ষাৎকার :সর্বশ্রী ননী গোপাল নন্দী, সুহৃদ কুমার নন্দী এবং প্রদীপ নন্দী– পলাশী।
পথ-নির্দেশ :হাওড়া-খড়্গপুর রেল পথের রাধামোহনপুর ষ্টেশন এবং ৬নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের আষাঢ়ী বাঁধ– এই দুইয়ের সংযোগকারী পথের উপর পলাশী গ্রাম।

RELATED ARTICLES

Most Popular