Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-৭|| অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ক্রান্তিকালের মনীষা-৭|| অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ক্রান্তিকালের মনীষা-৭                                                   অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

বিশ্বকবির বিজ্ঞান বীক্ষা- ১
একটা কথা আজকাল লোকজন প্রায়ই বলেন, রবীন্দ্রনাথ আজ এক ইন্ডাস্ট্রি| আচ্ছা ইন্ডাস্ট্রি মানে তো বাণিজ্য সম্পর্কিত শিল্প বা ট্রেড কিংবা ম্যানুফ্যাকচারিং| কিন্তু শিল্পের গৌরব কী কখনো পণ্য হয়? রবীন্দ্র সাহিত্য, রবীন্দ্র রচনাবলী, গীতবিতান এবং অবশ্যই রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও জনপ্রিয়তার ও বিক্রয়ের শীর্ষে| বিশ্বকবি এক বহুমুখী বিস্ময় প্রতিভা যাঁর রবিকিরণ বিশ্বের সব প্রান্তে পৌঁছে দেয় একই আবেদন| আর সে জন্যেই – “মৃত্যু কহে, পুত্র নিব; চোর কহে ধন-
ভাগ্য কহে সব নিব যা তোর আপন|
নিন্দুক কহিল, লব তব যশোভার
কবি কহে, কে লইবে আনন্দ আমার?”

গুরুদেবের সকল সৃষ্টি অনন্ত আনন্দ দিয়ে গড়া| আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা একাগ্রমনে ধারাবাহিক ভাবে না পড়লে একটা বিরাট ক্ষতি আমাদের চিন্তাশক্তির ও মননশক্তির| কেবলমাত্র ভাষা অনুশীলন দিয়ে উত্‍কৃষ্ট মানের কবিতা রচিত হয় না, এর জন্য দরকার উন্নত উদার মননশীলতাও|
রবি ঠাকুর বললেই এক ঝলকে মনে পড়ে তিনি একজন বিশ্বকবি, গীতিকার সুরকার, নাট্যকার, ছোটগল্প রচয়িতা, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, চিত্রকর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের যে দিকটি নিয়ে কম আলোচনা হয় তা হল তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা| বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের দিকেও যথেষ্ট নজর দিয়েছিলেন তিনি| শৈশব থেকেই রবীন্দ্রনাথ যে এক বিজ্ঞান সংস্কৃতির আবহে বড় হয়েছেন, তা আমরা তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ থেকেই জানতে পারি| বাড়ির বাইরে বেড়াতে গিয়ে তাঁর বাবার কাছেই প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা অর্জন করেন| বিজ্ঞানের শাণিত মননে বারবার নিজেকে সঞ্জীবিত করেছেন|

রবি ঠাকুর নিজে এক অনন্ত বিস্ময়, তাঁর সাহিত্য কীর্তির ব্যাপ্তি, গভীরতা, অসামান্য জীবনবোধ এমনকি বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁকে মহামানবের স্থান দিয়েছে আমাদের হৃদয় সিংহাসনে| একটি রবীন্দ্রসংগীতের প্রথমদুটি লাইনে বিজ্ঞানের অসামান্য প্রয়োগ মনে অদ্ভুত আনন্দের অনুভুতি দেয়- “তার অন্ত নাই গো, যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ , তাঁর অনু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ”

প্রথাগতভাবে রবীন্দ্রনাথকে ‘বিজ্ঞানী’ আখ্যা না দেওয়া গেলেও তাঁর যুক্তিবাদী মন, চিন্তাধারার দৃষ্টিভঙ্গি এবং কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত সন্ধানী আলোর দৃষ্টিকে একজন বিজ্ঞান অনুরাগী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে| তাই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রবি ঠাকুরকে বলেছিলেন, “তুমি যদি কবি না হইতে, তাহা হইলে শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হইতে পারিতে|”

শুধু বিজ্ঞানমনস্কতা বা সচেতনতা নয়, বিজ্ঞানের জগতেও অবাধ যাতায়াত ছিল| তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্রে তিনি বেশী পারদর্শী ছিলেন| রবি ঠাকুর তাঁর কিশোর বয়সেই আকাশ ভরা সূর্য তারা, গ্রহ নক্ষত্র সব চিনতে শিখেছিলেন| প্রায় ১২ বছর বয়েসে তাঁর বাবার সাথে ডালহৌসি পাহাড়ে গিয়ে তিনি আকাশের অলি গলি পাঠ নিতেন, তার বর্ণনা পাই:
“তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিষয় শুনিয়ে যেতেন|”

বিজ্ঞানের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আকর্ষণবোধ থেকেই অপার কৌতূহলে প্রবেশ করেছেন বিজ্ঞানের আঙিনায়| এক্কেবারে শৈশবে লিখেছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ – তাঁর কথায় “আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে|” একেবারে ছেলেবেলায় আবার জীবনের শেষ বেলাতে পৌঁছেও বিজ্ঞানকে ছাড়েননি, বিজ্ঞানের জয়গান গেয়েছেন| নিজেই লিখেছেন ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি যা জনগণকে বিজ্ঞানমুখী হতে উদ্বুদ্ধ করে| ১৯৩৭ সালে বিশ্বকবি তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি উত্‍সর্গ করেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে| উত্‍সর্গ পত্রে লেখেন, “এর মধ্যে এমন বিজ্ঞান সম্পদ নেই যা বিনা সঙ্কোচে তোমার হাতে দেবার যোগ্য| তাছাড়া অনধিকার প্রবেশে ভুলের আশঙ্কা করে লজ্জাবোধ করছি, হয়তো তোমার সম্মান রক্ষা করাই হল না| কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সামনে রেখে সাধ্যমতো নিড়ানি চালিয়েছি|”

আশ্চর্য গ্রন্থ এই ‘বিশ্বপরিচয়’ – মাতৃভাষাতে এমন দুরূহ জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যকে এত সাবলীলভাবে পরিস্ফুটন, – এমন দ্বিতীয় গ্রন্থ সম্ভবত বিরল| এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ধারণাকে কবি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা পাঠকের মনে গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে| এই গ্রন্থটি অনু পরমাণু ও এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি এমনকি মহাজাগতিক জ্ঞান ভাণ্ডারপূর্ণ| আসলে এই গ্রন্থটি আদ্যন্ত একটি বিজ্ঞান গ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ আজীবন বিজ্ঞান সম্পর্কে ভেবেছেন, আবার পড়েছেনও বিভিন্ন বই| ফলে তিনি সুনিশ্চিতভাবে পরিকল্পনামাফিক এই ‘বিশ্বপরিচয়’ লিখতে কলম ধরেছিলেন| তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন বিজ্ঞানসাধক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে: “আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য| কিন্তু বাল্য কাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না|”

আবার এই গ্রন্থটির ভূমিকার অন্য এক স্থানে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “বিজ্ঞান থেকে যাঁরা চিত্তের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা তপস্বী- মিষ্টান্নমিত- রেজনা:, আমি রস পাই মাত্র| সেটা গর্ব করার মতো কিছু নয়| কিন্তু মন খুশি হয়ে বলে,- যথালাভ|”
এই ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থ লেখার পেছনে রবি ঠাকুরের একটি মহৎ উদ্দেশ্য হোল– লোকশিক্ষা|এই উদ্দেশ্য থেকেই রবীন্দ্রনাথ কাব্য সাহিত্যের দরবার থেকে সোজা বিজ্ঞানের আঙিনায় তথা অন্তঃপুরে গিয়ে অনু-পরমাণুর অন্দরমহল, আকাশের অলিগলি, এমনি জ্যোতিষ্কদের সাথে সখ্যতা করেছিলেন| যার ফলস্বরূপ তিনি বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁছাতে পেরেছিলেন| তাঁর নিজের কথায়, “আমার দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে যদি কোন মনীষী, যিনি একধারে সাহিত্য রসিক ও বিজ্ঞানী, এই অত্যাবশ্যক কর্তব্যকর্মে নামেন, তাহলে আমার এই চেষ্টা চরিতার্থ হবে|”

প্রাচীন যুগে ভারতীয় দার্শনিক কণাদ এবং গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এর মতানুযায়ী পদার্থমাত্রেই অতি ক্ষুদ্রকণা দ্বারা গঠিত, এই ক্ষুদ্র কণিকার নাম ‘পরমাণু’ (কণাদ) বা Atom (ডেমোক্রিটাস) আবার ১৮০৮ সালে বিজ্ঞানী ডালটন নিয়ে আসেন ‘ডালটনের পরমানুবাদ’| পরে বিজ্ঞানী আভোগাড্রো ‘অনুবাদ’ সম্পর্কে ‘আভোগাড্রো প্রকল্প’ প্রকাশ করেন| এই ক্ষুদ্র ‘অনু’ ও ‘পরমাণু’ নিয়ে বিশ্বকবি তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে ‘পরমাণুলোক’ অধ্যায়ে বলেছেন, “একটা মাটির ঘর নিয়ে যদি পরখ করে বের করতে চাই তার গোড়াকার জিনিসটা কী, তাহলে পাওয়া যাবে ধুলোর কণা, যখন তাকে আর গুঁড়ো করা চলবে না, তখন বলব এই অতি সূক্ষ্ম ধুলোই আদিম মাটির ঘরের মালমসলা| তেমনি করেই মানুষ একদিন ভেবেছিল, বিশ্বের পদার্থগুলিকে ভাগ করতে করতে যখন এমন সূক্ষ্মে এসে ঠেকবে যে তাকে আর ভাগ করা যাবে না তখন সেইটিকেই বলব বিশ্বের আদিভূত, অর্থাৎ গোড়াকার সামগ্রী| আমাদের শাস্ত্রে তাকে বলে পরমাণু, য়ুরোপীয় শাস্ত্রে বলে অ্যাটম|” – এমন সহজ সরলভাবে একজন সাহিত্যিকের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিরল| এর আগে শ্রী শ্রীরাম পালিত চেষ্ঠা করেছিলেন ‘পরমাণু’ কে নিয়ে কবিতা লিখতে,
“ঈশ্বরের ইহা কিবা রচনা অদ্ভুত
পরমাণু দিয়া রচিলেন নানাভূত|
অনু এত সূক্ষ্ম হয়
ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য নয়
এমন সূক্ষ্মানু সূক্ষ্ম পরমাণু দিয়া
অনন্ত জগৎ সৃষ্টি কী অদ্ভুত ক্রিয়া”-
আমরা জানি, পরমাণু গঠনের তিনটি মূল কণা – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এবং রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষার্থীরা জানে এই কণাত্রয়ের আধান ও পরমানুগত অবস্থান| কিন্তু বিশ্বকবি তাঁর চিন্তা ভাবনাতে সুন্দরভাবে ব্যাখা করেছেন ‘পরমাণুলোক’ অধ্যায়ে-
“হাইড্রোজেন গ্যাসের পরমাণুলোকে দৃষ্টি দেওয়া যাক| এর চেয়ে হালকা গ্যাস আর নাই| এর পরমাণুকেন্দ্রে বিরাজ করছে একটিমাত্র বিদ্যুৎকণা, যাকে বলে প্রোটন, আর তার টানে বাঁধা পড়ে চারিদিকে ঘুরছে অন্য একটি কণিকা, যার নাম ইলেকট্রন|”

বিজ্ঞান মানে নিছক তথ্য নয়, অত্যন্ত শ্রম ও নিষ্ঠার সাথে বিশ্বকবি তথ্য সংগ্রহ করে তাতে নিজস্ব চিন্তার রূপ দিয়েছেন- তাঁর ডায়েরীর একটি পাতার নোট,
প্রোটন আঘাতে Trans Mutation 590
Other galaxies 602
কী উপায়ে নক্ষত্রের দূর যাওয়া কাছে আসা ধরা যায় 602
Milky Way 626
Earth’s internal rigidities 514

ডায়েরীর এই একটি পাতার তথ্য দেখেই বোঝা যায়, কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বপরিচয়’ এর ভূলোক, গ্রহলোক, পরমাণুলোক অতি ক্ষুদ্র (Micro) এবং অতি বৃহৎ (Macro), সৌরজগত কিংবা নক্ষত্রলোক রচনায় বিশ্বের নানা তথ্য ও তত্ত্বের সমাবেশের সমন্বয় ঘটাতে|

‘বিশ্বপরিচয়’ লেখার আগেও বিজ্ঞান চেতনার সুদক্ষ চিন্তাভাবনা রবীন্দ্রনাথের কৈশোর বেলা থেকেই লক্ষ্যনীয়| ‘মনোগণিত’ প্রবন্ধে অঙ্ক কী, তা সম্বন্ধে রবী ঠাকুর একটি সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন, “ঈশ্বর মর্তভূমির অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে মনুষ্য নামক কতগুলি সংখ্যা দিয়াছেন ও পূর্ণ সুখ (যাহার আর এক নাম মঙ্গল) নামক অঙ্কফল দিয়াছেন এবং পৃথিবীর পত্রে এই অঙ্কফলটি কষিবার আদেশ দিয়েছেন| সে যুগ যুগান্তর ধরিয়া এই নিতান্ত দুরূহ অঙ্কটি কষিয়া আসিতেছে, এখনো কষা ফুরোয়নি, কবে ফুরাইবে কে জানে!”- এই ‘!’ চিহ্নটির মধ্যেই বলতে চেয়েছেন, অঙ্ককষা কোনদিনই ফুরোবে না|
(দ্বিতীয় ভাগ: মঙ্গলবার, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২০)

রচনাসূত্র (Reference):
১) প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ : বিজ্ঞান চেতনার আলোকে, সাধন চট্টোপাধ্যায় (বাঙালীর বিজ্ঞানচর্চা-প্রাক স্বাধীনতা পর্ব)
২) রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা, রণতোষ চক্রবর্তী (উদ্বোধন-১২২)
৩) বিশ্বকবির রসায়ন ভাবনা, রবীন্দ্রনাথ পাত্র (কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান-২০১০)
৪) পরমাণুজগৎ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫) ছবি: আন্তর্জাল (Internet)

RELATED ARTICLES

Most Popular