Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা -৪ ।। অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ক্রান্তিকালের মনীষা -৪ ।। অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু: হৃদয়ে সাহিত্য চেতনায় বিজ্ঞান-৩
অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

(বিজ্ঞানী জগদীশের সংগোপন সাহিত্য অভিসার)                                         জগদীশচন্দ্র বসুর নাম আমাদের কাছে এলেই মনে পড়ে যায় বিখ্যাত সেই বাঙালি বিজ্ঞানীকে, যিনি ‘গাছেরও মন খারাপ হয়, আসে অবসাদ’ কথাগুলি প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন সারা বিশ্বের কাছে। বিজ্ঞানের একজন ছাত্র ও সাধক তো ও উনি ছিলেনই, তার সাথে সংগোপনে ছিলো তার একটি লেখকস্বত্বা। কবিত্বশক্তি ও সাহিত্যর রসবোধের মেলবন্ধনও লুকিয়েছিল তাঁর মনের মধ্যে যা আমরা তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে দেখতে পাই। প্রখ্যাত এই তরুণ বিজ্ঞানী একাধারে পদার্থবিজ্ঞান, জৈবপদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, বাংলাসাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব আবার ফোটোগ্রাফি এমনকি বাংলা সাইন্স ফিকশন নিয়ে ও অবদান রেখেগেছেন। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাগ্রন্থ ‘অব্যক্ত’ আজও বাংলা সাহিত্যের  জগতে একটি অনবদ্য গ্রন্থনা, বিশিষ্ট সংযোজন।

‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের লেখাগুলি বিজ্ঞান ও সাহিত্যের একটি অপূর্ব মেলবন্ধন।  ডঃ দ্বিজেনশর্মার মতে, “আমার ধারণায় বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় গ্রন্থ তাঁর এই বই।” ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের উপরে একটাই প্রভাব ফেলেছিল যে বন্ধুবর জগদীশচন্দ্রকে কবিগুরু লেখেন: “তোমার ‘অব্যক্তে’র বহু লেখাই আমার পূর্ব পরিচিত। এগুলি পড়িয়া বারবার ভরিয়াছি। যদিও বিজ্ঞানবাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরাণী করিয়াছ, তবুও সাহিত্য সরস্বতী যে পদের দাবি করিতে পারিত, কেবল তোমার অনবধানেই সে অনাদৃত হইয়া আছে।” রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিটির তাৎপর্য যে কত গভীর তা প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে। জগদীশচন্দ্রের এই ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটিতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে মোট নিবন্ধের সংখ্যা ২১।

বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্যে যে আচার্যের অবাধ বিচরণ ছিল তা এই ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটির  ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ প্রমান পাওয়া যায়। এই রচনাটির একটি অদ্ভুত কাব্যময় চিত্রিত রূপ প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে। ভাগীরথী আমাদের গঙ্গা নদীর একটি ধারা। জগদীশচন্দ্র এই নদীর উৎপত্তি, গতিপথ এবং সমুদ্রে মিলিত হওয়া সুন্দরভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি  অবলীলাক্রমে সাহিত্যে বিজ্ঞান-ভূগোলকে ছন্দবদ্ধ, সুসংগঠিত ভাবে চিত্রিত করেছেন।  নদীর স্রোত প্রবাহের মতোই গতিশীল তরঙ্গায়িত তাঁর অনির্বচনীয় লেখনী। লেখক জগদীশচন্দ্রের অকপট স্বীকারোক্তি, “বাল্যকাল হইতেই নদীর সহিত আমার সখ্য জন্মিয়াছিল।” আচার্য শৈশবেই জেনেছিলেন যে মহদেবের জটা থেকেই নদীর উৎপত্তি সেই বিশ্বাসই যেন পরিণতি লাভ করেছিল এই নিবন্ধটিতে বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে মেলবন্ধনে। আচার্যের নিজের উক্তিতে, “নদীকে আমার একটি গতি পরিবর্তনশীল জীব বলিয়া মনে হইত।”

নদীর মতোই পাঞ্জল আচার্যের লেখনী। তাঁর একান্ত অনুভূতি এই নদীকে নিয়ে, একান্ত সখ্যতায় আলাপচারিতা তাঁর লেখনীতে গতিশীলতা আনে, “সন্ধ্যা হইলেই একাকী নদীতীরে আসিয়া বসিতাম, ছোট ছোট তরঙ্গগুলি তীরভূমিতে আছড়াইয়া পড়িয়া কুলুকুলু গীত গাহিয়া অবিশ্রান্ত চলিয়া যাইত……এই যে অজস্র জলধারা প্রতিদিন চলিয়া যাইতেছে ইহা তো কখনো ফিরে না; তবে এই অনন্ত স্রোত কোথা হইতে আসিয়াছে?” কী অনির্বচনীয় বর্ণনা, কী গভীর অনুভূতি, কী সংবেদনশীল মননের অধিকারী এই বৈজ্ঞানিক সাহিত্যেক যিনি প্রাকৃতিক নিয়মে বয়ে চলা নদীর রূপবর্ণনায় নিজের সুকুমার সংবেদনশীল কবিত্বশক্তির পরিচয় দিলেন। সখাসম নদীকে নিজেই প্রশ্ন করেন বারবার, “তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? নদী উত্তর করিত “মহাদেবের জটা হইতে।”

বিশ্বখ্যাত এই তরুণ বৈজ্ঞানিক আপন মনেই যেন বলেন, পরে বড় হয়ে, নদীর উৎপত্তি সম্বন্ধে তিনি অনেক ব্যাখ্যা শুনলেও যখনই তিনি নদীতীরে শ্রান্ত মনে বসে নদীর বহমানতা রূপ কুলুকুলুধ্বনি শুনতেন- তখনও তাঁর মনে পড়ত, ‘মহাদেবের জটা হইতে’ নদীর উৎপত্তি। আশ্চর্য জনক ভাবে এই তরুণ বৈজ্ঞানিক তাঁর শৈশবের ধারণাকে বারবার ফিরিয়ে এনেছেন নিজের চিন্তায়, আবার বিস্মিত হয়ে দেখেছেন নদীতীরে প্রিয়জনের পার্থিব অবশেষকে বিলীন হয়ে যেতে। নদী তার আপন ছন্দে বয়ে চলে যায়, যে স্রোত বয়ে যায় তা আর ফিরেও আসে না! নদী যেন আচার্যের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়- “আমরা যথা হইতে আসি, আবার তথায় ফিরিয়া যাই।”

এই যে দার্শনিক ঋষিতুল্য তরুণ বৈজ্ঞানিকের অন্তর্দৃষ্টি যা জড়, জীব যুক্ত এই ব্রহ্মাণ্ডকে একই সূত্রে প্রোথিত করে, তা তাঁর লেখার মধ্যেও আধ্যাত্বিক সৌরভময় স্পর্শ দিয়ে যায়। তাই আচার্যের নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন, “বৈজ্ঞানিক ও কবি উভয়েই অনুভূতি অনির্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না।”   কঠোপনিষধে রয়েছে,
“শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতস্তৌ
সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ।
শ্রেয়োহি ধীরভিপ্রেয়সো বৃনতে
প্রেয়ো মন্দো যোগক্ষেমাদ বৃণীতে।”

অর্থাৎ আমাদের কাছে রয়েছে দুটি জিনিস প্রেয় এবং শ্রেয়। যদি আমরা আমাদের প্রেয়কে গ্রহণ করি তবে আমরা আপাতসুখের সন্ধান পাব কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারা সবসময় শ্রেয় কেই বরণ করেন। বিজ্ঞান সাধক আচার্য জগদীশচন্দ্র প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু বৈজ্ঞানিক সাহিত্যিক শ্রেয়কেই বরণ করেন। আচার্য বিজ্ঞান সাহিত্য রচনার অনুপম নিদর্শন হল ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটি। না বলা কথা, না দেখতে পাওয়া বা অদৃশ্য আলোকস্পর্শ, না শোনা অনেক কিছু যা আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয় তা সবিস্তারে বর্ণনার ঘনঘটায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে আচার্যের কলমে ‘অব্যক্ত’ হয়ে। তিনি বিজ্ঞান সাধনায় যেমন তেমনি সাহিত্য চেতনায় ও প্রকৃতির না বলা ভাষাকে বাগ্ময় করে তুলেছেন।

আচার্য আমার চেতনায় এক অসীম ব্রহ্মাণ্ড যিনি তার অপরিসীম দক্ষতায় সাহিত্যেও নিজস্ব গতিময়তা সাবলীলভাবে অনায়াসে বিচরণ করেছেন। অব্যক্ত গ্রন্থে মোট বিজ্ঞান বিষয়ক সাতটি রচনা, সাহিত্য রচনা ছয়টি, কল্পবিজ্ঞানের গল্প একটি এবং বক্তৃতা সাতটি রয়েছে। প্রথম নিবন্ধটি হল ‘যুক্তকর’। আচার্যের লেখা ‘মৃত্যুর সাড়া’ একটি আলোড়ন জাগানো সাহিত্য সৃষ্টি। উদ্ভিদ অন্তিম লগ্নের মুহূর্তগুলি যে অসীম মমত্ববোধে বর্ণনা দিয়েছেন তা আশ্চর্য জাগায় মনে। ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটির কথারম্ভে আচার্য অনুভূতি বিস্ময় জাগায়, “ভিতর ও বাহিরের উত্তেজনায় জীব কখনও কলরব কখনও আর্তনাদ করিয়া থাকে।মানুষ মাতৃকোড়ে যে ভাষা শিক্ষা করে সেই ভাষাতেই সে আপনার সুখ দুঃখ জ্ঞাপন করে।” আবার ‘পলাতক তুফান’ (বৈজ্ঞানিক রহস্য) গল্পটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘সায়েন্স ফিকশন’ গল্প হিসেবে বা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসাবে ধরা হয়।

১৮৯৬ সালে আচার্য ‘নিরুদ্দেশ কাহিনী’ (The Story of Missing One) গল্পটি লেখেন। এই গল্পটি ১৮৯৬ সালে ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ নামে গল্প প্রতিযোগিতার জন্য রচিত এবং এটি পুরস্কার বিজয়ী গল্প। পরে এই গল্পটিকে আরো বড়ো করে ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থে ‘পলাতক তুফান’ নামে সংকলিত করা হয় ।এই গল্পটিতে রয়েছে সমুদ্র যাত্রায় উত্তাল তরঙ্গ লহরীকে কিভাবে এক শিশি কুন্তলকেশরি তেল ফেলে শান্ত করা হয়েছিল। তেলের প্রভাব জলরাশির পৃষ্ঠাটান বা Surface Tension বদলে দেয় পদার্থবিদ্যার এই তত্বের প্রয়োগ করেই এই অসাধারণ কল্পবিজ্ঞানের গল্পটি লেখা হয়েছিল। আবার ‘স্নায়ু সূত্রে উত্তেজনা প্রবাহ’ নিবন্ধটিতে বাইরের শক্তি ও ভেতরের শক্তির প্রকৃত রূপ বর্ণনা করেন:
“জন্মিবার সময় ক্ষুদ্র ও অসহায় হইয়া শক্তি সাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলাম। তখন বাহিরের শক্তিভেতরে প্রবেশ করিয়া আমার শরীর ললিত ও বর্ধিত করিয়াছে। মাতৃস্তন্যের সহিত স্নেহ- মায়া মমতা অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে এবং বন্ধুজনের প্রেমের দ্বারা জীবন উৎফুল্ল হইয়াছে। দুর্দিন ও বাহিরের আঘাতের ফলে ভেতরের শক্তি সঞ্চিত হইয়াছে এবং তাহারই বলে বাহিরের সহিত যুঝিতে সক্ষম হইয়াছি। আচার্য রচিত ‘নির্বাক জীবন’ এক অনবদ্য স্পর্শকাতর বিজ্ঞানসাহিত্যের মিলন রচনা। এখানে উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরণের সংবেদনশীলতা নিয়ে রচনাটি সমৃদ্ধ।

তাঁর নিজের কথায়: “গাছের  প্রকৃত ইতিহাস সমুদ্ধার করিতে হইলে গাছের নিকটই যাইতে হইবে। সেই ইতিহাস অতি জটিল এবং বহু রহস্যপূর্ণ। সেই ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইলে বৃক্ষ ও যন্ত্রের সাহায্যে জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত মুহূর্তে মুহূর্তে তাহার ক্রিয়াকলাপ লিপিবদ্ধ করিতে হইবে।” আবার “আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ” নিবন্ধে তিনি একটি প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছেন। বিশ্বখ্যাত তরুণ বৈজ্ঞানিকের জিজ্ঞাসা এই নিবন্ধের শেষভাগে, “অধিক বিস্ময়কর কাহাকে বলিব? বিশ্বের অসীমতা, কিম্বা এই সসীম ক্ষুদ্র বিন্দুতে অসীম ধারণা করিবার প্রয়োগ কোনটা অধিক বিস্ময়কর?”

আবার তিনি নিজেই অনুধাবন করেন:
“এ জগতের আরম্ভও নাই, শেষও নাই। এখন দেখিতেছি এ জগতে ক্ষুদ্রও নাই, বৃহৎও নাই।” আচার্য বিশ্বাস করেন প্রকৃতির নিয়মের সাথে মানুষের জ্ঞানের সহযোগিতা আছে। বিস্মিত হতে হয় এই সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিকের মননশীলতা, দায়িত্ববোধ ও আদর্শ শিক্ষক
হিসাবে তার আহ্বান কে,“বড়োলোকের কথাতেই অভ্রান্ত সত্য ধরিয়া লইতে শিক্ষা দেওয়ার মতো অনিষ্ট নাই। বিদ্যার্থীকে নিজে সত্য আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করাই আচার্যের প্রধান কর্ত্যব্য।” তিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষের দুর্বহ ভার লাঘব করা। বিশ্বকবি এই তরুণ বৈজ্ঞানিকের গুনমুগধ হয়ে লিখেগেছেন ‘শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু করকমলে’:

“হে তপস্বী, তুমি একমনা
নিঃশব্দেরে বাক্য দিলে; অরণ্যের অন্তর বেদনা
শুনেছ একান্তে বসি; মূক জীবনের যে ক্রন্দন
ধরণীর মাতৃবক্ষে নিরন্তর জানাল স্পন্দন।”এই একনিষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানী সাহিত্যিক সারাজীবন পদক্ষেপ করেছেন সত্যনিষ্ঠার সাথে তাঁর সৃজনশীলতা। তাঁর আত্মত্যাগ এবং নিরলস পরিশ্রমের সুদৃঢ় ভিতের উপর আজকের আধুনিক বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণার সৃজনশীলতা ও সুললিত সাহিত্য প্রীতি আমাদের জীবনের আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ- তাই আজও তাঁর চরণে নিবেদন:                             “অসতো মা সদ্ গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।”
“অসত্য হইতে মোরে সত্যে লইয়া যাও
আঁধার হইতে মোরে আলোকে লইয়া যাও
মরণ হইতে মোরে অমৃতে লইয়া যাও।”

রচনা সূত্র (Reference): প্রকাশিত পর্ব-১ এ বিস্তারিত দেওয়া আছে।

RELATED ARTICLES

Most Popular