Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-১৫ ।। রাজা রামমোহন রায়, নবযুগের কান্ডারী।। বিনোদ মন্ডল

ক্রান্তিকালের মনীষা-১৫ ।। রাজা রামমোহন রায়, নবযুগের কান্ডারী।। বিনোদ মন্ডল

রাজা রামমোহন রায়, নবযুগের কান্ডারী                                                            বিনোদ মন্ডল           কুলীন ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম। খাঁটি বৈষ্ণব পরিবার। মা শাক্ত বংশ থেকে এসেছেন। বাড়ীর কুল দেবী রাজরাজেশ্বরী। এহেন বাড়ীর ছেলে কৈশোরেই বেঁকে বসল। পুতুল পুজোয় সায় নেই। বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে দিলে বাড়ির মধ্যে। রামমোহনকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কাশী। ১৫/১৬ বছর বয়সে। ( জন্ম ২২.৫.১৭৭২/৭৪, প্রয়াণ- ২৭.৯.১৮৩৩) এবার সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য মন্থন করলেন। কন্ঠস্থ করলেন বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ। মাথা হলো আরো পরিষ্কার। ভাষা হল আরও শাণিত— ‘ শান্তম্, শিবম্, অদ্বৈতম্।’ বারাণসী নদীঘাটে (সম্ভবত হরিশচন্দ্র ঘাট মণিকর্ণিকা নয়) প্রথম সামনে থেকে হিন্দুর বিধবা কিশোরীকে চিতায় তোলা দেখলেন। তার কান্না মর্মে গেঁথে যায় রামমোহনের।

চরিত্র গঠনে কাশীর পর ভূমিকা পালন করেছে পাটনা। এখানে থেকেছেন, চর্চা করেছেন–আরবি এবং পারসি। এছাড়া নেপাল-ভুটানের বিস্তীর্ণ জনজীবন পদব্রজে ঘুরে দেখেছেন। ১৮৩০-এর ১৯ নভেম্বর কলকাতা থেকে রওনা দেন, ৮ই এপ্রিল,১৮৩১ লিভারপুলে পৌঁছান। বাকি জীবন বিলেতে কাটান। খরচ যোগান প্রিন্স দ্বারকানাথ।               মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে পাঠান বটে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি মত অর্থসাহায্য করেননি। মাঝে ১৮৩২-এ শিল্প-সংস্কৃতির শহর প্যারিস যান। ১৮৩৩-এ মেনিনজাইটিস রোগে প্রয়াত হন। অত্যধিক পরিশ্রমের ধকল শরীর নিতে পারেনি।

বারাণসী থেকে দেশে, মানে হুগলী জেলার খানাকুলে, বাবার জমিদারিতে ফিরে এলেও সংঘাত এড়াতে পারেন না। পৌত্তলিকতা, ধর্মের আচারসর্বস্বতা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে মনান্তর হয়। পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন কলকাতায়। সালটা ১৮১৫। সালটা ধরে রাখে সময়কে, তাই জানা দরকার। ভাগ্য দেবীর বদান্যতায় এবং ডিগবি সাহেবের সহায়তায় পেশাজীবনে সাফল্যের মুখ দেখেন। রংপুরের দেওয়ান হিসেবে ইতিমধ্যে (১৮০৩-১৮১৪) সাড়া ফেলে দিয়েছেন চতুর্দিকে। ১৭৯৯ সালেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে কঠোর সেন্সরশিপ আরোপের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন।

কোরান ও বাইবেল এবং হিন্দু শাস্ত্র মন্হনের পরে ধর্মীয় কুসংস্কার, গোঁড়ামি কাটিয়ে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। গঙ্গাসাগরে মানত করা সন্তান বিসর্জন দেওয়া, বাল্যবিবাহ রদ, বহুবিবাহ রদ, অস্পৃশ্যতা নারী-পুরুষের বৈষম্য, বিষয়-সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে উচ্চকিত হন। সমাজপতি ও জমিদার রাধাকান্ত দেব বিরোধিতা করেছেন। পন্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার মানসিক সম্মতি জানালেও প্রকাশ্যে পাশে থাকেননি। প্রিন্স দ্বারকানাথ সহ কয়েকজন মিলে এইসব বিষয়ে আলোচনার প্লাটফর্ম চালু করেন। নাম দেন আত্মীয় সভা। প্রতি সপ্তাহে এই সভার সদস্যরা মিলিত হতেন এবং ধর্ম ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে পথ অনুসন্ধান ও কর্মসূচি রূপায়ণ করতেন। যার পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মসমাজ (২০.০৮.১৮২৮)। এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মার উপাসনাকেন্দ্র ।

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে রামমোহনের হাত ধরে বাঙালি সম্পাদিত ও পরিচালিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘সংবাদ কৌমুদী’ পথ চলা শুরু করে। ধারাবাহিক দশ বছর ( বিলেত যাওয়ার আগে পর্যন্ত) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি সরাসরি একটি ফারসি কাগজ প্রকাশ করেন, মিরাত- উল-আকবর (১৮২২) এবং ব্রাহ্মণ সেবধি ও ব্রাহ্মনিক্যাল। এছাড়াও সেকালের আরও পাঁচটি কাগজের মেন্টর ছিলেন তিনি। সেকালে বুঝেছিলেন জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা। জেদের বশে নিজেই সেকেন্ডহ্যান্ড প্রেস কিনে পত্রিকা ছেপে বিনামূল্যে বিতরণ করতেন।

এর ফল কী হল? বাঙালি পেল ফরাসি বিপ্লবের খবর। কোম্পানি রাজের সীমাবদ্ধতা জানতে পারল। শুরু হল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। তিনি প্রথম রিফর্ম বিল এনে বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মানুষকে অধিকার সচেতন করতে চেয়েছিলেন। বাঙালির তথা ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের হাতে খড়ি দিয়েছেন রামমোহন।

এটা জাতীয়তাবাদ নয়, আধুনিক চেতনার প্রসার। তিনি প্রথম ভাষা সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ত্রিবেণী সংস্কার চেয়েছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে অনলস ছিলেন। যখনই শিক্ষাঙ্গনের প্রশ্ন এসেছে, তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এজন্য পুস্তক পুস্তিকা রচনা করেছেন। প্রকাশিত পুস্তক পুস্তিকার সংখ্যা ৭০। শুধু তাই নয়, সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেন তিনি। বাংলা গদ্যের বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা তাঁর। তিনি যদি পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতেন, তাহলেও মিরাকেল ঘটত, সন্দেহ নেই।

সতীদাহ প্রথা রদে লর্ড বেন্টিংকের কাছে সাহসের সাথে দাঁড়ান তিনি। বারাণসীর ঘটনা ছাড়াও ব্যক্তি জীবনে এক দাদার মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় বৌদিকে সহমরণে যেতে হয়। এ ঘটনা তাঁকে পীড়িত করে। কথিত আছে একদিন এক বালবিধবা স্বামীর চিতায় ওঠার প্রাক্ মুহূর্তে দৌড় দেয়। এসে রামমোহনের স্ত্রীর কাছে প্রাণ ভিক্ষা করে। তাকে রক্ষা করেন রামমোহন। এজন্য তিনি ধর্মপত্নী উমার কাছে চির কৃতজ্ঞ থেকেছেন। উমাই তাঁকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সৎকর্মের প্রতি প্রণোদিত করেছিলেন বলে।

সেকালের বিখ্যাত চিত্রকর এইচ.পি. ব্রিগস রামমোহনকে সামনে বসিয়ে তাঁর ছবি আঁকেন, যা আজও ব্রিস্টলে যাদুঘরে সংরক্ষিত। এই ছবির বিশেষত্ব হল— ক্যানভাসে একটি মন্দির ও মসজিদের ছবি।সামনে রামমোহন, হাতে বাইবেল।
২০২০ তে ইতিহাসের আরেক বাঁকে যখন রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর স্বপ্নের দেশে, তখন রামমোহনকে চাই।আর একবার। অনিবার্য এই চাওয়া!

রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, ‘মানুষের ঐক্যের বার্তা রামমোহন রায় একদিন ভারতের বাণীতেই ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁর দেশবাসী তাঁকে তিরস্কৃত করেছিল– তিনি সকল প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রণ করেছিলেন মুসলমানকে, খৃস্টানকে, ভারতের সর্বজনকে হিন্দুর এক পংক্তিতে ভারতের মহা অতিথিশালায়।’ (চারিত্রপূজা)

RELATED ARTICLES

Most Popular