Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-৩৬, পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ: বিনোদ মন্ডল

ক্রান্তিকালের মনীষা-৩৬, পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ: বিনোদ মন্ডল

পরিব্রাজক  রবীন্দ্রনাথ                                                                               বিনোদ মন্ডল

সিপাহী বিপ্লব উত্তর ভারতবর্ষ যখন রামমোহন, বিদ্যাসাগর- এর ধর্ম- সংস্কার, শিক্ষা- সংস্কার আন্দোলনের ফলে নবজাগরণের পথে স্বপ্ন- উড়ান শুরু করেছে, তখন বঙ্কিমচন্দ্র — শিশু-বাংলা সাহিত্যকে তারুণ্য দীপ্তি প্রদান করলেন। শুধু এঁরা নন, সঙ্গে একদল জ্যোতিষ্ক । সমগ্র ঊনবিংশ শতক জুড়ে আধুনিকতার ইতিহাসকে লালন করেছে সমবেত উদ্যোগ। এই ধারায় নবজাগরণকে পূর্ণতা দান করতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)।

তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর দীর্ঘদিন বিলেতে কাটিয়েছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতিকে উন্মুক্ত চোখে দেখে, উপলব্ধি করে – এদেশে তাঁর আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তা ধারাকে প্রসারিত করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখেছেন – “আমাদের পরিবার আমার জন্মের পূর্বে সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধাঘাটের বাইরে এসে ভিড়েছিল।” বাস্তবিক দ্বারকানাথ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের এক দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন এদেশের প্রথম আই সি এস। তিনিও নিজের পরিবারে তথা কলকাতায় বিলেতিয়ানার বাতাস প্রবাহিত করেছেন, সযত্নে। সেই ধারায়, রবীন্দ্রনাথ যেন সাহিত্য – সমাজ – সংস্কৃতি – শিক্ষা ও প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনকে মন্থন করে নতুন যুগের প্রবর্তন করেছেন। নিজেই একটি যুগের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন।

কবি তাঁর কবিতায় লিখেছেন – “পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার/সেথা হতে সবে আনে উপহার/দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে……”। তিনি তাঁর লেখায়, কথায়, চিন্তায় এইযে বিশ্বমানবতার ভাবনাকে মূর্ত করেছেন, তা সম্ভব হয়েছিল বারেবারে ইউরোপ আমেরিকা শহর ও গ্রাম পরিভ্রমণের ফলে। তাঁর অশীতিপর জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি বিশ্বভ্রমণ করেছেন। যার ফলে মুক্তমন উদার প্রসন্ন মানবতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি।

১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কবির মা সারদা দেবী প্রয়াত হন। ফলে সকলের আদরে আহ্লাদে একা একা মনের আনন্দে ঘুরতেন ঘরে। স্কুলে যেতেন না প্রায়শই। শাসনের বালাই ছিল না। পড়াশোনা না করায় বছরের শেষে তিনি পাস করতে পারলেন না। প্রিপারেটরি এন্ট্রান্স ফিফথ্ স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত পড়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। এমন সময় বাড়ির সিদ্ধান্ত হল, বিলেত যাবে রবি, ব্যারিস্টারি পাস করবে। তাই ইংরেজিতে দক্ষ করার লক্ষ্যে আমেদাবাদে সত্যেন্দ্রনাথের কাছে এবং তারপর বোম্বাইতে তার বন্ধু পান্ডুরঙ্গের (সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু) বাড়িতে অতিথি হয়ে যান। বিলেতে সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু তারকানাথ পালিতের উদ্যোগে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন তিনি। দীর্ঘ ছুটি নিয়ে দাদাও সপরিবারে যান বিলেতে। দেড় বছর সেখানে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রী না নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। পিতার নির্দেশে।

প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না পেলেও তাঁর প্রথম বিদেশ যাত্রা বিফল হয়নি। কবির ভাষায় – “আমার বিদেশের শিক্ষা প্রায় সমস্ত তাই মানুষের ছোঁওয়া লেগে। বিলেত গেলেম ব্যারিস্টার হইনি। জীবনের গোড়াকার কাঠামোকে নাড়া দেবার মতো ধাক্কা পাইনি। নিজের মধ্যে নিয়েছি পূর্ব-পশ্চিমের হাত মেলানো। আমার নামটার মানে পেয়েছি প্রাণের মধ্যে”। সবচেয়ে বড়কথা কবির চরিত্রে এল পরিবর্তন। লাজুক, নম্র, শান্ত অন্তর্মুখী মানুষটি হয়ে উঠলেন অনেক বেশি সামাজিক, মিশুকে, দিলখোলা। চেহারায় এল তারুণ্যের দীপ্তি। বেশভূষায় এল পরিপাটি। দেশে ফিরে সান্নিধ্য পেলেন বৌদি কাদম্বরী দেবীর।

১৮৯০ এর আগস্টে দ্বিতীয়বার হঠাৎ সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়ে বিলাত যান কবি। সেখানে এক মাস থাকেনও। কোনো কারণ ছাড়াই ফিরেও আসেন সহসা। এরপর দীর্ঘদিন কেটে যায়। ১৯১২ সাল নাগাদ বিলেত যান কবি। ততদিনে স্ত্রী ও পিতাকে হারিয়েছেন। সঙ্গে গেলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। এই পর্বে পূর্বপরিচিত রোদেনস্টাইনের সাথে দেখা হল। তাঁর মাধ্যমে ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথের সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ঘটে। কবির ‘সংস অফারিংস’ পড়ে মুগ্ধ হন তিনি। ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে তা প্রকাশের ব্যবস্থা হয়। মুখবন্ধ লেখেন ইয়েটস্। ইংল্যান্ডে চার মাস কাটিয়ে যান আমেরিকায়। সপরিবারে। নিউইয়র্ক, আর্বানা, শিকাগো, রচেস্টার প্রভৃতি শহর ও পল্লীগ্রামে কাটান। নানা সম্মেলনে ভাষণ দেন। পরে ১৯১৩ সালের জুনে লন্ডনে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে অস্ত্রোপচার হয় কবির। অর্শমুক্তির আশায়।

১৯১৬ সালে বহু দিনের ইচ্ছে ফলবতী হলো কবির। ততদিনে খ্যাতির মধ্যগগনে তিনি। প্রাচ্যের প্রথম নোবেল লরিয়েট। মে মাসে জাপান যাত্রা করলেন। কলকাতা থেকে জাহাজে। রেঙ্গুন, পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং প্রভৃতি শহর ছুঁয়ে ২৬ দিনের মাথায় কবি জাপানের কোবে বন্দরে উপস্থিত হন। সেখান থেকে ওসাকায়। প্রথম ভাষণ দেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিন মাস পর ১৯১৭ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর আমেরিকা যাত্রা করেন। নানা শহরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। দুমাস একনাগাড়ে ভাষণও দেন। হঠাৎ কবিমন বিদ্রোহ করে। বহু টাকা লোকসান সত্বেও চুক্তি ভঙ্গ করে দেশে ফিরে আসেন।

এরপর আবার ১৯২০ সালের ৫ জুন ইংল্যান্ডের বন্দরে পদার্পণ হয় কবির। তখন বিশ্বযুদ্ধ শেষ। তবে তাঁর সঙ্গে সাহেবদের সম্পর্কে শিথিলতা এসেছে। তিনি যে জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনায় ‘স্যার’খেতাব ত্যাগ করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ তাঁরা। কবি গেলেন ফ্রান্সে, নেদারল্যান্ডে, বেলজিয়ামে। সেখান থেকে আবার আমেরিকা। এসেছিলেন বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে। তা তেমন পূরণ হলো কই? আবার ফিরলেন ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে প্যারিসে। দেখা হলো রোমাঁ রঁল্যার সাথে। একে একে সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে কাটিয়ে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে দেশে ফেরেন কবি।

এরপর কবির বিদেশ ভ্রমণের লগ্ন ১৯২৪। প্রথমে গেলেন চীন। জলপথে। চীন দেশের সারস্বত সমাজ তাঁকে উদার হৃদয়ে ‘চু-চেন-তান’ বা ‘ মেঘমন্দ্রিত প্রভাত’ উপাধিতে ভূষিত করল। ২১ জুলাই দেশে ফিরলেন। রওনা দেন ২১ মার্চ। কিন্তু পায়ে যে সরষে দেওয়া। ডাক এলো পেরু থেকে। লাতিন আমেরিকার আকর্ষণ এড়াবেন কী করে?তবে অসুস্থতার জন্য পেরু যাওয়া হলো না। কিছুদিন আর্জেন্টিনায় থাকলেন। এখানে পেলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। সেখান থেকে ইতালির জেনোয়া শহরে গেলেন। শরীর তখনও পুরো সেরে উঠেনি। ফলে পাঁচ মাস বিদেশে কাটিয়ে ১৯২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার জন্য ভেনিস থেকে জাহাজে চললেন। ১৯২৬ এ পরের বছরই আবার কবি ইউরোপ যাত্রা করেন। এবার ইতালি, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া হয়ে গ্রীস। সেখান থেকে মিশরের কায়রো হয়ে দেশে ফেরেন ১৯২৬ সালের ১লা ডিসেম্বর। দেশে মানে তাঁর শান্তিনিকেতনে।

মাস ছয়েক কাটলো না, ডাক এলো বিশ্বের আঙিনা থেকে। ১৯২৭ সালের ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর। সেখান থেকে মালয়, যবদ্বীপ, বালি, জাভা ঘুরলেন। দেখলেন বরোবুদুর মন্দির। তারপর শ্যামদেশ। এখানেই জাহাজে বসে লেখেন ‘সাগরিকা’ কবিতা। সাড়ে তিন মাস পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ করেন কবি। ফেরেন ১৯২৭ সালের ২৭ অক্টোবর। তাঁর জাভা ভ্রমণের ফলশ্রুতিতে বাটিক প্রিন্টের প্রবর্তন হয় এদেশে। যা আজ ভীষণ জনপ্রিয়। মাঝখানে একবার কলম্বো ঘুরে এলেন, পন্ডিচেরী হয়ে। ১৯২৯ এ টোকিও হয়ে কানাডা রওনা দেন। সেখান থেকে ফিরে জাপানে কাটান মাসখানেক। তারপর ইন্দোনেশিয়ার সায়গণ শহরে দিন তিনেক কাটিয়ে কবি দেশে ফিরে আসেন।

পরের বছরই কবি আবার গেলেন ইউরোপ। তিনি তখন ব্যস্ত। তিনি তখন সত্যিকারের বিশ্ব নাগরিক। প্রথমে গেলেন ফ্রান্স। সেখান থেকে ইংল্যান্ড, জার্মানি। জার্মানিতে দেখা হলো আইনস্টাইনের সাথে। সেখান থেকে সুইজারল্যান্ড। তারপর বহু আকাঙ্ক্ষিত মস্কো। সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের পর কবি বার্লিন হয়ে পাড়ি জমালেন আবার আমেরিকায়। যদিও অর্থলাভের তেমন সুযোগ হল না। তাঁর যে অনেক টাকা চাই শান্তিনিকেতন এর জন্য। কবি ফিরে গেলেন লন্ডনে। সেখানে তখন ভারতের ব্যাপারে গোলটেবিল বৈঠক চলছে। কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা করে সমঝোতার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষে নেতাদের মগজ দূষণ শুরু হয়ে যেতে দেখে রাজনীতি থেকে নিজেকে সাবধানে সরিয়ে নেন কবি। ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে।

১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারীতে পারস্য শহর ভ্রমণের আমন্ত্রণ পান কবি। এই প্রথম উড়োজাহাজে চেপে বিদেশে পাড়ি দেন কবি। সঙ্গী প্রতিমা দেবী ও অমিয় চক্রবর্তী। বুশায়ার শহরে বিমান যাত্রা শেষ। এবার তেহরান হয়ে সিরাজ গেলেন। তারপর ইস্পাহান। সেখানে আনন্দে অনুষ্ঠানে কিছুকাল কাটিয়ে মোটরে চেপে ইরাক সীমান্তে যান কবি। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে বাগদাদ। বিপুল সংবর্ধনা লাভ করলেন। মরুপ্রান্তরের বেদুইন জীবনের স্বাদ নিতে চলে গেলেন প্রত্যন্ত মরুভূমিতে। তাঁবু-সংসারে অতিথি হয়ে। বাগদাদ থেকে উড়োজাহাজে চড়ে দেশে ফিরলেন ১৯৩২ এর ৩রা জুন।

ভারতীয় ভূখণ্ড ছাড়িয়ে শেষ বিদেশযাত্রা ১৯৩৪ সালে। সেবার সদলবলে সিংহল যান কবি। বয়স তখন ৭৩। সাত দিন কাটান ক্যান্ডিতে। ক্যান্ডি থেকে অনুরাধাপুরম, তারপর জাফনা। শেষে ধনুষ্কোটি হয়ে জুন মাসে দেশে ফেরেন।

এই সামগ্রিক রূপরেখার যে বিস্তারিত প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিক এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক গভীরতা এবং গুরুত্ব তা এখানে বর্ণিত হয়নি। সে উদ্দেশ্যও প্রাবন্ধিকের নেই। নেই সে যোগ্যতাও।

এখানে শুধু আমরা দেখার চেষ্টা করেছি, রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রায় নিত্যযাত্রীর অধ্যবসায়ে বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই কবির ব্যক্তিত্ব হিমালয় উচ্চতা লাভ করেছে। বহু মানুষের সান্নিধ্য, নিসর্গের অনুপম সৌরভ কবির জীবন দর্শনকে মহিমান্বিত করেছে। তাই তো উপলব্ধি করতে পেরেছেন — এজীবন মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি।

আন্তর্জাতিকভাবে কবির মতামত কীভাবে সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে, তাও ধরার চেষ্টা এখানে নেই। ইতালি ভ্রমণের নানা বাঁকমোড়, রঁমা রল্যার সাক্ষাতের প্রতিক্রিয়া,দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে কবির নিজস্ব ভাবনা চিন্তা, রক্তক্ষরণ এখানে অনুপস্থিত। তাঁর লেখায় যে সর্বাত্মক প্রভাব রয়েছে বিদেশযাত্রার, তাও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। আবার রাজনীতির ক্ষেত্রে কীভাবে তিনি সেসব নিজের ভূয়োদর্শিতা দিয়ে সামলেছেন, তাও নিরন্তর গবেষণার রসদ যোগাচ্ছে।

পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনায় ইউরোপ ভ্রমণের প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ তাই যখনই সুযোগ পেয়েছেন, বিদেশের আহ্বানে অকৃপণ উচ্ছ্বাসে সাড়া দিয়েছেন। তাই বোধহয় মনের কন্দরে দানা বেঁধেছে প্রশ্ন – পথের শেষ কোথায়? তাই বোধহয় কবি সোচ্চারে বলেছেন — আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।

 

RELATED ARTICLES

Most Popular