Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-৮ || অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ক্রান্তিকালের মনীষা-৮ || অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ক্রান্তিকালের মনীষা-৮ || অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

বিশ্বকবির বিজ্ঞান বীক্ষা-২              জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা এবং ভালোলাগা থেকেই রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানপ্রীতি। ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটি মূলত কিশোর পাঠকদের কথা ভেবেই তিনি লিখেছিলেন। কঠিন বিজ্ঞানকথা সহজভাবে ব্যক্ত করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর, বাস্তবজীবনের এমন কিছু উপমা বা দৃষ্টান্ত তিনি ব্যবহার করেছেন যা সহজেই কিশোর কিশোরীদের আকর্ষিত করে।                        একটি দৃষ্টান্ত,- “গোল আলুর ঠিক মাঝখান দিয়ে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত যদি একটা শলা চালিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেই ঘোরা যেমন হয় সেইরকম হয় ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর একবার ঘুর খাওয়া| আমরা বলি, পৃথিবী আপন মেরুদন্ডের চারিদিকে ঘুরছে। আমাদের শলাফোড়া আলুটার সঙ্গে পৃথিবীর তফাত এই যে, তার এরকম কোন শলা নাই।”

পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিকগতি এমন সহজ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। ‘বিশ্বপরিচয়’-এর প্রতিটি পাতায় এরকম দৃষ্টান্ত রয়েছে। রসায়নশাস্ত্রে তেজস্ক্রিয়তার (Radioactivity) সম্বন্ধে, বিশ্বকবি ‘পরমাণুলোক’ অধ্যায়ে বলেন “পিচব্লেণ্ড নামক এক খনিজ পদার্থ থেকে ইউরেনিয়ামকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রী (পিয়ের কুরী ও মাদাম কুরী) মিলে এই পিচব্লেণ্ড নিয়ে পরখ করতে লাগলেন, দেখলেন এর তেজস্ক্রিয় প্রভাব ইউরেনিয়ামের চেয়ে প্রবল। পিচব্লেণ্ডের মধ্যে এমন কোনো পদার্থ আছে যারা এই শক্তির মূলে; তাঁরই আবিস্কারের চেষ্টায় আরও তিনটি পদার্থ বের হল- রেডিয়াম, পোলোনিয়াম এবং অ্যাক্টিনিয়াম।”

আবার তেজস্ক্রিয়তার কারণ বর্ণনায় বলেন, “হাল্কা যেসব পরমাণু তাদের মধ্যে ইলেকট্রন-প্রোটনের ঘোরাঘুরি নিত্য-নিয়মিতভাবে চলে আসছে বটে, কিন্তু অত্যন্ত ভারী যারা, যাদের মধ্যে নিউট্রন-প্রোটন সংঘের অতিরিক্ত ঠেসাঠেসি ভিড় (U,Ra) তারা আপন তহবিল সামলাতে পারছেনা- সদা সর্বক্ষণই তাদের মূলসম্বল ছিটকে পড়তে পড়তে হাল্কা হয়ে একরূপ থেকে অন্যরূপ ধরেছে।” বিশ্বকবি রসায়নশাস্ত্রে, কী অদ্ভুত নিষ্ঠার সাথে অত্যন্ত পরিশ্রমের মধ্যমে, সাহিত্যের অন্দরমহল থেকে পরমাণুর অন্দরমহলে প্রবেশ করেছিলেন।             রসায়নপ্রেমীরা জানেন-পরমাণুতে নিউট্রন ও প্রোটন সংখ্যার অনুপাত ১.৫–এর বেশী হলে পরমাণু অস্থির হয়ে ভাঙতে শুরু করে এবং তেজস্ক্রিয়তার সৃষ্টি হয়। কিন্তু একজন কবি- সাহিত্যিক- ঔপন্যাসিকের, রসায়ন শাস্ত্রের এমন সহজ সরল ব্যাখ্যা সত্যিই বিরল।রবীন্দ্রনাথ যে কতটা দুরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ তাঁর পরিচয় নির্মল কুমারী মহলানবীশকে লেখা একটি চিঠির ছোট্ট অংশ-

কল্যানীয়াসু,                                              এতদিনে বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানা দেখা হল| বহুদিন পূর্বেই আমার দেখতে যাওয়া উচিত ছিল।……. আমার মনে হল, কলকাতা শহরে সবচেয়ে বড়ো দেখবার জিনিস এই বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানা।……… যা দেখা গেল তার চেয়ে দূর নির্দেশ ইশারা আছে এর মধ্যে। সেখানে শুধু আজ আছে, কাল আছে তা নয়, আছে পরশু- সৃষ্টির গতিবেগ সেই আগামীর অভিমুখে।                             ১৯৩০ সালের ১৪ই জুলাই মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ গুরুত্বপূর্ণ । আইনস্টাইন বিশ্বকবিকে বলেছিলেন, “আমি মনে করি যে চাঁদ যেখানে আছে থাকবেই, যদিও আমি চাঁদকে নাও দেখি। আবার টেবিল ঘরে আছে থাকবেই, মানুষ দেখুক বা না দেখুক।” বিশ্বকবি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধিতে বলেন আইনস্টাইনকে, “হ্যাঁ, টেবিলটা থাকে ব্যক্তির মনের বাইরে, কিন্তু সার্বত্রিক মনের বাইরে নয়।টেবিল হল সেইটেই যাকে অনুভব করে এক ধরনের চেতনা, আমরা হলুম যার অধিকারী।”

রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যেই বিজ্ঞান চেতনা সম্পৃক্ত রয়েছে| সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে বিশ্বকবি বলেছেন ইতিহাস পড়ানোর জন্য চার্টের ব্যবহার করতে। কী দুরদৃষ্টি সম্পন্ন গুরুদেব,- আগামী ইতিহাস চর্চায় বিষয় হবে Historiographyঅর্থাৎ ‘ইতিহাস’ ব্যাবহারের মধ্যে লেখচিত্রের প্রয়োগ- তা তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন অর্থাৎ ইতিহাসে লেখচিত্রায়ন! গুরুদেবের নিজের কথায়, “লাইনে দুসারি বিশিষ্ঠ চিত্রায়নকে মেট্রিক্স (Matrix) বলব না? কোন বিষয় Matrix উপস্থাপনা থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে?” আবার ১৯১৩ সালে নেপালচন্দ্র রায়কে চিঠি লিখে ম্যাজিক লন্ঠন,Slide –এর ব্যবহার,Microscope ব্যবহার সম্পর্কে যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা জানিয়েছিলেন।

বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা সম্পর্কে তিনি চিঠিতে জনদানন্দ রায়কে কিছু “সহজবোধ্য বৈজ্ঞানিক চার্ট বই”–এর কথা লিখেছেন।                   তেজস্ক্রিয় রসায়নে নিউক্লীয় বিক্রিয়া হয় – নিউক্লীয় বিভাজন (Nuclear Fission) এবং নিউক্লীয় সংযোজন (Nuclear Fusion). বিশ্বকবি এই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার কথা বলেন, “ইলেকট্রন প্রোটনের যোগে যদি কখনো একটি হিলিয়ামের পরমাণু সৃষ্টি করা যায় তাহলে সেই সৃষ্টিকার্যে যে প্রচণ্ড তেজের উদ্ভব হবে, তার আঘাতে আমাদের পৃথিবীতে যে সর্বনাশী প্রলয়কাণ্ড ঘটবে।”
আবার বলেন, “সূর্য তিনশোষাট লক্ষকোটি টন ওজনের বস্তুপুঞ্জ প্রত্যহ খরচ করে ফেলেছে। কিন্তু সূর্যের ভাণ্ডার এত বৃহৎ যে আর বহু বহু কোটি বত্‍সর এই রকম অপব্যয়ের উদ্দামত্তা চলতে পারবে।”

বিশ্বকবি ‘পরমাণু লোক’ অধ্যায়ে ‘শিখা পরীক্ষা’ নিয়ে বর্ণনা করেন। রসায়নবিদ্যাতে বিভিন্ন ধাতবমূলকের সনাক্তকরণের জন্য শুষ্কপরীক্ষা ‘Flame Test’ বা শিখা-পরীক্ষা হয় যেখানে সোডিয়াম শিখার বর্ণ হয় Golden Yellow বা ‘সোনালী হলুদ’। বিশ্বকবি লিখেছেন,“নুনের মধ্যে সোডিয়াম নামক এক মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়। তা দিয়ে তাকে গ্যাস করে ফেললে বর্ণলিপিতে তার আলোর মধ্যে খুব কাছাকাছি দেখা যায় দুটি হলদে রেখা। আর কোন রঙ পাইনে। সোডিয়াম ছাড়া অন্য কোন জিনিসেরই বর্ণচ্ছটায় ঠিক ঐ জায়গাতেই ঐ দুটি রেখা মেলে না, ঐ দুটি রেখা যেখানকারই গ্যাসের বর্ণলিপিতে দেখা যাবে, বুঝব সেখানে সোডিয়াম আছেই।”

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। তার মধ্যে বালক, সাধনা, ভারতী ও বঙ্গদর্শন এই চারটি কাগজে বিজ্ঞানের একটি বিশেষ স্থান ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লেখেন,‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ যাকে তিনি সাহিত্যে পরিণত করেছিলেন। ইংরেজিতে প্রকাশিত বিজ্ঞানসম্বন্ধীয় বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ থেকে বিজ্ঞানের বিশ্বসংবাদ সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ সেগুলিকে রম্য সাহিত্যে পরিণত করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ মুলত সাধনা পত্রিকায় নিজেই বিজ্ঞানের সমস্ত প্রবন্ধলেখা প্রকাশের হাল ধরেছিলেন। ‘সাধনা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশ পায় বিশ্বকবির ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’, ‘গতিনির্ণয়েরইন্দ্রিয়’,‘ইচ্ছামৃত্যু’,‘মাকড়সা সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব’ এবং ‘উটপক্ষীরলাথি’।

‘সাধনা’ পত্রিকার পরের সংখ্যাতেই ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ বিভাগে রবীঠাকুর লেখেন,‘জীবনের শক্তি’,‘ভূতের গল্পের প্রামাণিকতা’ এবং ‘মানবশরীর’। ‘সাধনা’ পত্রিকাতে রবীঠাকুর পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রবন্ধ ‘ভূগর্ভস্থ জল এবং বায়ুপ্রবাহ’ প্রকাশ করেন। ‘সাধনা’ পত্রিকার সূচনাকাল থেকেই রবীঠাকুর বিজ্ঞান-সচেতন করার প্রয়াস নেন পাঠককুলকে, তাই কাগজের প্রথম দুটি সংখ্যায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ নিজেই লেখেন। পরে তিনি ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ বিভাগটি বন্ধ করে অন্য লেখকদের নিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা প্রবন্ধ লেখা বার করতে লাগলেন।

বঙ্গদর্শন পত্রিকায়,‘আচার্য জগদীশের জয়বার্তা’– প্রবন্ধটি রবি ঠাকুর লেখেন।বিশ্বকবি বিদ্যালয়গুলিতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচলন ঘটিয়ে তাঁর বিজ্ঞান ভাবনার পরিচয় দিয়েছিলেন। আবার রসায়ন শিক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি প্রস্তুত ভাবনাও তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত। অর্থভাবের জন্য শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি প্রয়োজন উপলব্ধি করলেও সম্ভবপর হয়নি। পরে রবি ঠাকুরের স্বপ্ন হাতেনাতে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যার জন্য ল্যাবরেটরি ‘রাজশেখর বিজ্ঞান সদন’ স্থাপিত হয়। প্রয়োগ বিজ্ঞানকে এতটাই ভালবেসে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ যে কিছুকাল কৃষিবিজ্ঞানের দিকে নজর দিয়েছিলেন এবং কৃষি সম্পর্কে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। একসময় আবার রেশমকীট নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানের প্রবর্তন করার জন্য তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ, বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদার এবং জামাতা নগেন্দ্রনাথকে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন।চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিভিন্ন হোমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিক বই পড়ারও রবি ঠাকুরের প্রবল উৎসাহ ছিল।

রবি ঠাকুরের বন্ধুত্বের পরিসরে ছিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শারীরশিক্ষার জন্য ডাঃ নীলরতন সরকার বিশ্বকবির অনুরোধে নরকঙ্কাল জোগাড় করে দিয়েছিলেন। আবার ১৯৩১ সালে বিশ্বকবির ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘গোল্ডেন বুক অফ টেগর’ প্রকাশিত হয় যার সম্পাদনা করেন জগদীশচন্দ্র বসু, নীলরতন সরকার,রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এই বইটিতে ডাঃ নীলরতন বিশ্বকবি সম্পর্কে লেখেন,“প্রতিটি ঘটনায় সাড়া এ বিশ্বে এমন হৃদয় হাতে গোনা। এমন চোখ আছে ক’জনের,- সময় ও দূরত্বের সীমাকে অতিক্রম করে যে চোখে ধরা দেয় সবকিছু। এমন কথা বলার মানুষ ক’জন,- যে অনিচ্ছুক ও সংশয়ী মানুষের কানেও পৌছে দেয় দরদী ও মরমীসত্ত্বাকে। ……….. রবীন্দ্রনাথ এই বিরল মানুষদের একজন।”

জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ‘সৌরজগত’ প্রবন্ধে লেখেন,“এই বিশ্বজগৎটা ধ্বংসের দিকে, না গড়ে ওঠবার দিকে চলছে, না দুই একসঙ্গে ঘটছে, সে সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের মতের মিল হয় নি।” জ্যোতির্বিজ্ঞানের উত্‍সাহ কী কি শেষ অব্দি তাঁর সঙ্গীতে প্রয়োগ করেন? নইলে এই গান,
“আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ-
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।”               এ যেন কবির নিভৃত প্রানের ভেতর থেকে উচ্ছসিত ধারা। আবার মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বে বিস্মিত হয়ে তার কলমের আঁচড়ে বেরিয়ে আসে,

“মহাবিশ্বের মহাকাশে মহাকাল মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।”         বিশ্বকবিকে জানার বিস্ময়ের অন্ত নেই সারা বিশ্বের। আজও তাঁরই কথা ধ্বনিত হয়,
“দিয়েছি উজাড় করি যাহা কিছু আছিল দিবার,
প্রতিদানে যদি যদি কিছু পাই – কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা- তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই।”

তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী মঙ্গলবাল,২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২০।                                       রচনাসূত্র (Reference): প্রথম পর্বে দেওয়া আছে

************

RELATED ARTICLES

Most Popular