Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-২৭, দীনবন্ধু মিত্র, বিনোদ মন্ডল

ক্রান্তিকালের মনীষা-২৭, দীনবন্ধু মিত্র, বিনোদ মন্ডল

নীলদর্পণ রূপকার দীনবন্ধু মিত্র                                         বিনোদ মন্ডল

প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহে উদ্ভাসিত বাঙালি। স্মরণে, স্বপনে, নিদ্রায়, জাগরণে সে বিপ্লবপন্থী। সে বিপ্লব কখনও সামাজিক, কখনো রাষ্ট্রিক। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ বাসনা মন্দ্রিত বৌদ্ধ দোঁহায় তারই প্রতিধ্বনি। শ্রীচৈতন্যের সামাজিক আন্দোলন তাকে মানবতার বহুমাত্রিক দ্যোতনা দেয়। চুয়াড় বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ কিংবা তিতুমীরের লড়াই তার প্রেরণা। সিপাই মঙ্গল পান্ডে থেকে হেম কানুনগো, ক্ষুদিরাম থেকে মাস্টারদা সূর্যসেন, মাতঙ্গিনী থেকে নেতাজী সুভাষ তার উত্তরাধিকার। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের বহমান ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ অন্যতম কোজাগর অধ্যায়।

১৮৫৯ সালে শুরু হয় নীল বিদ্রোহ।যশোর জেলার গ্রাম গুলো থেকে বিদ্রোহের যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ স্ফুরিত হয়,তা দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নদীয়া, হাওড়া, হুগলি এবং অবিভক্ত ২৪ পরগনায়। নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন নড়াইলের জমিদার রাম রতন রায়,মহেশ চট্টোপাধ্যায়, মোরাদ বিশ্বাস, সুহাস বিশ্বাস, লালচাঁদ সাহা, মথুরা আচার্য,সাধুহাটির রতন মন্ডল , চৌগাছার দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস। সঙ্গে ছিলেন যশোর ও বাঁশবেড়িয়ার গণ্যমান্য অনেকে। ধীরে ধীরে ধনী-নির্ধন আপামর মানুষজন সামিল হন এই বিদ্রোহে। অসহায় চাষীদের যন্ত্রণার দিনলিপি লেখা আছে সে কালের ‘সম্বাদ ভাস্কর’ ‘তত্ত্ববোধিনী’ এবং ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার পাতায় পাতায়। অমৃতবাজার পত্রিকার সাংবাদিক শিশির কুমার ঘোষ এবং ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ এর সাংবাদিক মনমোহন ঘোষ দিনের-পর-দিন নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। যার সারাৎসার ‘নীলদর্পণ’ নাটক।

ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। ইতিহাস থেকে জানা যায় — ১৮৫৩ সালে টিচারশিপ এক্সামিনেশনে সফল হচ্ছেন এই নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র (১.১১.১৮৩০–১.১১.১৮৭৩)।যদিও মাস্টার হয়েছিলেন কিনা জানা যায় না। তবে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন ‘পোস্ট মাস্টার’ এর চাকরি। ১৮৫৫ সালে ১৫০ টাকা বেতনে পাটনায় নিযুক্ত হলেন। ক্রমে ওড়িশা, নদীয়া, ঢাকা বিভাগে কাজ করেন। কলকাতায় সুপারিনটেনডেন্ট পোস্টমাস্টার হয়েছেন। লুসাই যুদ্ধের সময় ডাক বিভাগের কাজ-এ কাছাড়ে প্রেরিত হন। এই সময় তাঁর অতুলনীয় পারদর্শিতায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। তবে ব্রিটিশ কর্মচারীদের সমতুল বেতন পাননি কখনো। ভূয়োদর্শিতা তাঁর নাটক ও প্রহসন গুলিকে তীব্র সমাজমনস্ক করে তুলেছে। যার মধ্যে অগ্রগণ্য সৃষ্টি ‘নীলদর্পণ’ নাটক।

আজকের বাংলাদেশে দীনবন্ধুর জনপ্রিয়তা এপার বাংলার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তার কারণও বোধ করি ‘নীলদর্পণ নাটক।’বাংলাদেশের বাঙালি এই নাটককে বাংলাদেশের নাটক বলে গর্ব করেন। কারণ, এই নাটকের কাহিনী বাংলাদেশের মেহেরপুর অঞ্চলের পটভূমিতে চিত্রিত। দ্বিতীয়তঃ তাঁর ঢাকায় থাকার সময় এই নাটক লেখা হয়। তৃতীয়তঃ প্রথম অভিনীত হয় ঢাকা শহরে। সর্বোপরি ঢাকা শহরের বাংলা প্রেস থেকে এই নাটক প্রথম মুদ্রিত হয়। ‘কস্যচিত পথিকস্য’ ছদ্মনামে। এর ইংরেজি অনুবাদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরিত হয়। সেই সুবাদে মাইকেল ও রেভারেন্ড লঙ্ সাহেবের ভূমিকা ও তার পরিণতি সর্বজনবিদিত। এখানে দুটো তথ্য পরিবেশন করা বাহুল্য হবে না। এক, ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটার এর উদ্বোধন হয় যে ওপেনিং ড্রামা দিয়ে তার নাম ‘নীলদর্পণ।’দুই ১৯০৮ সালে রাজদ্রোহী মূলক নাটক আখ্যা দিয়ে এই নাটকের অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া হয় পরাধীন ভারতে।

দুর্গত ও অসহায় প্রজাদের উপর মুনাফাখোর নীলকরদের বেআব্রু অর্থনৈতিক শোষণ এ নাটকের উপজীব্য। প্রতিবাদী প্রজাদের কুঠিতে আটকে রেখে নির্মম অত্যাচার করা হতো। ধানি জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য করা হতো। পক্ষপাত দুষ্ট শাসকশ্রেণীর ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন লাগামছাড়া এই অত্যাচার মানুষ মেনে নিতে পারেনি। অত্যাচারিত সেইসব মানুষের প্রতিক্রিয়া চিত্রিত হয়েছে এই নাটকে। তাদের অকৃত্রিম বন্ধু ও সহায়ক মধ্যবিত্ত নবীন মাধব। ম্যাক্সিম গোর্কি বিপ্লবের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, প্রাথমিক পর্বে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণি গণআন্দোলনে সহায়তা করে। নবীন মাধব তাদের প্রতিনিধি। অত্যাচার কীভাবে শান্তি প্রিয়, ভীরু, দুর্বলহৃদয় মানুষকে এক সময় জেদি একবগ্গা ও লড়াকু মাতাদোর করে তোলে তার প্রতীক তোরাপ চরিত্র।অন্যদিকে ক্ষেত্রমণি চরিত্রে নদীয়ার রূপময় কৃষক কন্যা হরমণির ছায়াপাত ঘটেছে।

কৃষক জীবনের বাস্তব ঘটনা দীনবন্ধুকে এই নাটক রচনায় প্রাণিত করেছে। গুয়াতেলি গ্রামের মিত্র পরিবারের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে নানা উপকাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে। ছোট সাহেব আর্চিবল্ট হিলস্ হরমণিকে কুলচিকাঠা কুঠিতে আটক করে রেখেছিল। এ নাটকের রেবতী চরিত্রের মধ্যে অনেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ময়নার মা চরিত্রের পূর্বাভাস লক্ষ করেছেন। আবার নাট্য দৃশ্য পরিকল্পনায় শাসক ও শোষিতের প্রতিক্রিয়া মুখর ঘটনা পারম্পর্য বিজন ভট্টাচার্যকে নবান্ন পরিকল্পনায় রসদ জুগিয়েছে মনে হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান দীনবন্ধুর অন্তরে ছিল ভদ্রেতর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। মানব জীবনের প্রতি অনাবিল শ্রদ্ধা। তাঁর চোখে – ‘only men can exist, the rest in merely, the work of his hand and his mind.’ আবার গোর্কির প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে এসে যায়। তাঁর ‘লোয়ার ডেপ্থ’ নাটকের জনতা চরিত্র জার শাসিত হয়ে এভাবেই জর্জরিত।

একদল কৃষক, সম্পন্ন জোতদার তাকিয়েছিল, আদালতের দিকে। কিন্তু বাস্তবে, ১৮৫৫ তে বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায় তখন এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ অবস্হা, তখন বারাসতের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এশলি ইডেন তার বহু প্রতীক্ষিত মামলার রায় দেন নীল চাষীদের পক্ষে। নীল চাষ করতে অসম্মত প্রজাদের উপর অত্যাচার বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন একসময় লর্ড মিন্টো। তা খাতায়-কলমে রয়ে যায়, কার্যকর হয়নি।১৮২৩ এ রেগুলেশন ছয় মোতাবেক দাদন প্রাপ্ত চাষিরা নীলকরদের অধীনতা প্রাপ্ত হয়। ১৮৩০ এ জারি হওয়া পঞ্চম আইনে বলা হয় নীলচাষে অসম্মতি দণ্ডযোগ্য অপরাধ। ক্রমে তিন দশক জুড়ে বাংলায় জাঁকিয়ে বসে নীল ব্যবসা। এদের এক একটি গোষ্ঠী ৫ থেকে ১০ টা সর্বাধিক নীলকুঠি খুলে দেদার ব্যবসা চালায়। ইতিহাসে এমন দুটি উল্লেখযোগ্য নাম হল রবার্ট টি লারসুর ও জেমস ফোরলং। অবশেষে ইডেনের ঐতিহাসিক রায়ের ফলে একাদশ আইনে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। ক্রমশ স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাংলার হতভাগ্য কৃষি সমাজ।

বাংলাদেশে নীল বিপর্যয় নাটকে প্রতিফলিত হওয়ার ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাই মাদাম হ্যারিয়েট স্টো’র লেখা আঙ্কেল টমস কেবিনের সাথে নীলদর্পণকে এক আসনে বসিয়েছেন। ১৮৬০ সালের ২ জুন ‘হরকরা’ পত্রিকা দীনবন্ধু মিত্রকে উদ্দেশ্য করে অভিধা প্রয়োগ করে – friend of poor and needy. আর নীল বিদ্রোহের অতন্দ্র দিন- লিপিকার হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কে স্মরণ করে সঙের গান লেখা হয় – এখন বাঁচালে এক হরিশে                                                     ধুনে বুনে নিল জমি হল খিল                                               (এখন) হতেছে তাই অড়র কলাই সরিষে।

অকালে রোগভোগে প্রয়াত হয়েছেন হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।ব্যাধি রেহাই দেয়নি দীনের বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রকেও। কাছাড়ে থাকাকালীন প্রচুর পরিশ্রমে চল্লিশেই ভেঙে যায় শরীর। বহুমূত্র রোগে কাহিল হন তিনি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১ নভেম্বরে প্রাণত্যাগ করেন। ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মতো একই তারিখে জন্মেও ছিলেন তিনি।

ইতিহাসের হেঁয়ালি হলো পিতৃদত্ত নাম ছিল যে গন্ধর্ব নারায়ণ মিত্র, অন্য অনেকের মতো সেই দীনবন্ধু (স্বকৃত) মিত্রেরও সঠিক জন্ম তারিখ অমীমাংসিত। এক্ষেত্রে তিনি যেন রামমোহন রায়ের সগোত্র। তাঁর জন্মস্থান অধুনা উত্তর ২৪ পরগনার চৌবেড়িয়া গ্রামের ‘চৌবেড়িয়া দীনবন্ধু বিদ্যালয় ‘ অবশ্য ১৮২৯ সালের ১০ এপ্রিল দিনটিকে তাঁর ‘আবির্ভাব দিবস’ শিরোধার্য করে ওই দিনে জন্মজয়ন্তী উদযাপন করে। ইতিহাস উদাসীন বাঙালি উনবিংশ শতকের এই যশস্বী স্রষ্টাকে নিয়ে যথারীতি ক্রুয়েলিস্ট এপ্রিল ও বিপ্লবস্পন্দিত নভেম্বরে নীরব থাকে এপার বাংলায়।

RELATED ARTICLES

Most Popular