Homeএখন খবরহাতের মুঠোয় আয়ুর্বেদ-১ ।। ডাঃ সুমিত সুর

হাতের মুঠোয় আয়ুর্বেদ-১ ।। ডাঃ সুমিত সুর

(আজ থেকে ‘দ্য খড়গপুর পোষ্ট’ শুরু করছে একটি বিশেষ বিভাগ হাতের মুঠোয় আয়ুর্বেদ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় অসুখ বিসুখের নিরাময় প্রকৃতি আমাদেরই চারপাশে ছড়িয়ে রেখেছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকাররা বলেন, সেই অমূল্য সম্পদ যা কিনা ভেষজ হিসাবেই আমরা জানি, চোখ খুলে তাদের চিনে নেওয়া টুকু বাকি। অধিকাংশ রোগের নিরাময় হয়ে যেতে পারে ওতেই। শুধু তাই নয় অসুখ বিসুখে বাইরেও রয়েছে প্রতিষেধক, প্রসাধন। সোজা কথায়, সুস্থ ও সুন্দর থাকার উপায়। যেমন ঋতু পরিবর্তন কালীন সমস্যা, এই শীতে কেমন করে আয়ুর্বেদ ভাল রাখতে পারে আমাদের কিংবা বর্ষায় নানা বিধ অসুখ বিসুখ! এই সমস্ত ভাবনায় লেখনি নিয়ে থাকছেন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকাররা। এই পর্যায়ে আমরা পেয়েছি দ্য খড়গপুর পোষ্টের একান্ত আপনজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডাঃ সুমিত সুর আগামী বেশ কয়েকটি সংখ্যা লিখবেন
তিনি। এবার থেকে প্রতি সোমবার এই বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য চোখ রাখুন ‘দ্য খড়গপুর পোষ্ট’য়ে। ডাঃ সুমিত সুর, মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদ ), রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রম, পাত্রসায়ের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র , বাঁকুড়া)

লাল মাটির অবহেলিত ভেষজ – নিশিন্দা    ডাঃ সুমিত সুর :দুই বঙ্গসহ সমগ্ৰ পূর্ব ভারতে অতি সহজলভ্য, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অথচ একেবারেই অবহেলিত একটি গাছ, নিশিন্দার এই নিশিন্দা বা নিশিন্দের নাম একসময় নিমের সঙ্গে সমোচ্চারিত হত। চাষের জমির ধারে ধারে ও বেড়া দিতে নিশিন্দা ছিল অপরিহার্য। গাছের রোগ-পোকা দমনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ার খুঁটি বা উবি হিসেবেও নিশিন্দা খুব‌ই উপযোগী। বর্ষায় এর ডাল কেটে পুঁতে দিলেই নতুন গাছ হয়ে যায়। এছাড়াও শস্য সংরক্ষণে ও কাপড় জামায় ছাতা পড়া বা পোকায় কাটা ঠেকাতেও এর শুকনো পাতা ব্যবহার করা হত, হয়তো প্রত্যন্ত গ্ৰামাঞ্চলে এখন‌ও হয়। সাদা ও নীল দুরকম রঙের ফুলের জন্য যথাক্রমে নিশিন্দা ও নীল নিশিন্দা বা নির্গুন্ডী বলা হয়। দুটি গাছই সমগুণসম্পন্ন ও দেখতেও প্রায় এক‌ই রকম। এর পাতায় একটি বিশেষ তীব্র গন্ধ থাকায় এটি “ছাগলেও খায় না”।

নাম পর্যায়ঃ নিশিন্দার বৈজ্ঞানিক নাম Vitex negundo (সাদা ফুল), Vitex trifolia (নীল ফুল) । সিন্দুবার, নির্গুন্ডী (সংস্কৃত), নিশিন্দা বা নিশিন্দে (বাংলা), বেগুনিয়া (ওড়িয়া), সনভালু, সাম্ভালু (হিন্দি), বেনগুনিয়া বা, সিন্ধুহি, সিন্ধুহারি, লুনগুনিয়া(বিভিন্ন উপজাতীয় ভাষায়) । অথচ আজকাল অনেকেই নিশিন্দাকে সঠিকভবে চেনেন না, কারন এর নাম বিভিন্নতা। যতটুকু জানি, শুধুমাত্র হাওড়া হুগলি দুই মেদিনীপুর ও বাঁকুড়াতেই নিশিন্দাকে অঞ্চলভেদে ইনশান, ইচ্ছুড়, ইঞ্চিরি, সামালু,বেগনা গাছ বলা হয়।

ইতিহাস এর পাতায় : বৈদিক যুগ থেকেই এর উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। চরক সংহিতা , সুশ্রুত সংহিতা ,অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ , অষ্টাঙ্গ হৃদয় ,সারাঙ্গ ধর সংহিতা , ভাবপ্রকাশ , রাজ্ নিঘন্টু তে বিস্তারিত বর্ণনা আমরা পাই।                                              জন্মস্থান : সমগ্র ভারতবর্ষের ছোটনাগপুর মালভূমি , বিহার, সুন্দরবন ,উত্তরবঙ্গ ,হাওড়া ,হুগলি ,বর্ধমান , পশ্চিম মেদিনীপুর , বাঁকুড়া , পুরুলিয়া,ও ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, রাস্তার ধারে, জঙ্গলে ,বেড়ার গাছ হয়েও জন্মায়।ব্যবহার্য অংশ : অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশিন্দার পাতা, ফুল, ফল, কান্ডের ছাল, মূলের ছাল, এক কথায় সমগ্ৰ গাছ‌ই ব্যবহার হয় চিকিৎসার কাজে

কোন কোন রোগে ব্যবহার হয় ?  ১. মাথাধরা ও মাইগ্ৰেণঃ কাঁচা বা শুকনো পাতা হাতে ডলে খানিক্ষন শুঁকলে মাধরা কমে যাবে। শুকনো নিশিন্দাপাতার বালিশ তৈরি করে রাত্রে মাথায় দিয়ে শোয়ার অভ্যাস করুন, যে মাইগ্ৰেন ওষুধে সারেনি তাও ভাল হয়ে যাবে। সাইনোসাইটিস – ১০-১৫ মিঃ লিঃ নিশিন্দা পাতার রস সামান্য আদা ও মধুসহ দিন দু বার নিয়মিত ভবে কয়েকদিন খেলেই ভাল হয়ে যাবে।                                        ২. আ্যন্টিফাঙ্গাল,আ্যন্টিব‍্যাকটেরিয়াল, আ্যন্টিভাইরাল ও বিষঘ্ন হিসেবে নিম – নিশিন্দা জুড়ি অতুলনীয়।                                        ৩.বাতের অসুখঃ। সকালে বিকাল খালিপেটে ১০ মিঃ লিঃ (দুই চা-চামচ) নিশিন্দা পাতার রস ২-৩ টি গোলমরিচ গুঁড়ো সহ নিয়মিত ১০-১৫ দিন খেলেই বাতের কষ্ট কমে যাবে। এর সঙ্গে ১৫-২০ টি নিশিন্দা পাতা দেড় দু লিটার জলে ফুটিয়ে ঐ জলে ২০-২৫ গ্ৰাম নুন মিশিয়ে ছোট কাপড়ের টুকরো ডুবিয়ে আক্রান্ত স্থানে গরম গরম ভিজে সেঁক দিন, দ্রুত আরাম পাবেন। অসহ্য সায়াটিকার যন্ত্রনায় নিশিন্দা পাতার চূর্ণ এক গ্ৰাম, আধ কাপ গরম জলে মিশিয়ে দু বেলা নিয়মিত খেলে ব্যথা কমবেই, সঙ্গে সেঁকটা নিতেই হবে।

৪.পেট ফাঁপা ও কলিক পেনঃ শুকনো নিশিন্দা পাতার চূর্ণ ১-২ গ্ৰাম, আধ কাপ ঈষদুষ্ণ জলে ভাল করে মিশিয়ে নিয়ে সকালে বিকালে নিয়মিতভবে কয়েকদিন খেলেই বায়ুর চাপ ও কলিক ব্যথা কমে যাবে। যাদের দুর্বল হজমশক্তির জন্য কথায় কথায় পেটে বায়ু জমে, বায়ুটা নিচে সরে না, ওপরে ঢেঁকুর‌ও ওঠেনা, অস্বস্তিকর আই ঢাঁই অবস্থা, তারা এটি ব্যবহার করে দেখুন।                                    ৫. হঠাৎ করে খিদে কমে গেছে, এই অবস্থায় এক চামচ হলুদবাটার সঙ্গে আধ চামচ নিশিন্দাপাতা চূর্ণ দুপুরে গরম ভাতের সাথে সামান্য সরষের তেল ও নুন মেখে ৩-৪ দিন নিয়মিত খেলেই চনমনে খিদে এসে যাবে। খিদে বাড়ানোর জন্য নিশিন্দা ফুল বা কচি পাতা সামান্য কয়েক ফোঁটা গাওয়া ঘিয়ে ভেজে গরম ভাতে মেখে কয়েদিন খেলেই হবে। এই গাওয়া ঘিয়ে ভাজা নিশিন্দাপাতা জিভের পুরনো ঘা সারাতেও খুব ভাল কাজ করে।

৬. ক্রিমী রোগে : কুঁচো ক্রিমীর উপদ্রব কমাতে পর পর ৩-৪ দিন সকালে খালিপেটে সিকি চামচ নিশিন্দা পাতার গুঁড়ো ঠান্ডা জলে মিশিয়ে খেতে হবে।                                                                    ৭. ক্ষত, ফোঁড়া ও চুলকানিঃ ৩-৪ চামচ নিশিন্দা পাতার রস ৫০ গ্ৰাম তিল তেল বা নারকেল তেলের সঙ্গে ফেনা সম্পুর্ণ মরে যাওয়া পর্যন্ত ফুটিয়ে রেখে দিন। এই তেল লাগালে এটিই ফোঁড়া পাকিয়ে ফাটিয়ে শুকনো করে দেবে। এই তেল নিয়মিত মাখলে চুলকানি ও খোসের ঘা সেরে যাবে।         ৮. শয্যাক্ষত বা বেড সোর‌ও এই তেল নিয়মিত ব্যবহারে সেরে যাবে।                                           ৯. কানের পূঁজে কাঁচা পাতার রস ভাল কাজ করে।                                                                ১০. টনসিলাইটিস ও ফ‍্যারিঞ্জাইটিসঃ এই রোগগুলো আজকাল ঘরে ঘরে, শুরুতে নিশিন্দার আশ্রয় নিলে এই কষ্ট থেকে রেহাই পাবেন। ১০০ মিঃ লিঃ জলে ৪-৫ টি পাতা ফুটিয়ে নিন, এবার জলটা ছেঁকে নিয়ে সামান্য নুন মিশিয়ে গড়গড়া বা গার্গল করুন, দিনে দু বার আহারের পর। ৫-৭ দিনেই টনসিলাইটিস ও ফ‍্যারিঞ্জাইটিস কমে যাবে।

১১.জিঞ্জিভাইটিসে এই জলে নুনের সঙ্গে যৎসামান্য ফিটকিরি মিশিয়ে নিয়ে এক‌ইভবে কুলকুচি করুন ক’দিন, মাড়ির কষ্ট ও মুখের দুর্গন্ধ দুইই কমে যাবে।                                               ১২. শয্যামূত্রঃ এ ক্ষেত্রে সকাল সন্ধ‍্যে খালিপেটে এক গ্ৰাম নিশিন্দাপাতার চূর্ণ আধ কাপ গরম জলে মিশিয়ে নিয়মিত দিন সাতেক খাওয়ান, রোগটা সেরে যাবে। বৃদ্ধ বয়সে পেচ্ছাপ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গেলে, রাতে বার বার উঠতে বাধ্য হলে, বিকেলে দু গ্ৰাম পাতার চূর্ণ এক‌ইভবে ক’দিন নিয়মিত খান, প্রকোপ অনেকটা কমে যাবে।       ১৩. হঠাৎ সর্দিজ্বর, পুরানো কাশি ও হাঁপানিঃ ৩-৫ গ্ৰাম শুকনো নিশিন্দা ছাল সামান্য আদা বা শুঁঠচূর্ণ সহ ১০০ মিঃ লিঃ জলে ফুটিয়ে জলটা মেরে অর্ধেক করে ছেঁকে নিয়ে সকাল সন্ধ‍্যে নিয়মিত খান। বহুদিনের পুরনো কাশি ও হাঁপানীর টান ১০-১২ দিনেই কমে যাবে।

১৪. ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় ভাইরাল রোগেও গলা ব্যথা, গলা ধরা ও গলক্ষতে আগে বলা পদ্ধতিতে গড়গড়া এবং বুকে কফ বসে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হলে উপরে বলা পদ্ধতিতেই আদা বা শুঁঠ সহ জলে ফুটিয়ে খেতে হবে,দিনে দু-তিনবার।                    ১৫. যোনি ক্ষতেঃ দীর্ঘস্থায়ী সাদা স্রাবের কারনে যোনিতে জ্বালা যন্ত্রনা ও ঘা হলে নিশিন্দা পাতা ফোটানো জলে দিনে ২-৩ বার, রাতে শোবার আগে অবশ্যই, যোনিস্থান ধুলে কয়েকদিনে সব উপসর্গ কমবে।                                                               ১৬. ছুলি, খুসকি ও টাকপড়াঃ ১০০ গ্ৰাম নারকেল তেলে ১০-১২ টি নিশিন্দাপাতা কুঁচো করে ফুটিয়ে ছেঁকে নিন। এই তেলটি স্নানের ঘন্টাখানেক আগে নিয়মিত মাখুন। কয়েদিন ব্যবহারে ছুলি ও খুসকি কমবেই, দীর্ঘদিন ব্যবহারে হঠাৎ টাকপড়াও (বংশগত নয়) সেরে যাবে।

১৭. স্থুলত্ব কমাতেঃ ২ গ্ৰাম পরিমান নিশিন্দাপাতাচূর্ণ সকাল খালিপেটে এক গ্লাশ ঠান্ডা জলে মিশিয়ে নিয়মিত খেলে ভূঁড়ি ও স্থুলত্ব কমবে। সঙ্গে তৈলাক্ত আহার বর্জন ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।                                                  প্রতিটি ক্ষেত্রের একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মাত্রা বলা হয়েছে। বয়সানুযায়ী মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে।                                                            শুকনো নিশিন্দাপাতার ধোঁয়া ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখতে এবং মশা ও মাছি তাড়াবার এক নিরাপদ পদ্ধতি। ন‍্যাপথালিনের পরিবর্তেও শুকনো নিশিন্দা পাতা ব্যবহার করতে পারেন।                      নিশিন্দার আরাও অনেক লোকায়িত ব্যবহার পদ্ধতি আছে, বিশেষত বৈদিক যুগের‌ও আগে থেকেই প্রচলিত আদিম অধিবাসীদের চিকিৎসাপদ্ধতি, যার অনেক কিছুই এখনো আমাদের জানা হয়ে ওঠে নি। প্রয়োজন অনুসারে নিকটবর্তী আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের পারামর্শ নিতে পারেন।

RELATED ARTICLES

Most Popular