Homeএখন খবরমেদিনীপুর আগাগোড়াই লালে লাল! বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের খোঁজে পথ হাঁটল দশ হাজারি...

মেদিনীপুর আগাগোড়াই লালে লাল! বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের খোঁজে পথ হাঁটল দশ হাজারি মিছিল

নিজস্ব সংবাদদাতা: না, এ মিছিল স্মরনাতীত কালে দেখেনি মেদিনীপুর শহর। না শাসকদল, না বিজেপি, না অন্য কোনোও রাজনৈতিক দল এরকম মিছিল করেছে শহরে। বুধবার কংগ্রেস  ও বামেরা যে মিছিল করল বামফ্রন্টের উদ্যোগেও ২০১১ সালে ক্ষমতায় থাকা কালীন এমন মিছিল করা সম্ভব হয়নি। মেদিনীপুর কলেজ মাঠ থেকে শুরু হয়ে ৭ কিলোমিটার পথ ঘুরে মিছিলের মুখ যখন ফের কলেজ মাঠে ঢুকছে তখন মিছিলের ল্যাজ ট্রাফিক অচল করে পথ হাঁটছে কেরানিতলা পেরিয়ে এসে বিদ্যাসাগর শিক্ষন প্রশিক্ষন মহাবিদ্যালয় বা বি.এড.কলেজের মুখে। ৭ কিমি পথের ৪ কিলোমিটার পথ জুড়ে ভিড়ে ঠাসা মিছিল হেঁটেছে জনগনের মাথার ওপর চেপে বসা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের শনি রুপি দুর্ভাগ্যকে ঝেড়ে ফেলার আহবান জানিয়ে।মিছিল শুরুর পরেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি ভেঙে পড়েছে মাথার ওপর কিন্তু সে বৃষ্টি মিছিল ভাঙতে পারেনি।
এমনিতেই মিছিলের প্রধান আকর্ষন ছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। ঘোষনা ছিল মিছিলে পথ হাঁটবেন তিনি। ফলে উদীপ্ত পার্টি কর্মীরা জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঝাঁপিয়ে এসেছেন। মিছিল যারা চোখে দেখেছেন তাঁদের কাছে ১০হাজার লোক বললে হয়ত খুব সমস্যা হবেনা কিন্তু যাঁরা মিছিল দেখেননি তাঁদের চোখ কপালে উঠবে হিসাবটা পেলে। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পদক মন্ডলীর সদস্য বিজয় পাল জানিয়েছেন, ‘আমাদের ৫০টি এরিয়া কমিটি রয়েছে। এমন কোনও এরিয়া কমিটি নেই যেখান থেকে লোক আসেনি। প্রতিটি এরিয়া কমিটি থেকে ২০০জন মানুষ আসলেই ১০হাজার মানুষ হয়ে যায়। আমি নিজে দায়িত্বে রয়েছি গোয়ালতোড়, চন্দ্রকোনা রোড, খড়গপুর শহরের। এই তিনটি এরিয়া কমিটি মিলিয়ে নূন্যতম হাজার মানুষ এসেছেন।”
সবংয়ের সিপিএম যুব নেতা অভিজিৎ খাটুয়া জানিয়েছেন ১৪টা ট্রেকারে ছাদে পিঠে ভর্তি হয়ে মানুষ গেছেন, প্রতি ট্রেকারে নূন্যতম ৩০জন। নারায়নগড় পার্টি জানিয়েছেন তাঁরা ১৬টি গাড়িতে জমায়েতে গেছিলেন। দাঁতন জানিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ গেছে মেদিনীপুর শহরে। গড়বেতা ব্লক থেকে ৫৭০টি বাইক এসেছিল। এমনকি সন্ত্রস্ত কেশপুর থেকেও মিছিল এসেছে বুধবারের মিছিলে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম বলছে সব মিলিয়ে ১০ হাজারের নিচে নামবেনা সংখ্যাটা ওপরে উঠতেই পারে।সংখ্যাতত্ত্বের চেয়েও বড় কথা শাসকদলের স্বীকৃতি। সেই শাসকদলের নেতা কর্মীরা যাত্রা পথের প্রতিটি কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখেছেন, উপেক্ষা করে সরে যেতে পারেননি। সংবাদ মাধ্যমের সামনে স্বীকার করে নিয়েছেন যে এত বড় মিছিল তাঁরা দেখেননি এ যাবৎকালে। “আমরা হয়ত এর থেকেও বেশি মানুষ নিয়ে সভা করেছি কিন্তু এতবড় মিছিল করতে পারিনি। হাজার হাজার মানুষকে এতটা পথ হাঁটানো সত্যি বড় বিষয়। যা দেখছি আমাদেরও একটা বড় মিছিল করতে হবে।” জানালেন মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা তৃণমূলের এক জেলা নেতা।
কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি এদিন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বলেছেন, “করোনা পরিস্থিতেও মানুষ ঘরে বসে থাকবেনা কারন মানুষের রুটি রুজি তে টান পড়ছে যা করোনার যে ভয়াবহ সঙ্কট এনেছে দেশে। রাজ্য কিংবা কেন্দ্র কেউই সেই আম মানুষের কথা ভাবছেনা। তৃনমূল আর বিজেপি দুই-ই দেখা হয়ে গেছে মানুষের। এখন বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প খুঁজছেন মানুষ।” এই বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প কথাটি কী তত্ত্ব কথা? প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যায়নি তত্ত্বগত ভাবে তবে লাজুক এক প্রৌঢ় দম্পত্তির দেখা মিলল মেদিনীপুর শহরের এল.আই. সি মোড়ে। রাস্তার পাশে ফুটপাতে চটি কিনেছিলেন দু’জনে। বাড়ি চন্দ্রকোনা রোড থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে গুইয়াদহ এলাকায়। পাশ দিয়ে মিছিলটা যেতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখে চোখে কথা হল দুজনের। তারপর দুজনেই হারিয়ে গেলেন মিছিলের ভিতর। ওঁদের ওপর নজর রেখেই এই প্রতিবেদকও হাঁটছিল মিছিলের পাশে পাশে। কলেজ মাঠে মিছিল শেষ হওয়ার মুখে পড়া গেল দম্পত্তি যুগলকে নিয়ে। জানা গেল চন্দ্রকোনা রোড থেকে মিছিলে আসা লোকেদের সঙ্গে আসেননি তাঁরা। এসেছেন বাসে করে, বাজার করার নামে। মেদিনীপুর শহরের ফুটপাতে যে চটি তাঁরা কিনেছেন তা চন্দ্রকোনা রোডের ফুটপাতেও পাওয়া যায়। কিন্তু এসেছেন শুধু মিছিলে মিশে যাবেন বলে। কিন্তু তার জন্য এই লুকোচুরির কী দরকার? বছর বাহান্নর আদিবাসী প্রৌঢ় জানালেন, ” বরাবরই লাল পতাকার লোক ছিলাম। ২০১১ সালে অনেকের মতই আমরা ভোট দেই তৃনমূলকে। ভেবেছিলাম যা পাওয়ার তারও চেয়ে বেশি পাওয়ার ছিল যা সিপিএম আমাদের দেয়নি। পরের পঞ্চায়েতে তৃনমূল ক্ষমতায় এল। ভোটের আগে মিছিল মিটিং করেছি তৃণমূলকে জেতানোর জন্য। তৃণমূল জেতার পরই শুরু হয়ে গেল লুট। নির্মল বাংলা মিশন থেকে আবাস যোজনা টাকা না দিয়ে কোনও কাজ হয়না। এলাকায় কাজ নেই, দুই ছেলেই পরিযায়ী শ্রমিক ব্যাঙ্গালুরুতে। বুড়ো বয়সে মানুষ ছেলেদের কাছে থাকতে চায় কিন্তু আমাদের ছেলেরা দুরে থাকে। পরের নির্বাচনে আমরা তৃনমূলকে উল্টে দিতে বিজেপি করেছি। ওদের মিছিল মিটিংয়ে হেঁটেছি। তারপর হঠাৎ করে লকডাউন। ছেলেরা ফিরে এসেছে অনেক কষ্টে। ছেলেরাই একদিন বলল, “বাবা, লক ডাউন শুরু করার আগে কয়েক দিন সময় দিলে আমরা সোজা রাস্তায় বাড়ি ফিরতাম বড় জোর ৩দিনে। আর সরকার আমাদের ৩ মাস আটকে রাখল না খেতে দিয়ে।” আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে দেখলাম, পাপের ফল ভোগ করছি আমরা। আমাদের আদিবাসী সমাজে এখনও পাপ-পুণ্যের ধারনাটা প্রবল। সেই ধারনায় তোমার পাপের ফল তোমাকে এই পৃথিবীতেই মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আমরা এক সময় এই লাল ঝান্ডার তলায় দাঁড়িয়ে জমির পাট্টা পেয়েছি। ছেলেরা বলল, ২০১১ সালে বামফ্রন্ট না চলে গেলে তারা শালবনীতেই কাজ পেয়ে যেত কিংবা এখানেই অন্য কোথাও। তাই আবার ফিরে এলাম।”
কিন্তু তার জন্য লুকানোর কী হয়েছে? প্রৌঢ় জানালেন, “কয়েকদিন আগেই রোডে পার্টির মিছিল হয়েছিল কিন্ত যেতে পারিনি লজ্জায় আর ভয়ে। লজ্জা এটাই যে পার্টির পুরানো লোকেরা হাসবে আমাদের দেখে আর ভয় এই কারনে যে ওরা খুবই হিংস্র। গুইয়াদহর পার্টি অফিস আমরা কয়েক মাস খুলে দিয়েছিলাম কিন্তু তৃনমূল আর পুলিশ মিলে ফের বন্ধ করে দিয়েছে। তৃনমূল বন্ধ করে দিয়েছিল ওই অফিস। এরপর আমরা ওই অফিস খুলতেই অনেকের চাষ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ফের বন্ধ করে দিতে হয়। এখন অবশ্য গোটা গ্রামই আমাদের পার্টি অফিস। আমরা একা নই, বাজার করার নামে অনেকেই আজ মিছিলে এসেছি। ছেলেদের কথা দিয়েছি ফের গ্রামে লাল ঝান্ডা উড়াবই।” পুরো গল্প মনে হচ্ছিল এই ঘটনাটা। এটাই কী তবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের খোঁজ…..!

RELATED ARTICLES

Most Popular