Homeএখন খবরকেউ তাড়া করলনা, কেউ আটকেও রাখলনা! নন্দীগ্রামে লাশের পর লাশের পাড়া পেরিয়ে...

কেউ তাড়া করলনা, কেউ আটকেও রাখলনা! নন্দীগ্রামে লাশের পর লাশের পাড়া পেরিয়ে বুথে বুথে পৌঁছে গেল মীনাক্ষী

নিত্য গুপ্ত: গাংড়া, সাউদখালি পেরিয়ে সোনাচুড়ায় নামল লাল সালোয়ার! ২দিন আগে নির্বাচন কমিশনের মনে হয়েছে ওকে নিরাপত্তা দেওয়া দরকার। তাই চারজন পুলিশ! মেয়ে ওদিকে ভ্রুক্ষেপই করেনা, দু’জন পুলিশ কোথায় কে জানে? অন্য দু’জন দূরত্ব বজায় রেখেই হাঁটে। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ঢালু পথ বেয়ে সোনাচুড়া বিশ্বেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই সোনাচূড়া! এখান থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার, ৭ই জানুয়ারি জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল শঙ্কর সামন্তকে। মাওবাদী আর তৃনমূলের নেতৃত্বাধীন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির জান্তব উল্লাসের মধ্যেই দাউ দাউ করে জ্বলছেন শঙ্কর সামন্ত। গায়ে ঢেলে দেওয়া কেরোসিন চামড়া সমেত পুড়ছে! অদূরে বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে শঙ্করের স্ত্রী, ভাইয়ের স্ত্রী আর তিন বছরের ভাইজি তিস্তা! না, সেই মৃত্যুতেও তৃপ্ত নয় কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহল। কবি জয় গোস্বামী কবিতা লিখছেন, একদিন তালপাটি খালে গড়াগড়ি খাবে নব সামন্তের মুন্ডু। নব সামন্ত, শঙ্কর সামন্তের ভাই, তিস্তার বাবা! গায়ক কবির সুমন বলছেন, প্রতিদিন সকালে উঠে খবর কাগজে একটা করে সিপিএমের লাশের খবর দেখতে না পেলে প্রাতরাশটা ঠিক জমে ওঠেনা। সেই সোনাচুড়ায় ভোটের দিন যেতে হলে হাই প্রোফাইল শুভেন্দু অধিকারীর এখন দরকার ৩০ জন মহিলা সিয়ারপিএফ জওয়ান ছাড়াও জেড ক্যাটাগরি। সব মিলিয়ে হাফ কোম্পানির বেশি। আর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর জন্য গোটা রাজ্য পুলিশ! লাল সালোয়ার মীনাক্ষীর কিছু নেই, শুধু চারজন পুলিশ, তাও নির্বাচনের ২দিন আগে।

সাত সকালেই স্নান সেরে নিয়েছিল মীনাক্ষী। আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল ভোটের দিন এই লাল সালোয়ারটাই পরবে। বড় প্রিয় রঙ! ২দিন আগেই এই সালোয়ার পরেই প্রচারে গিয়েছিল। সেদিন রাতেই কেচে মেলে দিয়েছিল বাতাসে। সকালে উঠে ভাঁজ করে বালিশের তলায়। মাথার চাপে দিব্যি ইস্ত্রি হয়ে গেছে! এরকমটাই অভ্যাস বরাবরের। তারপর সকাল সকাল নাগাদ নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ডের কাছে সিপিএমের যে দলীয় দপ্তরে। কমরেডদের কাছ থেকে পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে প্রায় ১০টা নাগাদ বেরুলেন। এরপর নন্দীগ্রাম থানা পেরিয়ে বাঁহাতি রাস্তা ধরে চৌরঙ্গী, হাজরাকাটা, ভূতার মোড়, গড়চক্রবেড়িয়া,গাংড়া হয়ে সোনাচূড়া পৌঁছন তিনি। এই ভাবে একের পর এক বুথ চষে বেড়ানো। না, কোথাও বাধা নেই, কেউ তাড়া করেনি, কেউ আটকে রাখেনি কোথাও!
ততক্ষনে সারা দুনিয়া রাষ্ট্র হয়ে গেছে খবর, মুখ্যমন্ত্রীকে একটা বুথে ঢুকিয়ে রেখে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বাইরে তাঁরই একদা শুভেন্দু বাহিনীর দাপট চলছে।

খবরটা মীনাক্ষীও শুনেছেন। আরও শুনেছেন শুভেন্দু আবার মুখ্যমন্ত্রী বাহিনীর দাপটে বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন! মীনাক্ষী অবশ্য সেসব গ্রাহ্য করেননা। তিনি জানেন, ভোটে যাইহোক এমনিতে তাঁকে বাধা দেওয়ার কেউ সাহস পাবেনা। সবকিছুর বাইরে গিয়েও নন্দীগ্রাম জেতা হয়ে গেছে তাঁর। নির্দ্বিধায় তিনি ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন বুথে। এর পর সাময়িক বিরতি নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়েন। পৌঁছন গোকুলনগরের তেখালিতে। তেখালি থেকে ফের থানা মুখি রাস্তায় বাঁ দিকে পেরিয়ে এলেন জামবাড়ি। ২০০৭ মে মাসে স্ত্রী ভবানীর চোখের সামনে এখানেই খুন হয়েছিলেন মহীতোষ করন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিল যাচ্ছিল বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। উঠোনে দাঁড়িয়েছিলেন মহীতোষ। পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে পুইমাচা থেকে পুইশাক সংগ্ৰহ করছিলেন ভবানী। হঠাৎই মিছিল থেকে গুলি। চোখের সামনে স্বামীকে লুটিয়ে পড়তে দেখেছিলেন। ছেলেটা বাবা বলে চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারেনি। ভবানী ছেলের মুখে চাপা দিলেন। দেখতে পেলে তাদেরও ছাড়বেনা। কারন স্বাক্ষী রাখেনা কমিটি। মিছিলটা ততক্ষনে উঠোনে। একটা চাটাইয়ের ওপর রক্তাক্ত লাশটা বিছিয়ে রোল করে কাঁধে নিয়ে চলে গেল ওরা। সে লাশের আজও খোঁজ মেলেনি। মীনাক্ষী ঘুরে গেলেন সেই বুথেও।

ইতিমধ্যে ফোন এসেছে সামসাবাদ সিপিএম পার্টি অফিস থেকে। ১০ বছর পর লালঝাণ্ডায় পার্টি অফিস সাজিয়েছে কুড়ি একুশের ছেলেরা। ‘দিদি একবারটি আসবেনা?’ মীনাক্ষী উত্তর দেয়, ‘দেখি সময় পেলে যাব।’ কাউকে একটা ফোন করে মীনাক্ষী, কমরেড খোদামবাড়ির খবর কী? ওপাশ থেকে উত্তর আসে, প্রতিটা বুথেই এজেন্ট বসেছে এমনকি গোপালপুরের ৪০নম্বর বুথেও! গোপালপুরেও! নন্দীগ্রামের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই গোপালপুর বুথই দখল করতে এসেছিল শাসক বাহিনী। বাধা দিতে গিয়ে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছিল দুটি দেহ, বছর তিরিশের অপু মান্না আর যজ্ঞেশ্বর ঘোষ! সাথে সাথে বুথ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল সিপিএমের বহু এজেন্টকে। সিপিএম সন্ত্রাসের অভিযোগ করলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফ জবাব, নিজেরা এজেন্ট দিতে পারবেনা, শুধু সন্ত্রাসের অভিযোগ করবে? কী আশ্চর্য! আজ সন্ত্রাসের অভিযোগ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে!

৬৩টা (মুখ্যমন্ত্রী এটাই বলেছেন ) অভিযোগ করে মমতা তখন বয়ালের ৭নম্বর বুথে আটকে রয়েছেন পুলিশ আর নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরা টোপে! এই বাংলায় কোথায় কবে এমন ঘটনা ঘটেছে যে মুখ্যমন্ত্রীকে বুথের বাইরে ২ ঘন্টা ধরে বের করতে ভয় পাচ্ছেন পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী আর মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীরা। ওদিকে হাফ কোম্পানি নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে ফের নন্দীগ্রামেই বিক্ষোভের মুখে নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র। শুধু মীনাক্ষী মুখার্জী একাই চষে বেড়াচ্ছেন সারা নন্দীগ্রাম। কেউ বাধা দিচ্ছেনা, কেউ গো-ব্যাক বলছেনা। বরং কোথাও কোথাও বুথে ঢুকলে সসম্ভ্রমে দলমত নির্বিশেষে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেছে পোলিং এজেন্টদের। এরই মধ্যে একটা টুলে বসে অন্য টুলে থালা রেখে দুমুঠো খেয়ে নিয়েছেন। যে সব বুথ টার্গেটে ছিল তার সমস্ত কভার করেই বেলা সাড়ে তিনটের মধ্যেই মীনাক্ষী ফিরে গেছেন সেই দলীয় দপ্তরে।

তাঁর জন্য মিডিয়ায় সময় বরাদ্দ নেই। মুম্বাই, দিল্লি কলকাত্তা ওয়ালা মিডিয়া তখনও বয়ালের দাঁত মুখ খিঁচানো লড়াই দেখাতে ব্যস্ত। তারই মধ্যে এক আধজন মিডিয়া আসে তাঁর কাছে। এরা ছোট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার দল। মীনাক্ষী তাঁদের বলেন, বিধানসভা কেন্দ্রের সব বুথে মোটামুটি আমাদের এজেন্ট বসেছে। আগের তুলনায় বেশ কিছুটা ভয় ভেঙে মানুষ ভোট দিয়েছেন। তবে এখনই বলতে পারছি না যে, সব মানুষ ভোট দিয়েছেন। সব মানুষ নির্দ্বিধায়, বিনা আতঙ্কে, বিনা প্রভাবিত হয়ে ভোট দিতে পেরেছেন, তা-ও বলতে পারব না। কারণ বিগত ১০ বছরে যে ভাবে তৃণমূল এবং তৃণমূল থেকে গিয়ে যারা বিজেপি, তাদের যা সন্ত্রাস ছিল, সেই সন্ত্রাসের কারণে এখানে একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ।’’ মুখ্যমন্ত্রী আর শুভেন্দুকে খোঁচা দিয়ে মীনাক্ষী জানালেন, হেভিওয়েটরা আজ কেমন যেন লাইটওয়েট হয়ে গেলেন কোথাও কোথাও। সারা নন্দীগ্রাম ঘুরলাম। ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও পাঁচ-ছশো-সাতশো জমায়েত করা এটাকে যদি শান্তিপূর্ণ ভোট হয় তবে এটা শান্তিপূর্ণ ভোট বই কী।’’ নির্বাচন কমিশন এ কথার মানে বুঝবে কিনা কে জানে?
নন্দীগ্রামে নিজের লড়াইয়ে আপাতত বিরতি মীনাক্ষীর কিন্তু এবার যে বাংলার জন্য লড়াই শুরু সেটাও জানিয়ে দিল মেয়ে। তার ঘরের পাশেই লড়ছে ঐশী। রয়েছে দীপ্সিতা, পৃথা, সৃজন, প্রতীক-উর সহ আরও অনেকে। নন্দীগ্রামের লড়াইয়ে পোড় খাওয়া মীনাক্ষীর লড়াই এবার তাঁদের জন্য, সারা বাংলার জন্য। যখন যেখানে পার্টি বলবে। কয়েকদিন বিশ্রাম নেবেননা? নাগরিক গন্ধহীন লাল সালোয়ার বলে ওঠে, ২রা মেয়ের আগে কোনোও বিশ্রাম নেই।

RELATED ARTICLES

Most Popular