Homeএখন খবরভোট মিটতেই নারায়নগড়ে স্বমহিমায় তৃনমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! নিজের থানা ছেড়ে অন্য থানায় ডেরা...

ভোট মিটতেই নারায়নগড়ে স্বমহিমায় তৃনমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব! নিজের থানা ছেড়ে অন্য থানায় ডেরা বেঁধেছে ২৫টি ‘লক্ষী’ছাড়া পরিবার

নিজস্ব সংবাদদাতা: এক আধটা পরিবার নয়, প্রায় ২ডজন পরিবার ভিটে মাটি ছেড়ে নিজেদের থানা এলাকার বাইরে গিয়ে ডেরা বেঁধেছে অন্য থানা এলাকায়! স্বাধীনতার পরে তো বটেই মায় কথায় কথায় ‘৩৪ বছরের’ অত্যাচারী বাম জামানাতেও এমন হয়নি বলে ঢোঁক গিলছেন নেতারা। যে অত্যাচারে তৃনমূলের এক গোষ্ঠীর হাতে অতিষ্ট হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নিজের ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে তৃনমূলেরই লোকজনদের! না, প্রায় পক্ষকাল ধরে নদী আর জঙ্গলের পাড়ে তাঁবু টাঙিয়ে বসত করা মানুষগুলোর পাশে এখন কেউ নেই! বিজেপি নয়, সিপিএম নয় এরা সব্বাই তৃনমূল সমর্থক বলেই পরিষ্কার জানিয়ে তৃনমূলের দিয়েছেন ব্লক কমিটির নেতাই। ঘটনাস্থল পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়নগড় ।

এই নারায়নগড় থানা এলাকারই মকরামপুর গ্রামপঞ্চায়েত বা স্থানীয় ভাষায় ১নম্বর অঞ্চল।  মকরামপুরের নাম পশ্চিমবঙ্গ ছড়িয়ে জাতীয় স্তরে উঠে এসেছিল ২০১৮ সালে। তৃনমূলের অঞ্চল কার্যালয়ে বিস্ফোরনে মৃত্যূ হয়েছিল ৩ তৃনমূল কর্মীর। যে মামলা বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারাধীন। নিজের দলেরই নেতাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন তৃনমূল সমর্থক পরিবারই, সুবিচারের আশায়। যদিও এরপরেও বোমা বিস্ফোরণ থামেনি মকরামপুর, থামেনি একের পর এক তৃনমূল কর্মীর লাশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। সেই মকরামপুরেরই বিভিন্ন গ্রামের ওই পরিবার গুলি ঘরদোর ছেড়ে বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন কেলেঘাই নদীর পাড়ে ধানঘরি মৌজায় যা খড়গপুর গ্রামীন থানা এলাকার মধ্যে পড়ে।

এই অস্থায়ীবাসে থাকা বৃদ্ধ বৃদ্ধা শিশু সহ সংখ্যাটি মিলিয়ে শতাধিক মানুষের দাবি ২ মে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই চলেছে অসহনীয় অত্যাচার, বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, জরিমানা এবং মারধর। করছেন বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই মকরামপুর অঞ্চল কমিটির সভাপতি লক্ষীকান্ত সিট ও তার লোকেরা। আর যাঁরা ঘর ছেড়ে তাঁরা প্রাক্তন সভাপতি বর্তমান ব্লক নেতা নাকফুড়ি মুর্মুর অনুগামী। তাঁদের একটাই অপরাধ তাঁরা লক্ষ্মী সিটের অনুগামী নয়, তাঁরা আসলে ‘লক্ষী’ছাড়া! ঘরছাড়া মানুষদের দাবি তারাও তৃণমূল করেন কিন্তু যেহেতু তাঁরা বিধানসভার আগে দলের লক্ষ্মী বন্দনাকে মেনে নিতে পারেননি তাই তাঁদের ওপর এই অত্যাচার চলছে। ঘরবাড়ির বাসন কোসন থেকে শুরু করে গৃহপালিত পশু অবধি লুট করে নেওয়া হচ্ছে।

যদিও এই দাবিকে বেমালুম উড়িয়ে দিয়ে লক্ষ্মীকান্ত সিট বলেছেন, “এসবই মিথ্যা কথা। ওরা সবাই বিজেপির লোকজন। ওদের আক্রমনে আহত হয়েছেন আমাদের লোকজন। আমার নিজের দাদা তির বিদ্ধ হয়েছে। সেই ঘটনায় মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকেই গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে পালিয়েছে সবাই।” সত্যি অবশ্য এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। গ্রামছাড়া এক ব্যক্তি স্বীকার করেছেন, দিনের পর দিন ‘লক্ষ্মী’ছাড়া সমর্থক পরিবার গুলির ওপর হামলা আর লুটপাটে বীতশ্রদ্ধ হয়ে হামলা চালানোর সময় লুকিয়ে একজন হামলাকারীদের ওপর তির ছুঁড়েছিল। সেই তিরে আহত হয়েছেন লক্ষীকান্ত সিটের দাদা বীরেন বাবু। অভিযোগ সেদিন লুটপাটের নেতৃত্বে ছিলেন তিনিই। মামলা একটি দায়েরও হয়েছে বটে কিন্তু তার জন্য নারী শিশুরা পালাবে কেন? আর কেনই বা ভিন্ন গ্রামের লোকেরা পালাবে? যদিও নাকফুড়ি মুর্মু দাবি করেছেন, মিথ্যা কথা এরা প্রত্যেকেই তৃনমূল সমর্থক।

দাবি এবং পারস্পরিক দাবির ছাড়াও যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা’হল ২০১৮ সালের কুখ্যাত সেই বোমা বিস্ফোরনের পরেই দলের সম্মান ও এলাকার ক্রোধ থেকে দলকে বাঁচাতে লক্ষীকান্ত সিটকে সরিয়ে সভাপতির পদে আনা হয় নাকফুড়ি মুর্মুকে। ক্ষমতা লাভের পরেই একদিন লক্ষ্মীকান্তকে ধরে তাঁকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ ওঠে নাকফুড়ি র লোকেদের মধ্যে। ঠিক লক্ষ্মীকান্ত যে কায়দায় বিরোধীদের মারধর করত সেই একই কায়দায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় লক্ষীকান্তর পা। অত্যাচার নেমে আসে ‘লক্ষ্মী’প্রিয়দের ওপর। বাদ যায়নি লক্ষ্মীর দাদা, ভাইপো সহ অন্যান্য আত্মীয়রা। মারধর, ভাঙচুর, লুটপাট চলে সেই সময়ও। দলে কোন ঠাসা লক্ষ্মী অনুগামীদের বিরুদ্ধে তখন বিজেপি যোগের অভিযোগ এনে এই কান্ড চালিয়েছিলেন নাকফুড়ি অনুগামীরা।

২০১৯ লোকসভায় বিজেপি ভালো ফল করে এই এলাকায়। নাকফুড়িকে কাজ হচ্ছেনা ধরে নিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে ফের লক্ষ্মীকান্তর পুনর্বাসন হয়। আর তখন থেকেই শুরু হয়ে ‘লক্ষ্মী’হীন বা ‘লক্ষ্মী’ছাড়াদের ওপর হামলা। যদিও পার্টি যেটা বুঝতে পারেনি তা’হল লক্ষ্মীর পুনর্বাসন মেনে নিতে পারেননি মকরামপুর এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষও কারন সেই ২০১৮ সালে ৩টি প্রানের বিসর্জন। মানুষ এখনও দৃঢ় ভাবেই বিশ্বাস করেন এলাকায় বোমা-বন্দুক রাজের নায়ক লক্ষ্মীকান্তই। ফলে এই অঞ্চলে দুহাজারের কাছাকাছি ভোটে পরাজিত হয় তৃনমূল। অভিযোগ সেই পরাজয়ের রাগ মেটাচ্ছেন লক্ষ্মীকান্তর অনুগামীরা। আর তার মাশুল দিচ্ছেন হতভাগ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু-কিশোর, গৃহবধূরাও। রাজায় রাজায় যুদ্ধে কিভাবে উলুখাগড়ার প্রাণ যায় তা দেখার জন্য একবার যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন কেলেঘাই নদীর সেই পাড়টিতে। যদি সন্ধ্যা হয়ে যায় মনে হবে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর শশ্মানভূমিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে আছে কিছু মানুষ, যাদের এখন ভারতের নাগরিক বলা হয়।

RELATED ARTICLES

Most Popular