Homeঅন্যান্য১১ বছর চার্জ গঠনই হয়নি! বকেয়া আরও ২০টি মামলা, মামলা মুক্ত নন...

১১ বছর চার্জ গঠনই হয়নি! বকেয়া আরও ২০টি মামলা, মামলা মুক্ত নন ছত্রধর, সব মামলাতেই এখন NIA চাইছে জঙ্গল মহল

নিত্য গুপ্ত: ২০০৯ সালের রাজধানী এক্সপ্রেস আটকানো কিংবা লালগড়ের প্রবীর মাহাত খুনের মামলায় এখনো চার্জ ফ্রেম করেনি রাজ্য ! রাজধানী এক্সপ্রেস সহ তাঁর চালক, গার্ড ও যাত্রীদের পনবন্দি হিসাবে ব্যবহার করে জেল বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য মাওবাদীদের দর কষাকষি করার মত এত বড় সন্ত্রাসবাদী কাজের আজ অবধি চার্জ ফ্রেম হয়নি দেখে অবাকই হয়েছেন NIA কর্তারা। পাশাপাশি অবাক হয়েছেন লালগড়ে ধরমপুরে সিপিএম নেতা অভয় মাহাত খুনের মামলাতেও একই কান্ড দেখে। কিন্তু শুধু এরকমই নয়, খুঁজে দেখা যাচ্ছে ছত্রধর মাহাতের বিরুদ্ধে এরকমই প্রায় ২০টি মামলা রয়েছে যা যথাযথ পুলিশি তত্বাবধানের চাপা পড়ে আছে। অর্থাৎ ছত্রধর মাহাতকে যে ‘বেকসুর’ বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে তা আদৌ নয় তিনি আসলে ৩২টি মামলার ১০ থেকে ১২টি মামলায় পার পেয়েছেন আর একটি মামলায় যাবজ্জীবন হওয়ার পরেও রাজ্য সরকার বা শাসকদলের বদান্যতায় মেয়াদ শেষের আগেই রেহাই পেয়েছেন মাত্র কিন্তু জঙ্গল মহলের তাবৎ খুন, জখম, অগ্নি সংযোগ, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, রাষ্ট্রদ্রোহ ইত্যাদি যা যা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তার সব অভিযোগ থেকে মুক্ত নন তিনি। যেমনটা তিনি মুক্ত নন রাজধানী এক্সপ্রেস আটকানো কিংবা প্রবীর মাহাত খুনের অভিযোগ থেকে।

ছত্রধর মাহাতর প্রায় সমস্ত মামলায় তাঁর পক্ষ নিয়ে আইনি লড়াই করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী কৌশিক সিনহা। শুধু ছত্রধরই নয় বলা যেতে পারে সরকারের দায়ের করা মাওবাদী বিরোধী মামলার অধিকাংশই লড়েছেন তিনি। অবশ্যই
সরকারের বিরুদ্ধে। কেন এই মামলা দুটির চার্জ ফ্রেম করতে এত দেরি হচ্ছে এর জবাবে কৌশিক বলেন, ‘ রাজধানী এক্সপ্রেস মামলায় ৩২জন আসামি রয়েছেন সবার সব কিছু জড়ো করে চার্জ ফ্রেম হতে সময় লাগছে। মাঝখানে ঝাড়গ্রাম নতুন জেলা হয়েছে, আদালত পরিবর্তিত হয়েছে। ইত্যাদি নানা কারণে দেরি হয়েছে কিন্তু এখন মামলা দুটি চার্জ গঠনের দোর গোড়ায়।” কৌশিক আরও জানিয়েছেন, “২০১০ সালেই দুটি মামলায় চার্জশিট দিয়ে দিয়েছিল পুলিশ।” অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে আগের সরকারের যে সদিচ্ছা ছিল বর্তমান সরকারের তা নেই।

প্রশ্ন উঠছে বকেয়া মামলা গুলো চালিয়ে যেতে সরকারের গড়িমসি কেন? উত্তরটা খুবই সহজ, ছত্রধরের মুক্তির পথ প্রশস্থ করা। এই মামলা গুলি চলতে থাকলে ছত্রধর জেল থেকে বের হতে পারতেন না। একটার পর একটা মামলা চলতে থাকলে সারা জীবন জেলেই কাটাতে হত থাকে। কিন্তু বর্তমান সরকারের দায় ছিল ছত্রধরকে মুক্ত করার কারন ২০১১ সালে জঙ্গলমহলে যে দুটি শ্লোগানকে সামনে রেখে তৃনমূল জন সাধারনের কমিটি বা মাওবাদীদের সমর্থন পেয়েছিলেন, যে কারনে কিষানজী মমতা ব্যানার্জীকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন তার একটি হল জঙ্গলমহল থেকে যৌথ বাহিনীর প্রত্যাহার আর একটি হল বন্দীমুক্তি। বলা বাহুল্য দুটোর কোনটাই এই সরকার করেনি কিন্তু আলাদা করে ছত্রধরের জন্য সরকার ভেবেছেন। কেন ভেবেছেন তা কারুরই অজানা নয় অন্তত এই কারনটা তো সবাই মানেন যে হয়ত এই কারনেই যে ছত্রধর মাহাতই রক্তস্নাত জঙ্গলমহলে মমতা ব্যানার্জীর জন্য কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু আইন তো আর প্রেম ভালবাসার কথা শুনবেনা। জঙ্গলের যে চারশ পরিবার তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে খুন হতে দেখেছেন অথবা যাঁদের লাশ গুম হয়ে গেছে তাঁরা বিচার পাবেননা? বিচার না পেয়ে পেয়ে হতাশায় ডুবে যাওয়া সেই মানুষগুলো আজ NIA তদন্তে আশার আলো দেখছে। রাতের বেলায় চোখের সামনে একমাত্র ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়া আর সকালে সেই ছেলের লাশ দেখার পর বিচার চেয়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ এখন এটুকু স্বান্তনা অন্ততঃ সান্তনা পাচ্ছেন যে মরার আগে বিচারটা পেয়ে যাবেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে ছত্রধর মাহাত কী খুন করেছেন? জঙ্গলমহল বলছে তারও চেয়ে বড় অপরাধ করেছেন তিনি, রাস্তার মুখে পুলিশকে আটকে রেখে গ্রামের ভেতরে মাওবাদীদের মানুষ খুন করতে, ঘরবাড়ি জ্বালাতে, লুট করতে সাহায্য করেছেন। এটা খুনের চেয়ে কোনও কম অপরাধের নয়। এই অপরাধের বিচার দেওয়ার দায়িত্ব কার? সরকারের অপরাধের নয়।

ছত্রধর মাহাত বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে। কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সিবিআই, ইডি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয় এমন নজির ভূরি ভূরি। প্রশ্ন তো উঠবেই এতদিন কী করছিল NIA ? শুধুই তো ছত্রধর মাহাত নন, এরকম অনেকেই আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে, নেতা গিরি করছে, সরকারের দেওয়া চাকরি করছে কোথায় তাঁদের বিরুদ্ধে NIA সক্রিয় নয় কেন? সুচিত্রা, জাগরী সহ ডজন ডজন মাওবাদী রয়েছেন যারা সরাসরি খুন করেছেন বলে অভিযোগ। শিলদার ইএফআর ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে এতজন পুলিশ কর্মীর হত্যা, জ্ঞাননেশ্বরী এক্সপ্রেস নাশকতা কোথায় ছিল NIA ? আজ হঠাৎ ছত্রধর নিয়ে পড়ল কেন তাঁরা? ছত্রধরের ওপর চাপ তৈরি করা নাকি রাতারাতি ছত্রধরকে হিরো তৈরি করা? আজ মুকুল রায়ের মত ছত্রধর মাহাত যদি বিজেপিতে চলে যান তখন আবার সব চুকেবুকেও যেতে পারে হয়ত! সুতরাং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার তত্ত্ব উড়িয়ে দেওয়ার নয় কিন্তু এটাও তো ঠিক যে ছত্রধর যেমন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা বলছেন ঠিক তেমনই রাজনৈতিক সুবিধাও তিনি পেয়েছেন বা পেয়েই চলেছেন। নিজে জেলে রাজার হালে ছিলেন এমনকি আদৌ জেলে ছিলেন নাকি জেলের বিলাস বহুল আবাসনে ছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছেলের চাকরি হয়েছে। স্ত্রী সরকারি কমিটির সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার গতি শ্লথ হয়েছে, সরকারি উকিল যুক্তি তর্ক হারিয়ে তাঁর মুক্তির পথ প্রশস্থ করে দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হয়ে থাকলে সেটা যেমন অন্যায় ঠিক তেমনই তাঁকে রাজনৈতিক যে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে তাও সমান ভাবে অন্যায়।

কেন্দ্র এবং রাজ্যের মাওবাদী আত্মসমর্পণ শর্তে বলা হয়েছিল, আত্মসমর্পণকারি মাওবাদীরা পুনর্বাসন পাবেন কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে যে মামলা রয়েছে সেই মামলা চলবে। সেই মামলায় আইন অনুসারে যা যা প্রক্রিয়া তা চালাবে সরকার। অর্থাৎ সরকার আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের টাকা, চাকরি ইত্যাদি প্যাকেজ দিতেই পারে কিন্তু মামলা গুলো প্রত্যাহার হবেনা। খুনের মামলা, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা যেমন চলছে চলবে আর অন্য পাঁচটা মামলার মত সরকার দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য তদবির করবে। পাশাপাশি মাওবাদীদের হাতে নিহত পরিবারগুলিকেও সরকার নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ দেবে। এরাজ্যে হয়েছে উল্টোটাই। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মামলা শ্লথ করা হয়েছে আর মাওবাদীদের হাতে নিহত পরিবারগুলির সিংহভাগই ক্ষতিপূরণ পায়নি। অর্থাৎ মাওবাদীদের হাতে সর্বস্ব হারানো, প্রিয়জন হারানো মানুষগুলি না পেয়েছেন বিচার, না পেয়েছেন ক্ষতিপূরন। জঙ্গলমহলের স্বাভাবিক ভাবেই এখন বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ছত্রধর তথা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলার তদন্তে NIA কে চাইছেন স্বজন হারানো জঙ্গলমহল। শুধুই অভয় মাহাত নয়, শালকু সরেন, দিবাকর মাহাত থেকে শুরু করে সমস্ত পরিবারই এখন NAI তদন্ত শুরু হয়েছে জানার পর ফের আশার আলো দেখছেন।

RELATED ARTICLES

Most Popular