Homeঅন্যান্যবসন্ত ফেঁসে গেছে

বসন্ত ফেঁসে গেছে

বসন্ত ফেঁসে গেছে   –  তুষার ভট্টাচার্য

রোববার, সাত সকালের বিছানাটার দ্বন্দ্ব এখনও কাটিয়ে ওঠা গেলনা এখনও! মনে হয় আরও অনেকক্ষন থাকি কিন্তু ওদিকে আবার খাসির দোকানে লাইন বাড়তে থাকে! আড় ভাঙতে ভাঙতেই চা চা করে মনটা। ‘আমার কি দশটা হাত?’ গত দেড় যুগ ধরে শুনে আসা সেই কমন প্রশ্নওয়ালি দুটো হাতেরই একটা হাতে চা দিয়ে যায়, মেয়ের পড়ার ঘর থেকে ইউটিউবে গান ভেসে আসে, ” বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা,
কারা যে ডাকিলো পিছে বসন্ত এসে গেছে…” আমার মনে হল যেন শুনলাম, বসন্ত ফেঁসে গেছে…..অসম্ভব নয়, গত তিনদিন ধরেই বৃষ্টি চলছে। ফাল্গুন , দোল, হোলি হ্যায় আর সদ্য ঝেড়ে ঝুড়ে প্যাক করে রাখা ব্ল্যাংকেট আবার নামানো হয়েছে। রাতেও গোড়ালি ভেজা জল পেরিয়ে গেছে রাস্তা দিয়ে , অতএব বসন্ত আসে কোত্থেকে ?

অগত্যা গরম চায়ে চুসকি মারতে মারতে( ও ‘চুসকি’ তো আবার
গুঠকাখোরদের ভাষা। এখুনি বাংলার পক্ষ থেকে চেপে ধরবে। যারা ইংরেজী অনার্সের প্রশ্ন বাংলায় ছাপাতে চায়, তারা কি আমার মতন একজন দেড়েলকে ছেড়ে কতা কইবে?) থুড়ি থুক্কুম…চুমুক মারতে মারতে ভাবছি, আজ একটু অন্য ভাবে রবিবারটা পালন করা যাক। একটু খাসি(আলু সহযোগে, নরম করে রান্না; দাঁত নড়তে শুরু করেছে ত!) বেলা করে একটু বিয়ার সহযোগে রিল্যাক্স করে একটু টেগর…দুপুরে একটা নাতিদীর্ঘ ভাত-ঘুম। আহাঃ জীবন! অহঃ জীবন…
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল, গোল বাধলো টিভিটা চালিয়ে। একটি ব‍্যাংক বন্ধ হতে চলেছে…মানে আবার সেই হুড়োহুড়ি, লাইন, মারামারি… আবার…আবার?
মনে পড়ে গেল “নোট-বন্দী”…
রাত দুটো থেকে লাইন লাগিয়ে বেলা বারোটায় বাজারে ঢুকলাম। ততক্ষনে মাছ পচে পাঁক,সজনে ডাঁটা শুকিয়ে কাঠ। আর সবচেয়ে কষ্ট বুড়ো গুলোর। গরমে হাঁপাতে হাঁপাতে থরথর করে কাঁপা পায়ে কোন রকমে ঠেকনা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে হয়ত নাতি বা নাতনি। নাতি হলে বারবার পান দোকানে দৌড়চ্ছে। আর নাতনি ত নিজের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্যাস্ত মোবাইলে। পেনশন তুলতে লাইন দিয়ে পটলই না তুলে বসে।

এবং আবার কদিন টিভি দাপিয়ে বেড়াবে একটা মুখ… একটা বিশেষ মুখ…
“মিত্রঁওওওও!!!!!”
এবং পাশাপাশি বিশ্লেষণ, কি ভাবে এই ব‍্যাংক বন্ধ করার মাধ্যমে পাশের দেশ পাকিস্তান এবং আমার দেশে বসবাসকারী “ঘুসপেট্টিয়া”-দের টাইট দেওয়া গেছে… বিশদ বিবরন। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মতন বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী আনন্দে দু-হাত তুলে নৃত্য করতে শুরু করবে। টিভি-খবরের কাগজ-মিডিয়া ঘন ঘন দেখাতে থাকবে, চকচকে কপাল, ট্রিম করা দাড়ি, বহুমূল‍্য চশমা, ঘন ঘন পাল্টান দূর্মূল‍্য পোষাক!
জয় জগন্নাথের ৫৪৫ কোটি টাকা রাখা আছে এই ব্যাংক-এ। তুলতে পারবে কেবল ৫০০০০। একেই বলে ঠুঁটো জগন্নাথ।
যাক জগন্নাথ যে রক্ষাকর্তা নয়, এটুকু তো প্রমাণ হলো।
তিরুপতি কিন্তু সুযোগ বুঝে ২০১৯ এই তার ১৩০০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট তুলে নিয়েছে। অবশ্য তিরুপতির অনেক ভক্তদের টাকা আটকে গেছে ঐ ব্যাংক এ। ভাবছি সেই ভক্ত হনুমানদের কথা। এতদিন মগজ খালি থাকলেও পকেটটা অন্তত ভর্তি থাকত। আজ মগজের সাথে সাথে পকেটও খালি হয়ে গেল।

মনে আছে আমাদের অর্থমন্ত্রী পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর সংসদে বলেছিলেন ” আমি ত পেঁয়াজ খাই না”। ভাবছি এবারে কি বলবেন, ” আমি ত ওই ব্যাংকে টাকা রাখি না, স্টেট ব্যাংকে রাখি”। তো সেই ব্যাংকের গতিকও খুব একটা সুবিধা ঠেকছে না। লাইন দিয়ে রয়েছে আরও অনেকগুলো ব্যাংক। সেন্ট্রাল ব্যাংকে তালা ঝুললো বলে। বউ তার বরের পকেট কেটে সেন্ট্রাল ব্যাংকে কিছু জমিয়ে রেখেছে। ত সেদিন বললাম ” ওগো শুনছ! (আমি আবার আমার বউকে ভারী শ্রদ্ধা করি) সেন্ট্রাল ব্যাংক বন্ধ হতে চলেছে।” লাউ-ছেঁচকি রান্না করছিলো। গরম খুন্তি দিয়ে এমন চাবকালো, এখনও পিঠে দাগড়া দাগড়া ফোস্কা পড়ে আছে, সোজা হয়ে শুতে পর্যন্ত পারি না!
যাক! এখন কদিন বাজার এটা নিয়ে বাজার গরম থাকবে। শুধু “করোনা” দিয়ে কুলাচ্ছিল না।
এবং… এবং আমরা ভুলে যাবো সাম্প্রতিক দিল্লির পরিকল্পিত গণহত্যা ( মিডিয়া যাকে “দাঙ্গা” বলে চালাতে চেয়েছে), জে এন ইউ, জামিয়া-মিলিয়া, যাদবপুরের বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলোর দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা না-ছোড় লড়াই, পুলিশকে সাক্ষী-গোপাল সাজিয়ে রাতের অন্ধকারে তাদের উপর লুম্পেনদের আক্রমণ, হস্টেলে রাতে পুলিশের নির্লজ্জ্ব আক্রমণ,গরীবি ঢাকতে বস্তির গায়ে পাঁচিল তুলে দেওয়া,কাশ্মিরকে একঘরে করে দেওয়া,ক্যা ক্যা ছি ছি, ভুবনেশ্বর-এ দাদা-ভাইদের সঙ্গে মিটিং-ইটিং-সেটিং…ইত্যাদি, প্রভৃতি।

বাজারী সংবাদ মাধ্যমে ‘করোনা ভাইরাস’ ‘Hot Cake’ এর মতো বিক্রি হচ্ছে। কারণ – রাজনীতিকরা খাচ্ছে । কত জন আক্রান্ত ? কত জন মারা গেছে ?

কিন্তু দেশের মধ্যে ‘মেরোনা ভাইরাস’ মহামারির রূপ নিয়েছে । দাঙ্গায় কত লোক আক্রান্ত ? কত জন মারা গেছে ? রাজনৈতিক হিংসায় আক্রান্ত কত জন ? কত জন মারা গেছে ? রাজনৈতিক দলগুলো’র অন্তর্দ্বন্দ্বে কত জন আক্রান্ত ? কতজন মারা গেছে ? সব, সব ভুলে যাব। ভুলে যাব, সে একদিন ছিল, যখন আমার মেরুদন্ড নামক একটা বস্তু ছিল, আমি নিজেকে মানুষ বলে জানতাম। আজ ক্রমশ আমি ক্রিমি-কীটে পরিনত হয়ে চলেছি! “মেটামরফোসিস” নাটকে গ্রেগর সামসা কীটে রূপান্তর ঘটে যেতে নিজেকে ঘরে বন্দী করে ফেলে লজ্জ্বায়। অবশ‍্য নাটক-গল্প ও সবে একটু লজ্জ্বা-টজ্জা দেখাতে হয়, না হলে ঠিক জমে না।

কিন্তু জীবনটা’ত আর নাটক নয়। এখানে অভিমন্যুকে সপ্ত-রথীর হাতে অন‍্যায় বধ হতে দেখেও আমরা হাত-তালি দিই। না দিয়ে উপায় নেই! কারন, না হলে “গোলি মারো শালোঁকো”। কে আর সাধ করে “দেশকি গদ্দার” হতে চায়।
তার চেয়ে “এই বেশ ভালো আছি”। বেঁচে থাক আমার বসন্ত, বেঁচে থাক আমার গরম উলের আদর, বেঁচে থাক আমার ১০টা-৫টা চর্বিত-চর্বণ, বেঁচে থাক আমার রবিবারের খাসি, আমার সখের টেগর, মাঝরাত্তিরে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কম্বলের তলায় মিঠে-অশ্লীল খুনসুটি।
এই ভাবেই কাটিয়ে দিই আরও কয়েক বছর…

কোন এক কবি লিখেছেন…”প্রেসিডেন্ট দ‍্য গলকে যখন প্রথম গুলিটি ছোঁড়া হল, দ‍্য গল তখন নিচু হয়ে একটা বাচ্চাকে আদর করছিলেন। গুলিটা তার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু বেরিয়ে গেল কোথায়? আমাদের দিকে আসছে না ‘ত!”….

RELATED ARTICLES

Most Popular