Homeসাহিত্যরবিয়াণীঅন্ধকারের আলোর সন্ধান -১৩

অন্ধকারের আলোর সন্ধান -১৩

✒️কলমে: অভিজিৎ রায়
——————————————
দুই।।

কবিতার লাবণ্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক পরম মমতার আশ্রয়। যে আশ্রয়ের সন্ধানে যেমন অবসাদগ্রস্ত হৃদয় থাকে, তেমনই বিরহ যন্ত্রণা ধারণকারী এক মন। যে আশ্রয় প্রতিবাদী মননের উত্তেজনাকে সাহস যোগায় আর বিপ্লবের আগুন উসকে দেয় আন্দোলনের বুকে। এই লাবণ্য বঞ্চিত শব্দাবলী দিয়ে যে বাংলা কবিতার আত্মাকে ধরে ছুঁতে পারবে না তা অনেকেই জানেন না। কবিতাচর্চার শুরুটাই যাদের ছন্দহীন আর যাদের হৃদয়ে ছন্দ শিক্ষার কোনো আগ্রহ তৈরি হয় না বা অগ্রজরাও তাদের ছন্দ শিখতে উৎসাহিত করেন না সেখানে কবিতা পাঠের জগৎ ক্রমশ ছোটো হতে হতে মুঠোফোনে বন্দী হতে বাধ্য। লকডাউনের পরবর্তী প্রভাব হিসাবে এটা যে অবশ্যম্ভাবী তা বোঝা যাচ্ছে প্রতিদিন সন্ধের পরে ফেসবুক লাইভে কবিতা পাঠ এবং কবিসম্মেলনের আয়োজন দেখে। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে বিভিন্ন মঞ্চে কবিসম্মেলনের গড় উপস্থিতি যেমন পঞ্চাশের ধারেকাছে তেমনি ফেসবুক লাইভের এইসব অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা কুড়ি থেকে তিরিশ। এবং কমেন্ট লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে দর্শক-শ্রোতাদের বেশিরভাগই কবি এবং যিনি পাঠ করছেন তার অনুগামী অথবা বন্ধু। বিভিন্ন মঞ্চের কবিসম্মেলনে অনেকদিন ধরেই এই ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে এবং এ নিয়ে কবিদের বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র তারাই মাথা ঘামান যাঁরা অনুষ্ঠানের শেষ দিকে কবিতা পড়েন। অনেকক্ষেত্রেই এরকম অনুষ্ঠানের শেষে জনা পাঁচেক শ্রোতা নিয়েও কবিতা পড়তে দেখেছি বহুবার। একজন উদ্যোক্তা, একজন মাইকম্যান আর দু-তিনজন চক্ষুলজ্জা আছে এমন কবি।

বাংলা কবিতার এই দুর্দিনেও গোয়েবেলসের তত্ত্ব ভেজে নবীন থেকে প্রবীণ কবিরা সবাই এই প্রমাণে ব্যস্ত যে তাদের মধ্যে কাদের বই কত দ্রুত দ্বিতীয় সংস্করণের দিকে দৌড়াচ্ছে! এই গল্পগুলো জোড়া লাগালেই আমরা বুঝতে পারি পাঠককে নির্বোধ প্রমাণ করতে থাকা কবির দল বাংলা কবিতার যে ক্ষতিটি করেছেন তার মূল দিক হল বাংলা কবিতা থেকে পাঠককে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। এখন পাঠকস্বল্পতার যে সমস্যা নিয়ে কবিরা ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত হচ্ছেন এবং বাইরে সে প্রসঙ্গ আনতে লজ্জা পাচ্ছেন সেই সমস্যা হয়ত আগেও ছিল কিন্তু সেই সময়ের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে কবির সংখ্যা। পকেটের কড়ি দিলেই যখন বই প্রকাশ সম্ভব তখন বই ছাপিয়ে কবিদের হাতে তুলে দিয়ে একটা সেলফির মাধ্যমে সামাজিক সম্মান একটু বাড়িয়ে নিলে ক্ষতি কী? বরং জং পড়ে যাওয়া দাম্পত্য সম্পর্কে বা প্রেমিকার কাছে একটু বেশি ভাঁও খেতে এ তো সামান্যই ব্যাপার। ক্রাইসিস বাড়িয়ে দিল প্রিন্ট অন ডিমান্ড টেকনোলজি। দশ বা কুড়ি কপি বই ছাপিয়ে বাঙালি তরুণেরা যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল তেমনই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কেরানি ও আমলারাও কবি হবার দৌড়ে ঝাঁপিয়ে এবং প্রিন্ট অন ডিমান্ডে বই ছাপিয়ে বাংলা কবিতার জগতে জঞ্জাল উৎপন্ন করতে থাকলেন।
আজ এত দিন পর সেই সমস্যা ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পাঠক বই হাতে তুলেছেন কখনো অনুরোধে আবার কখনো উপরোধে এবং বারংবার তার মনের আরাম, জীবনের আশ্রয় হিসাবে বাংলা কবিতাকে না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন এর থেকে বাঁচার উপায় থাকলেও লাখ লাখ কবিসম্মেলনে কোটি টাকা খরচ হলেও পাঠক সমাবেশ নিয়ে কেউ চিন্তিত নন। এমনকি বাংলা কবিতার স্বাস্থ্য উদ্ধারে নিয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কবিতা একাদেমিও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত উদাসীন। গুটিকয় পাঠক এখনও যে বাংলা কবিতা পড়েন তা নিতান্তই উল্লেখযোগ্য কবিদের ক্ষেত্রে ভাগ্যের ব্যাপার।

RELATED ARTICLES

Most Popular