Homeসাহিত্যরবিয়াণীস্বদেশ-সম্পাদনা-রবীন্দ্রনাথ

স্বদেশ-সম্পাদনা-রবীন্দ্রনাথ

✍️কলমে: অরূপম মাইতি

(পর্ব–৪)

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। এমনই একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তিনি। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন
“…বড়দাদাকে সম্পাদক করিয়া জ্যোতিদাদা ভারতী পত্রিকা বাহির করিবার সংকল্প করিলেন। এই আর একটা আমাদের উত্তেজনার বিষয় হইল। আমার বয়স তখন ঠিক ষোলো। কিন্তু আমি ভারতীর সম্পাদক চক্রের বাহিরে ছিলাম না।”
তত দিনে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং তত্ত্ববোধিনী সভার সদস্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার উদ্দেশ্যে অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ, ১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট) শুরু হয়েছে। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ধর্মপ্রাণ ও দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাটিকে বলিষ্ঠ রূপে গড়ে তুলতে। ওদিকে ঠাকুরবাড়ির অনুজেরা ধর্মের থেকে বেশি অনুরাগী ছিলেন সাহিত্যে। এই প্রেক্ষিতে নতুন একটি পত্রিকা রূপে আত্মপ্রকাশ করে ‘ভারতী’।
প্রথমে দ্বিজেন্দ্রনাথ পত্রিকার নাম রেখেছিলেন ‘সুপ্রভাত’। এই নামে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আপত্তি ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, নামটির মধ্যে একটি স্পর্ধিত ভাব লুকিয়ে আছে। শুনলে মনে হয়, বঙ্গসাহিত্যের সুপ্রভাত অর্থাৎ সূচনা যেন তাঁরাই করলেন। নাম পরিবর্তন করে ‘ভারতী’ নাম রাখতে বাধ্য হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী চৌধুরাণী, ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকালের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন
“সে সময় প্রতি রবিবারে জ্যোতিবাবু ও রবীন্দ্রনাথ ভারতীর ভাণ্ডার লইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়া ‘ভারতী’ সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন ও পরে ‘তাঁহাকে’ লইয়া বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাশয়ের বাটীতে যাইতেন এবং সেখান হইতে জোড়াসাঁকো ফিরিয়া যাইতেন।”
[‘ভারতীর ভিটা’ শরৎকুমারী চৌধুরাণীর রচনাবলী]
১৮৭৭ সালের জুলাই (বঙ্গাব্দ ১২৮৪ শ্রাবণ) দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ভারতী আত্মপ্রকাশ করে। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পাদক না হলেও প্রকৃতপক্ষে ভারতী জ্যোতিবাবুরই মানসকন্যা।”
প্রথম সাত বছর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১২৮৪-১২৯০) ভারতী সম্পাদনা করেছেন। পরবর্তীকালে স্বর্ণকুমারী দেবী (১২৯১-১৩০১), হিরণ্ময়ী দেবী (১৩০২-১৩০৪), রবীন্দ্রনাথ (১৩০৫), সরলা দেবী (১৩০৬-১৩১৪), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৩১৫-১৩২১), মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৩২২-১৩৩০) এবং সরলা দেবী (১৩৩১-১৩৩৩, কার্তিক) প্রমুখ একাধিক ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের সম্পাদনায় ভারতী দীর্ঘ ৫৯ বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির স্বনামধন্য লেখক-লেখিকারা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন পত্রিকার সঙ্গে। আত্মপ্রকাশ সংখ্যায়, পত্রিকার উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল
“ভারতীর উদ্দেশ্য যে কি তাহা নামেই প্রকাশ। ভারতীর এক অর্থ বাণী, আর এক অর্থ বিদ্যা, আর এক অর্থ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। বাণীচ্ছলে স্বদেশীয় ভাষার আলোচনাই আমাদের উদ্দেশ্য। বিদ্যাস্থলে বক্তব্য এই যে, বিদ্যার দুই অঙ্গ, জ্ঞানোপার্জন এবং ভাবস্ফুর্তি। উভয়েরই সাধ্যানুসারে সহায়তা করা আমাদের উদ্দেশ্য। স্বদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাস্থলে বক্তব্য এই যে, আলোচনার সময় আমরা স্বদেশ বিদেশ নিরপেক্ষ হইয়া যেখান হইতে যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তাই নতমস্তকে গ্রহণ করিব। কিন্তু ভাবালোচনার সময় আমরা স্বদেশীয় ভাবকেই বিশেষ স্নেহদৃষ্টিতে দেখিব।”
প্রথম দিকে উনচল্লিশ বছর, ভারতী পত্রিকার কার্যালয় ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। রামভূজ দত্তচৌধুরীকে বিয়ে করে, সরলা দেবী পাঞ্জাব চলে যাওয়ার সময় ভারতীর সত্ত্ব দিয়ে যান মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। ১৯১৫ সালে ঠাকুরবাড়ির ঠিকানা থেকে ভারতী-র কার্যালয় উঠে আসে ২২ নং সুকিয়া স্ট্রিটে (কৈলাস বসু স্ট্রিট)। নলিনীকান্ত সরকারের লেখা থেকে জানা যায়, তিনতলা এই বাড়ির এক তলায় ছিল কান্তিক প্রেস, দোতলায় ছাপাখানা আর তিন তলায় ভারতী-র কার্যালয়। কান্তিক প্রেস ও ভারতী, উভয়েরই মালিক ছিলেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়।
ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত হয়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাস এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা রচনা। ভারতীর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশীয় আলোচনা, জ্ঞানোপার্জন ও ভাবসমৃদ্ধিতে সাহায্য করা। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থ সমালোচনারও দুঃসাহস করেছিল ভারতী। রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প ‘ভিখারিণী’, বড় গল্প ‘করুণা’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ ও ‘কবিকাহিনী’-র কবিতাগুলি ভারতী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায়, ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগে ছোটদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। এক বছর চলার পরে, বালক পত্রিকাটি ভারতীর সাথে মিশে গিয়ে পত্রিকার সাময়িক নামকরণ হয়েছিল ‘ভারতী ও বালক’। বিদেশি পত্রিকার আদলে ভারতী পত্রিকায় একাধিকবার বারোয়ারি উপন্যাস রচনার আয়োজন করা হয়। এই পত্রিকায় প্রকাশিত রচনার মান অত্যন্ত উন্নত ছিল। ভারতীর সত্ত্ব হস্তান্তরের পরে, মণিলালের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যিক বন্ধু সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। দুই বন্ধুর যুগ্ম সম্পাদনায় কান্তিক প্রেস থেকেই নবপর্যায় ভারতী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ করেছিল। সে সময় ভারতীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রানুসারী ‘ভারতী গোষ্ঠী’।
ভারতী গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, অসিতকুমার হালদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, চারুচন্দ্র রায়, করুণাধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁরা ছাড়াও এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মোহিতলাল মজুমদার। শরৎচন্দ্রের বড়দিদি, ১৩১৪ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল।

(ক্রমশঃ)

RELATED ARTICLES

Most Popular