অণুগল্প

✍️কলমে: পারমিতা

 

অভয়া

বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সুমি টিভি খুলে বসে। অমর সিগারেটে একের পর এক সুখটান দিচ্ছে। ধোঁয়ার গোলক নাক মুখ দিয়ে নির্গত হয়ে বাতাসে মিশে গিয়ে পরিবেশকে ধোঁয়াময় করে তুলছে। টিভিতে একটা বিয়ের সিন দেখতে দেখতে সুমি বলে
— আমাদের মেয়ে তো অনেক বড় হয়ে গেল গো।এবার একটা সৎ পাত্রে দিতে পারলে …
এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মোবাইলে চোখ থাকলেও অমরের কান এড়ায় না কথাগুলো।
— ঠিকই বলেছ। দেখতে দেখতে অর্ণা চব্বিশ হয়ে গেল। এই তো সেদিনের কথা যখন….
বলেই চলল অমর । একের পর এক ছবি চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

বৃষ্টির রাত। এক দম্পতি গাড়ি করে ফিরছিল বিয়ে বাড়ি থেকে। দু’জনে বিয়ে বাড়ির গল্পে মশগুল। রাস্তা ঘাট শুনশান। একটা গা ছমছম পরিবেশ। হঠাৎ গাড়ির সামনে এসে পড়ে একটা বছর সাতেকের মেয়ে। জোরে ব্রেক কষে কোনোরকমে একটা দুর্ঘটনা থেকে এড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে ওই দম্পতি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে ওর নাম, ঠিকানা। এতো রাতে ওখানেই বা ও কী করছে জানতে চাইলে মেয়েটি বলে
–আমার মাকে কয়েকটা লোক মেরে ফেলেছে।আমাকেও ধরতে আসছিল। আমি পালিয়ে এসেছি।
রহস্যের গন্ধ ভরা একটা পরিবেশ। প্রথমে ভদ্রলোক এ বিষয়ে আর এগোতে রাজি না হলেও বিবেক ক্রমশই ওর পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। অবশেষে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে সোজা চলে যায় থানায়।

থানায় গিয়ে বড়বাবুকে সব খুলে বলে তারা। মেয়েটিকে নাম জিজ্ঞেস করলে ও বলে ওর নাম চাঁপা। ঠিকানা ও ঘটনা শুনে বড় বাবু বলে ওঠেন
–ঠিক আছে দেখব। তবে কী জানেন তো এইসব কেস আকছার ঘটছে। ওদের কি কম দোষ নাকি !

বিয়ের দশ বছর হয়ে গেছে অমর ও সুমির। অনেক চেষ্টা করেও কোনো সন্তান হয়নি তাদের। ডাক্তার -পত্র তো আছেই ঠাকুর -দেবতা মানসিক ব্রত কিছুই বাদ দেয়নি সুমি। অমরের ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও শুধু সুমির মুখ চেয়ে অর্ণাকে দত্তক নেয় তারা। কিন্তু ক্রমশ অমরেরও বাবা হবার সাধ পূরণে সক্ষম হয় অর্ণা। হয়ে ওঠে সে ওদের নয়নমণি। কোনো কিছুর অভাব রাখে না। ইচ্ছা ঠোঁটে এসে পৌঁছনোর আগেই সেটা পূর্ণতা পেয়ে যেত কোনো মন্ত্র বলে তা আজো অজানা অর্ণার।

অর্ণা ইংলিশে এম এ করেছে। বেশ ব্রিলিয়ান্ট। একদিন ঘটক চরণ একটা ছেলের সন্ধান নিয়ে এসে হাজির। ছেলে বিদেশে থাকে। একটাই ছেলে। চরণ বলে
–বুঝলেন দাদা,আমাদের অর্ণা দিদিমণির সাথে ভীষণ মানাবে। একেবারে রাজযোটক। আমি অর্ণা দিদিমণির বিষয়ে সত্যি কথা বলেছি। ওরা ভীষণ ভালো মানুষ। দত্তক সন্তানে ওদের কোনো আপত্তি নেই। ছেলে- মেয়ে একে- অপরকে শুধু একটু দেখে শুনে নিলেই হবে।
অমর ও সুমি আলোচনা করে ঠিক করে ছেলে পক্ষকে আহ্বান করবে।

অর্ণা একমনে ম্যাকবেথ পড়ছিল। সুমি এসে পাশে বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওর বিয়ের সম্বন্ধের কথা তোলে। অর্ণা শোনামাত্রই ভয়ে শিউরে উঠে সুমিকে জড়িয়ে ধরে। সুমি আশ্বস্ত করে শান্ত স্বভাবের অর্ণাকে।

ড্রয়িং রুমে ঢুকেই সবকিছু মাপতে থাকে ছেলের মা। সুন্দর সূক্ষ্ম জিনিসে সাজানো ড্রয়িং রুম দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। সুমি বলে
–এ সবই আমার মেয়ের কালেকশন। ওর পছন্দ একেবারে এ ক্লাস। অর্ণা হালকা সাজে এসে বসে ওদের সামনে। ডাগর চোখ,টিকালো নাক পান পাতার মতো মুখ, ঠিকরে পড়া গায়ের রং দেখে খুব পছন্দ হয় ছেলের ও ছেলের বাড়ির। ছেলের মা বলে
–তা ,ও তো আপনাদের নিজের সন্তান নয়,কোথা থেকে এনেছিলেন ওকে? না মানে আমরা তো একটু জেনে নেব। এমনি আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
এই কথায় পরিবেশের হাওয়ায় একটু বদল দেখা গেল। অর্ণার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। সুমি পরিবেশকে ঠান্ডা করতে একগাল হেসে বলে ওঠে
— ওই তো, কলকাতার একটা নামী হোম থেকে। ওর বাবা- মা ছোট্ট বেলায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়।

এইসব কথা বলতে বলতে চোখাচোখি করছিল অমর ও সুমি। অর্ণা হাতের আঙুলে জড়িয়ে নিচ্ছিল আঁচলের এক প্রান্ত । ওর মনের মধ্যে উঠছিল এক প্রবল ঝড়। ছেলের মা এবার ওর প্রতি অমর সুমির ভালোবাসা ,টান নিয়ে কথা তুলে বলে
— তবে একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না সুমি বোন ‘এভাবে যে পরের মেয়েকে মানুষ করেছেন তাতে আপনাদের কুর্ণিশ জানাই। মেয়ে নিশ্চিত ভালো পরিবারের তবেই তো আপনাদের শিক্ষা নিতে পেরেছে। কোনো আজে -বাজে পরিবেশের হলে এইরকম হতো না।
এইবার আর থাকতে না পেরে অর্ণা মুখ খোলে।
— আমার আসল নাম চম্পা। আমার মাকে খুন করা হয়। সে ছিল একজন বেশ্যা..।

RELATED ARTICLES

Most Popular