Homeসাহিত্যরবিয়াণীস্বদেশ-সম্পাদনা-রবীন্দ্রনাথ

স্বদেশ-সম্পাদনা-রবীন্দ্রনাথ

✍️কলমে: অরূপম মাইতি

(পর্ব–৯)

সাধনা, ভারতী, নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, ভাণ্ডার – এই চারটি সাময়িক পত্র সম্পাদনার পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পর তিনি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ‘জীবনস্মৃতি’ (ভাদ্র ১৩১৮ – শ্রাবণ ১৩১৯) লিখতে শুরু করেন। বাংলার বাইরে থেকে অর্থাৎ বিদেশ এবং বাংলায় প্রকাশিত সাময়িক পত্রপত্রিকাগুলি তাঁর বাল্য ও কৈশোর জীবনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তার বিবরণ তিনি ‘জীবনস্মৃতি’-র অন্তর্গত ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে বিস্তারিত লিখেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রকাশিত চারটি সাময়িক পত্র, যথাক্রমে ‘বিবিধার্ধ-সংগ্রহ’(১৮৫১), ‘অবোধবন্ধু’ (১৮৬৩), ‘বঙ্গদর্শন’(১৮৭২)এবং ‘প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ’ (১৮৭৪) সম্পর্কে আলোচনার সূত্রে, সাময়িক পত্রের আদর্শ প্রসঙ্গে নিজস্ব মতামত জানিয়ে লিখেছিলেন

“রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয় বিবিধার্থ-সংগ্রহ বলিয়া একটি ছবিওয়ালা মাসিকপত্র বাহির করিতেন। তাহারই বাঁধানো একভাগ সেজদাদার আলমারির মধ্যে ছিল। সেটি আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বারবার করিয়া সেই বইখানা পড়িবার খুশি আজও আমার মনে পড়ে। সেই বড় চৌকা বইটাকে বুকে লইয়া আমাদের শোবার ঘরের তক্তাপোশের ওপর চিৎ হইয়া…পড়িতে পড়িতে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ন কাটিয়াছে।”
ছেলেবেলায় বিবিধার্থ-সংগ্রহ পড়ে কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন ভরে উঠত। গম্ভীর বিষয়ের সান্নিধ্য-ভারে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ শিশু ও সাধারণ পাঠক উপযোগী সচিত্র বাংলা সাময়িক পত্রের অভাব নিয়ে, পরবর্তী কালে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন
“এই ধরনের কাগজ একখানিও এখন [বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ ১৯১১-১২ খ্রীষ্টাব্দে] নাই কেন। একদিকে বিজ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞান, পুরাতত্ত্ব অন্য দিকে প্রচুর গল্প, কবিতা ও তুচ্ছ ভ্রমণকাহিনী দিয়া এখনকার কাগজ ভরতি করা হয়। সর্বসাধারণের দিব্য আরামে পড়িবার একটি মাঝারি শ্রেণীর কাগজ দেখিতে পাই না। বিলাতে চেম্বার্স জার্নাল, কাসলস ম্যাগাজিন, স্ট্রাণ্ড ম্যাগাজিন প্রভৃতি অধিক সংখ্যক পত্রই সর্বসাধরণের সেবায় নিযুক্ত। তাহারা জ্ঞানভাণ্ডার হইতে সমস্ত দেশকে নিয়মিত মোটা ভাত কাপড় জোগাইতেছে। এই মোটা ভাত মোটা কাপড়ই বেশির ভাগ লোকের বেশি মাত্রায় কাজে লাগে।”

ছেলেবেলার অনুপ্রেরণার উৎস স্বরূপ আর একটি ছোট কাগজেরও তিনি ভূয়ষী উল্লেখ করেছেন।
“বাল্যকালে আর একটি ছোটো কাগজের পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম। তাহার নাম অবোধবন্ধু। ইহার আবাঁধা খণ্ডগুলি বড়দাদার আলমারি হইতে বাহির করিয়া তাঁহারই দক্ষিণ দিকের ঘরে খোলা দরজার কাছে বসিয়া বসিয়া কত দিন পড়িয়াছি। এই কাগজেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা প্রথম পড়িয়াছিলাম। তখনকার দিনের সকল কবিতার মধ্যে তাহাই আমার সবচেয়ে মন হরণ করিয়াছিল। তাঁহার সেই সব কবিতা সরল বাঁশির সুরে আমার মনের মধ্যে মাঠের এবং বনের গান বাজাইয়া তুলিত। এই অবোধবন্ধু কাগজেই বিলাতি পৌলবর্জিনী গল্পের সরস বাংলা অনুবাদ পড়িয়া কত চোখের জল ফেলিয়াছি তাহার ঠিকানা নাই।”

পঞ্চাশোর্ধ রবীন্দ্রনাথ যে বয়সে এসে কিশোর এবং সাধারণ পাঠক উপযোগী সাময়িক পত্রের চূড়ান্ত প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মতামত দিয়েছেন, তার থেকে বোঝা যায় দীর্ঘ সময় ব্যপী একাধিক পত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে সাধারণ মানুষ যে কিনা একাধারে দেশের নাগরিক এবং পত্রিকার পাঠক, তার মানস গঠনের স্বার্থে এসব পত্রিকা কতখানি ব্যপক দায়িত্ব নিতে পারে! স্বদেশ ভাবনা, স্বাধীনতা বোধ, মুক্ত মন – এসব কিছু, কোন এক জাদুকাঠির সাহায্য ছাড়া, পরিণত বয়সের দেশবাসীর মধ্যে সঞ্চার করা যত কঠিন, তার থেকে অনেক সহজ যদি এমন দায়িত্ব পালনে সমর্থ সাময়িক পত্র যথেষ্ট পরিমাণে ছোট বয়স থেকে অনায়াসে পাঠক তথা কিশোর নাগরিকের নাগালে এসে যায়।
(ক্রমশঃ)

RELATED ARTICLES

Most Popular