যৌবনকাল

✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়

(পর্ব –১৩)

কলকাতায় এসে আমি আবার এক গহীন রহস্যময় জীবন গহ্বরে আপতিত হলাম। অনুভব ও বিশ্বাসের সহজতার জগৎ থেকে আপাত প্রস্থান নিয়ে অবধার্য মনে করলাম মান্যবরদের বিচার বিশ্লেষণের ওপর।এখানেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে। এই বাঁক পালটানোর অনিবার্যতায় যৌবনকাল যে কখন আচমকা অন্য গতি নেবে নদীর খেয়ালখুশির মতো,তার কৃতকৌশল আগাম আন্দাজ করা খুবই কঠিন এই নব নির্বন্ধে। তখন হাত বাড়ালেই ব্যাপক ভোগবাদের আয়োজন।আর কত পরিশীলিত বিদগ্ধ সাহচর্য। আকাঙ্খায় বেবাস্তবি হয়ে তখন আর ধূসর জীবনে ঢুকতে ইচ্ছে জাগেনি।পারিবারিক ভাবে আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।পিতৃদেব লেকটাউনে আলিশান বাড়ি নির্মাণে নিমগ্ন। দুই বোন অমতবিবাহ সম্পাদনের পর নিজেদের সংসার সামলাচ্ছে।দাম্পত্য কলহে মা যোধপুরপার্কে বিষণ্ন একাকিত্বে। আমি রয়েছি বাঙ্গুর অ্যাভিনিউতে একটি এককামরার নিভৃতবাসে। সব মিলিয়ে আমার মনেও একসাগর দুঃখ ও হতাশা। কখনই মনে হয়নি আমি আবার জেগে উঠব এই পরিস্থিতি থেকে। চারদিক শুধু অন্ধকার মনে হত। কিন্তু সুখের ছবিগুলো চোখের পর্দায় ছায়াচিত্রের মতো সারি দিয়ে ভেসে উঠত।আবার মিলিয়ে যেত। সেখানে অবগাহন করে যৌবনকালের নানান অনুষঙ্গের স্মৃতি খুঁড়তে খুঁড়তে এক আপাত অর্থহীন ভাবনায় ঘুরপাক খেতাম। তার অমোঘ বিমুগ্ধতায় বর্তমানকে বেবাক তুচ্ছ করার সাহস হারাচ্ছিলাম। তাই দৈনন্দিনতার থোড় বড়ি খাড়ার সম্পৃক্তিতে সমর্পণ করেছিলাম নিজেকে।আমার বুকের মধ্যে তখন জন্ম নিয়েছে এক বিষাদবৃক্ষ। সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাতা ঝরায় নৈমিত্তিক সাথী হয়ে। সেই পরিবস্থায় আমার এক সহকর্মীর প্রগাঢ় ভূমিকার সক্রিয়তায় সরাসরি বৈবাহিক প্রস্তাব এল। সেটা ছিল তাঁর হৃদয়বৃত্তির অসুমার প্রকাশ।

সেই অবতারণায় আমার মনে এক উজানভাবের উদয় অবধারিত হলো।ঠাওর করলাম উজানের শেষ ঘাটের দিকে এগিয়ে চলেছি। এবার বোধহয় নোঙর বাঁধার সময়ান্তর এসেছে।৷ গেরস্থ হতে হবে শুধুমাত্র যৌবনিক প্রদাহে নয় বরং আমাদের পরিবারকে যদি ফের এক সুতোয় বাঁধতে পারি। ভাবলেই মন বড় সুখে বিস্তার পায়।এক কথা ভাবি আর অন্যকথা কুচোকাচা নিয়ে এসে ভিড় করে। তবু আমার শিকড় নতুন করে এক সরস মাটির আশ্রয় পায়।বুঝতে পারি আমার রুচি ততটা সুক্ষ্মতার মাকড়শার জালে আবদ্ধ হয়নি। শ্লথ চেতনায় একটা মোলায়েম সুখ আসে তখন।বিয়ের মধ্যস্থতাকারী সহকর্মী যে এত সহজেই ঘটনাটা ঘটিয়ে দেবে সেটি ছিল আমার চিন্তনের বাইরে। মা এবং বোনরা এক বাক্যে রাজি আমার বিশৃঙ্খল পরিপার্শ্বিকতা ভেবে নিয়ে।যৌবনকাল সবটাই হারিয়ে ফুরিয়ে যাওয়া নয়।

বারে বারে নতুন করে যেন সবকিছু নির্মিত হয়।বাবা-মা কিংবা নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কগুলো অপরিবর্তিত সত্তায় ফিরে আসে বিগত মহিমা নিয়ে।অনুভবটি ব্যাপ্তি পেতে থাকে আরও গাঢ় হয়ে।। কালের বিভাজন অলীক হয়ে গিয়ে আরাম আসে চকিত শান্তিতে। এক ধ্রুবপদী কুহকের সমাহিতিতে যেন জিরেন দেয়। পিতৃদেবের সঙ্গে উডবির বাবার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল।এই বৈবাহিক প্রস্তাবে বাবা বলেছিলেন,দেখে শুনে বিয়ে দিন।আমার ছেলের চরিত্র কিন্তু ভালো নয়। মদ আর মেয়েমানুষ ছাড়া কিছুই বোঝে না।
ওঁনার বক্তব্য ছিল,সত্তর দশকেই অতিবাম রাজনীতির জন্য ওকে আমি অ্যারেস্ট করতে পারতাম।জানতাম,ওর দেশব্রতী পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক। আমি কিন্তু রসিকতা করে বলেছিলাম,পাকাপোক্ত গ্রেফতার তো করছেন নিজের মেয়েকে দিয়ে। উনি ভ্যাবলা মুখে তাকিয়ে ছিলেন। তবে মদ্যপানজনিত কারণে ভদ্রলোককে প্রণাম করতে গিয়ে অনেকক্ষণ তাঁর পদযুগলের দর্শন মেলেনি। গম্ভীর হয়ে উনি শুধু বলেছিলেন, অনেক হয়েছে আর না।

চলবে…

RELATED ARTICLES

Most Popular