যৌবনকাল

✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়

( পর্ব–১৪)

মনের মধ্যে তখন শ্লোক ধ্বনিত হচ্ছে,যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম।অর্থাৎ একজন নারীকে বিশেষ রূপে বহন করার দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে হবে।মেলবন্ধন হবে দুটি হৃদয় ও দুটি পরিবারের।পাটিপত্রের দিন মোটামুটি স্থির হয়ে গেল এই বিয়ে হচ্ছেই।আমার বোন তো প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলল।
দেনাপাওনার প্রসঙ্গ উঠতেই বলেছিলাম,আমি কোনও যৌতূকের ঘোরতর বিরোধী।তবে পাকা কথা দেবার আগে আলাদা করে ওর সঙ্গে কোনও রেস্তোরাঁয় একান্তে কথা বলতে চাই।প্রয়োজনে শান্তিনিকেতনেও যাওয়া যেতে পারে।তবে মালাবদল নিয়ে আমার একটা শর্ত রয়েছে।সেটাও ওকে সরাসরি বলব।
আমার স্মার্টনেস দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু দিন তিনেক পরে মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে আমি আর শুভ্রা মিলিত হলাম পার্কস্ট্রিটের বার-বি-কিউতে।শান্তিনিকেতন বাতিল করেছিলেন ওর বাবা।আমার জন্য অর্ডার দিয়েছিলাম ফ্রেস লাইম উইথ সোডা।ও নিয়েছিল চিন্ড কোক আর চিকেন স্যান্ডুইচ।বলেছিলাম,আই ডোন্ট ড্রিঙ্ক।

আমিই কথা শুরু করেছিলাম,প্রেম করেছি যথায় তথায় বিয়ে করছি বাপের কথায়।মায়ের কথায়।বোনের কথায়।
-মানেটা বুঝলাম না।একটু খোলসা করে বলো।শুনেছি তুমি কবিতা লেখো।কাব্য ছেড়ে গোদা গদ্যে এসো।
বললাম,আসলে আমি বিয়ে করছি আমার লাইফস্টাইল পালটানোর জন্য।জানি ফুসমন্তরে এটা সম্ভব নয়।তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি বটে কিন্তু মাথার ওপর ভাড়া করা ছাত পাবে আপাতত।অবশ্য কোম্পানি আমাকে একটা লিজড ফ্ল্যাট দিতেই পারে।লেকটাউনে বাবার সঙ্গে কিংবা যোধপুর পার্কে মায়ের সঙ্গে থাকার অভিপ্রায় বিন্দুমাত্র নেই।তবে আমাদের বাসায় যদি বাবা-মা থাকতে চান আপত্তি নেই।
শুভ্রা প্রসঙ্গ পালটে বলেছিল,সে না হয় পরে ভাবা যাবে।কিন্তু তুমি কী জানি একটা শর্ত রেখেছিলে?
-মালা বদলের ব্যাপারে তো?আমার ইচ্ছে আমি তোমাকে ফুল পাঠাব।সেই ফুলে তুমি দুটো মালা গাঁথবে।
-হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন?এর পেছনে রহস্যটা কী?শুভ্রার চোখে জিজ্ঞাসা চিহ্ন স্পষ্ট হয়।
-দেউলটি বাজারে কয়েক বছর আগে একটা মেয়েকে মালা বিক্রি করতে দেখেছিলাম।সেই মেয়েটার হয়তো কোনওদিন বিয়েই হবেনা।কিন্তু ওর গাঁথা মালায় বহু মালাবদলের সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে।
শুভ্রা আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।শেষতক বিয়েতে ওর গাঁথা মালাতেই মালাবদল হলো।
বিয়ের মাস খানেক আগে একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ পেয়েছিলাম দক্ষিণ কলকাতার কবির রোডে।বাড়িওয়ালাকে বিয়ের কথা গোপন রেখে বলেছিলাম,শুধু আমি আর মা থাকব।কথোপকথনের সময় পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল এক তরুণী।আমার সঙ্গে চোখাচোখি হবার পর আড়ালে চলে গেল সে।বাড়িওয়ালা মানে তার বাবারও নজর এড়ালো না সেটা।ভদ্রলোক অজানা কারণে নির্ধারিত সেলামি-অ্যাডভান্স মকুব করে দিয়ে বলেছিলেন,বিয়ে থা করার ইচ্ছে নেই?
-অবশ্যই আছে।তবে কেরিয়ারটা একটু গুছিয়ে নি।তাছাড়া লেকটাউনে বাবার বাড়িটাও শেষ হয়ে
যাক।

ভদ্রলোকের তাঁর মেয়েকে গছানোর মতলব বুঝতে আমি ভুল করিনি।তাঁর দুর্বলতা মূলধন করে নামমাত্র ভাড়ায় ফ্ল্যাটটা পেয়ে গেলাম।মেয়েটির সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা হত ঠিকই কিন্তু খুবই আলগা ধরণের।কিছুদিন পর যখন বিয়ের কার্ড দিতে গেলাম তখন ওর উদাসী চোখ দেখে মায়া লাগত।তবুও দোতলার বারান্দায় মেয়েটি এলো চুলে আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকত।অবশ্য ওকে আমি কক্ষনো প্রশ্রয় দিইনি।
কবির রোডে আমার আর শুভ্রার বিবাহিত জীবন ভালোই কাটছিল।বাবাও মাঝেমাঝে এসে থাকতেন।তবে পায়রার খোপে স্থান সঙ্কুলানের জন্য বেশ সমস্যা হত।শুধু হটডগ নামের আমার সারমেয় পোষ্যটি মনে রাগ পুষে রেখেছিল।কারণ এতদিন সে আমার সঙ্গেই ঘুমোত।শুভ্রা আসার পর ব্যবস্থা বদল হয়।তাই এক রাতে সে প্রতিশোধ নিল শুভ্রার নতুন চটিটা ফালাফালা করে দিয়ে।অবশ্য পরদিনই আমাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে অবস্থা সামাল দিতে হয়।
তবুও সেই যৌবনকালের চলমান পথেই তো নতুন করে টের পাচ্ছিলাম যাপনের রক্তিম ভালোবাসার চিহ্নগুলো।সেই সঙ্গে সামাজিকতার মাপকাঠিতে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম নিজেকে।

(চলবে)

RELATED ARTICLES

Most Popular