অতলান্ত

✒️কলমে: তথাগত চক্রবর্তী                          ডক্টর রায় বুঁদ হয়ে ফাইলের পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছিলেন। কিছুটা সামনে এগিয়ে ফের পেছনে, ফের সামনের পাতা গুলো। সামনে বছর তিরিশের যুবতী, আরতি। আরতি এই বেসরকারী হাসপাতালটিতে কর্মরত একজন অ্যাটেনডেন্ট। এখানে আয়া শব্দটা কেউ ব‍্যবহার করেনা। তবে আরতি ঠিক আয়া নয়, নার্সিং-এর অনেকগুলো কাজই সে জানে। ডক্টর রায়েরও অগাধ ভরসা এই মেয়েটির ওপর। ইঞ্জেকশান থেকে স‍্যালাইন বা স‍্যাম্পেল কালেকশান, সবেতেই সিদ্ধহস্ত সে। চুপচাপ মুখ নীচু করে ডাক্তারবাবুর নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলো সে।
ফাইলটা বন্ধ করে মুখ তুলে দেখলেন ডক্টর রায়, তারপর বললেন–“আরতি, তোমাকে একটা হোম সার্ভিসে যেতে হবে। একজন পেশেন্টকে বাড়ীতে অ্যাটেন্ড করতে হবে। ডিউটি আওয়ার্স বলে কিন্তু কোন সিডিউল নেই। অবশ‍্য তোমাকে সাহায‍্য করার জন‍্যে অন‍্য নার্স যাবে, দরকার হলে আমিও রেগুলার ভিজিট করবো। কি, অসুবিধে হবে নাতো?” অসুবিধে! ডক্টর রায়ের অর্ডার, তায় অসুবিধে! আরতির স্বামী সুশোভন যখন অকালে মারা যায় তখন আকাশ ভেঙে পড়েছিলো অশিক্ষিত, গ্রাম‍্য এই আরতির মাথায়। তার স্বামীও এখানকারই ষ্টাফ ছিলো। সেই দুর্দিনে মাথায় হাত রেখেছিলেন এই ডাক্তারবাবু। হাতে ধরে সব কাজ শিখিয়ে এই হাসপাতালেই চাকরী দিয়েছিলেন তিনি। ডাক্তারবাবু আরতির কাছে ভগবান।

“তুমি বরং এবেলাটা রেষ্ট নিয়ে নাও। বিকেলের দিকে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। তোমাকে অবশ‍্য ওখানেই থাকতে হবে।” একমূহুর্তে একটু আশংকার ভাব ফুটে উঠলো আরতির মধ‍্যে, তবে মুখে কিছু বললো না। ডক্টর বুঝলেন আরতির কোন আপত্তি নেই। এবারে রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন ডাক্তারবাবু। আরতিকে বললেন–“গল্পের বই পড়া অভ‍্যেস আছে তো? ” উত্তর নিস্প্রোয়জন। কারন ডাক্তারবাবু ভালোই জানেন নিঃসন্তান আরতির ঐ একটাই প্রেম–গল্পের বই। এবারে মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে বললেন–“সুকুমার মিত্রের নাম জানো তো?পড়েছো ওনার লেখা?” নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লো আরতি। সুকুমার মিত্রের লেখার সে নিজে একজন অন্ধ ভক্ত। গল্প, উপন‍্যাস, কবিতা, নাটক কি লেখেননি তিনি।এবার ডাক্তারবাবু বললেন–“আরতি, আমাদের পেশেন্ট আর কেউ নন, এই সুকুমারবাবু।” আর সেইজন‍্যেই তোমাকে পাঠাচ্ছি।” আরতির মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো–“কি হয়েছে ওনার?” ডক্টর রায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–“প্রাইমারি ডিটেকশান মাল্টি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। তবে রেকারেন্ট এইলমেন্টস আছে। মাল্টি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার জানোতো, একজনের মধ্যে অনেকের অস্থিত্ব। নিজের ব‍্যক্তিত্ব, অস্তিত্ব এমনকি সময়টাও পর্যন্ত ভূলে যাওয়া আর ভেতর থেকে একেক সময় বেরিয়ে আসা একেক রকম মানুষ। এইরকম কেস ডিল করাটা বেশ ক্রিটিক্যাল। আর সেই জন‍্যেই তোমাকে সিলেক্ট করলাম। তুমিই পারবে চ‍্যালেঞ্জটা নিতে।ওকে, তাহলে ঐকথা ফাইনাল, তুমি এখন ঘরে গিয়ে রেষ্ট নাও। এই ধরো বিকেল চারটে নাগাদ আমি তোমাকে তুলে নেবো। বাই দি বাই, ওখানেই আছো তো, নাকি অ্যাড্রেস চেঞ্জ করেছ? ” মাথা নেড়ে না বললো আরতি।”ওকে, অল দি বেষ্ট” বলেই উঠে পড়লেন ডক্টর রায়।

নির্দেশমতো বাড়ী চলে এলো আরতি। ঘোর তখনো কাটছে না তার। সাহিত‍্যিক সুকুমার মিত্র। কতো লেখা পড়েছে তার। কিছু লেখা পড়লে তো মনে হয় যে তিনি বোধহয় আরতিকে নিয়েই লিখেছেন। চটপট গুছিয়ে নিলো সে। বেশ কয়েকদিন থাকবার মতো জিনিসপত্র একটা ট্রলিব‍্যাগে ভরে নিলো সে। সেইসঙ্গে কিছু শুকনো খাবারও।দুপুরে ঘুমোতে চেষ্টা করলো একটু। ঘুম এলোনা কিছুতেই। খানিকটা এপাশ ওপাশ করে বিকেল তিনটে নাগাদ উঠে রেডি হয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।ঠিক চারটের সময়ে কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখলো ডক্টর রায়ের ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রনাম করে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এলো আরতি।
গাড়ীতে যেতে যেতে কেস স্টাডিটা আরতিকে বোঝাচ্ছিলেন ডক্টর রায়।–“সাধারনতঃ, এই রোগটা একবার সেট ইন করলে কন্টিনিউয়াস স্টে করে। তবে মিষ্টার মিত্রের কেসটা একটু আলাদা। এখানে অ্যাটাকটা হচ্ছে মাঝে মধ‍্যে, তখন উনি সব ভূলে যাচ্ছেন। অনর্গল বকবক করছেন, তারপর আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ছেন। তোমাকে যেটা করতে হবে এই অ্যাটাক শুরু হওয়া থেকে ঝিমিয়ে পড়ার মাঝখানে ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিতে হবে। তারপরে অবজারভেশন, যদি দেখো কোন কাজ হচ্ছেনা, তাহলে মিনিমাম পনেরো মিনিট ওয়েট করে সেকেন্ড ইঞ্জেকশান। ঠিক আছে?” আরতি ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো”তাতেও যদি কিছু রেজাল্ট না হয় তাহলে?” মুখ নামিয়ে নিলেন ডক্টর রায়। একটু সময় নিয়ে বললেন–“আমাকে খবর দিও”।

আরও কিছুক্ষন পরে একটা একতলা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়ীটা। ডক্টর রায়ের সঙ্গে নেমে দুজন এসে দাঁড়ালো বাড়ীটার সদর দরজার কাছে। একজন মাঝবয়সী মহিলা এসে দরজা খুলে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললো-“আসুন ডাক্তারবাবু”। জুতো খুলতে খুলতে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন,”বিকেলের চা খেয়েছেন?”মহিলাটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। মোজাটা জুতোর মধ‍্যে গুঁজতে গুঁজতে ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলেন”কি করছেন এখন?”উত্তর এলো”লিখছেন।”
এবার বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলেন তারা। একটা ড্রয়িংরুম। একদিকে সোফা সেট ও মাঝখানে গ্লাসটপ টেবিল একটা। একটু দূরে একটা টেবিল আর রিভলভিং চেয়ার। দেয়ালে দু একটা ছবি টাঙানো। এককোনে বড় একটা ফ্লাওয়ার ভাস। মোরাদাবাদি সেরামিক্স। চেয়ারে বসে হাতে একটা কলম নিয়ে আনমনে বসে আছেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। আলো কমে এসেছে বাইরে, তবুও তাঁর মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিসঃন্দেহে গৌরবর্ন। মেদবর্জিত সুঠাম চেহারা। একরাশ সাদা চুল মাথাভর্তি, বিকেলের হাওয়ায় ঈষৎ অবিন‍্যস্ত। দৃষ্টি স্থির। এতোগুলো লোক যে তাঁকে দেখছে তাতে তাঁর বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। ইনিই সাহিত‍্যিক সুকুমার মিত্র।

দেখামাত্রই নিমেষের মধ‍্যে সমস্ত আশংকা দূর হয়ে গেলো আরতির মন থেকে। এই সৌম‍্যকান্তি বৃদ্ধের থেকে তার আশংকার কোন কারন থাকতেই পারেনা। ডক্টর রায় একটু গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্ন করলেন–আজ কেমন আছেন স‍্যার?” প্রশ্নটা শুনে আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরালেন সুকুমার। “কে? ও ডাক্তার এসেছো? ভালোই তো আছি”। আরতির দিকে ফিরে ডাক্তার বললেন” তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি আরতি, ইনি প্রসিদ্ধ সাহিত‍্যিক শ্রী সুকুমার মিত্র তথা আমার এককালের স্কুলশিক্ষক। আর স‍্যার , এ হচ্ছে আরতি। এখন থেকে এই আপনার সঙ্গে থাকবে।” আরতি গিয়ে সাহিত‍্যিককে প্রণাম করলেন। মৃদু হেসে হাত দেখিয়ে আরতিকে বসতে বললেন তিনি। “বোসো ডাক্তার, চা খাবে তো।” বলেই ডাক্তারের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ইশারায় পরিচারিকাকে চা করতে বললেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে বাকী দুজনের উদ্দেশ‍্যে বললেন”এসো, দেখে যাও”। ডাক্তার আর আরতি ওনাকে অনুসরন করলো।
ড্রয়িংরুমের সোজাসুজি একটা ঘর। এপাশে ফ্লাওয়ার ভাসের পাশে আর একটা ঘরের দরজা। ভেজানো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললেন সুকুমার। ঘরটা খুব একটা বড়ো নয়, তবে খুব সুন্দর করে সাজানো। জানলার কাছ ঘেঁসে একটা ছোট নিভাঁজ বিছানা। এপাশে দেয়াল জুড়ে ওয়ার্ডরোব। একপাশে অ্যাটাচ বাথরুমের দরজা।

সুকুমার বললেন”এটা আমার মেয়ের ঘর, সে বেটির এখন আসার কোন চান্স নেই। টরন্টোতে ডাক্তারি করে, মেয়ে জামাই দুজনেই। এখন তুমিই এটা ব‍্যবহার করো, ও কিযেন নামটি মা তোমার, দেখোতো এর মধ‍্যেই কেমন ভূলে গেছি। ” আমি আরতি”।হেসে বললো সে। শিশুর মতো হেসে বললেন সুকুমার”তা বেশ, আরতি, তুমি নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নাও মা। চা এলে তোমাকে খবর পাঠাবো।” এই বলে ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ঘরে এখন আরতি একা। একটু ইতস্তত করে ওয়ার্ডরোব খুললো আরতি। থরে থরে লেডিস গার্মেন্টস সাজানো। রয়েছে কসমেটিক্সও। থরে থরে সাজানো রয়েছে সাবান শ‍্যাম্পু। দরজা বন্ধ করলো আরতি। এবারে বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিলো–একেবারে আধুনিক বাথরুম ফিটিংস দিয়ে সাজানো। ঘরটা বিলাসবহুল। একটু নাক সিঁটকালো আরতি। বড়লোকের ব‍্যাপারস‍্যাপার।
একসঙ্গে চা খেতে খেতেই ডাক্তার ওষুধগুলো আর ইঞ্জেকশান গুলো আরতিকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। আরতিও সিরিঞ্জগুলো একদিকে সরিয়ে রাখলো। এগুলো খুবই দরকারি।

খাবারদাবার সব বুঝিয়ে দিয়েঐ পরিচারিকা চলে গেলেন। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ডাক্তারও। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। প্রেশক্রীপশনটা এর মধ‍্যেই মুখস্থ করে ফেলেছে আরতি। আর আধ ঘন্টা পরে একটা ওষুধ, আর ঠিক ঘুমের আগে আর একটা।
টুকটাক কথা বলা শুরু করলো আরতি। একটু স্বাভাবিক হতে হবে পেশেন্টের সাথে। “আমি কিন্তু আপনার লেখার খুব ভক্ত।” তাই নাকি!তা কিকি লেখা পড়েছো তুমি?” আরতি বললো-‘অনেকগুলো, তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে মুক্তির পথে।’ একটু ভেবে নিয়ে বললেন সুকুমার–“মুক্তির পথে! কোনটা বলোত! ঠিক মনে করতে পারছি না”। আরতি বলে উঠলো-ঐযে ,মুক্তি বলে মেয়েটা, সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে পর্বতারোহনে রেকর্ড করবে!” ও হো, ওতো বহুদিন আগের লেখা। রিসেন্ট গুলো পড়েছো কিছু?” একটু নিরাশ হলো আরতি,”আপনার রিসেন্ট লেখাগুলো তো বেশীরভাগই ইতিহাস আর মাইথলজির ওপর লেখা।” ঠিক বলেছ”,বলেওঠেন সুকুমার, ” এগুলো পড়ার সময় পাওনি বোধহয়। বেশতো, আমার ঘরে সেল্ফে সব গুলো আছে, পড়ে নিও।”আরো কিছু টুকটাক কথা হতে হতেই আটটা বাজলো। ওষুধ আর জল নিয়ে এগিয়ে এলো আরতি। “স‍্যার খেয়ে নিন ওষুধটা।” একটু আবাক হলেন সুকুমার। “তুমি আমাকে স‍্যার বললে?” একটু কুন্ঠিত হলো আরতি,” ও ,ক্ষমা করবেন, তাহলে কি বলবো? ” ঢক করে ওষুধটা খেয়ে নিলেন সুকুমার,”কি বলে ডাকবে তুমিই ঠিক করে নাও”। এইবার একটু বিব্রত হলো আরতি। মনে মনে ভাবলো, ইচ্ছে হয় বাবা বলে ডাকতে। সত‍্যি সত‍্যি মনে মনে এতোটাই শ্রদ্ধা করে সে। মুখে বললো,”ইয়ে মানে যদি কাকাবাবু বলে ডাকি?” বলেই রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলো সে। সুকুমার একটু হেসে বললেন”এইতো কেমন সুন্দর নাম দিয়ে দিলে মা, ঐটাই থাক তাহলে”। চোখের জলটা কোনমতে এড়িয়ে গ্লাস আর ওষুধের ফয়েলটা নিয়ে চলে গেলো আরতি।

আর একটু পরে রাতের খাবার খাইয়ে দিলো আরতি। তারপরে ওষুধটা খাইয়ে একটু ইতস্তত করেও সুকুমারের ঘরে ঢুকলো আরতি। একেবারে সাধকের ঘর। একেবারে নিরাভরন, দেয়ালে একটা বড়ো সেল্ফ, তাতে বই ভর্তি। একটা তক্তপোষ, অত‍্যন্ত সাধারন একটা বিছানা আর বালিশ। হাত দিয়ে বিছানাটা টানটান করে দিলো আরতি। দূরে রাখা একটা ছোট টিপয় টেনে আনলো বিছানার পাশে। তাতে একটা কাঁচের গ্লাসে জল রেখে একটা ছোট্ট ঢাকনা দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিলো। তারপর বাইরে এসে দেখলো সোফায় বসে চোখ বুজিয়ে আছেন সুকুমার। এই ওষুধটা খেলে একটু ঝিমুনি আসে। তারপর আস্তে আস্তে করে ঘুম নেমে আসবে। কাছে এসে একটু ঝুঁকে আরতি বললো, “কাকাবাবু, শুতে যাবেন না?” একটু পরে সুকুমার বললেন,”হুঁ, যাবো। তুমি খেয়েছো মা? তোমার খাবার আছে তো? বেশী দেরি করোনা কিন্তু”। বলে তিনি উঠে পড়লেন। ধীরে ধীরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন, আলো নিভিয়ে চলে এলো আরতি।
খাওয়াদাওয়া সেরে শোয়ার আগে আবার একবার সুকুমারের ঘরে গেলো আরতি। না কোন প্রবলেম নেই। নিজের ঘরে ফিরে এলো আরতি। বিছানায় দামী জিনিসগুলো সরিয়ে রেখে নিজের ট্রলি থেকে বালিশ আর চাদরটা বের করে নিলো সে।
প্রথমে একটু অস্বস্তি হলেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে আরতি বুঝতেও পারেনি। স্বপ্ন দেখছিলো সে–একটা বরফাচ্ছন্ন পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে , কিছুতেই এগোতে পারছেনা, আবার চেষ্টা, আবার। না হচ্ছেনা। এবার একটু জোর দিয়েই এগিয়ে যেতে গেলো সে, উঠতে যেতেই পা পিছলে গেলো তার, তারপর পড়ে যেতে লাগলো সে, তলায় আরো তলায়।

ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসলো আরতি। প্রথমটা কিছুই ঠাহর করতে পারলোনা । সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। হঠাৎই সব মনে পড়লো তার–ছিঃছিঃ, ডিউটি করতে এসে এভাবে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। আর কাকাবাবু? তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢুকলো সুকূমারের ঘরে। রাস্তার আবছা একটা আলো এসে পড়েছে ঘরে। কাছে গিয়ে দেখলো কাকাবাবু ঘুমোচ্ছেন, তবে কি যেন অস্ফুটে একটা বলছেন–কিছুক্ষন কান পেতে থেকেও একবর্নও বুঝতে পারলোনা আরতি। মনে হলো যেন বহুদূরের কোন ব‍্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন কাকাবাবু।
ঘরে এসে ভাবতে লাগলো আরতি। কার সঙ্গে কথা বলছেন কাকাবাবু! অবশ‍্য প্রলাপ বকা রুগী এযাবৎ কম দেখেনি সে। কত লোকে বিকারে কত কথা বলে। কিন্তু এ যেন অন‍্যরকম। ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলো সে। তারপর আবার শুলো। মোবাইলে সময়টা দেখলো সে, রাত দুটো বেজে দশ। সকাল হতে এখনো অনেকটা বাকী। এপাশ ওপাশ করতে করতে আবার একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আসছিলো, হঠাৎ একটা শব্দে চমক ভাঙলো তার। উঠে বসলো আরতি। কান পেতে শুনলো, মনে হলো কে যেন কথা বলছে। এতো রাত্রে কে কথা বলবে? সে আর কাকাবাবু ছাড়া আর তো কেউ নেই। তাহলে? তবে কি কাকাবাবুর ঘরে কেউ এসেছে? এতো রাত্রে? আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে পাশের ঘরে গিয়ে উঁকি মারলো সে। দেখলো কাকাবাবু উঠে বসেছেন। কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। কিন্তু ঘরে তো আর কেউ নেই। এবারে সাহস করূ ঘরে ঢুকলো সে। সুইচ টিপে আলো জ্বাললো। সুকুমার আলো দেখে আরতির দিকে তাকালেন। চমকে উঠলো আরতি! একি চোখের দৃষ্টি! যেন ক্রূর, নিষ্ঠুর দুটো চোখ তাকিয়ে আছে আরতির দিকে, সেইসঙ্গে অনুচ্চ অথচ হিমশীতল একটা কন্ঠ–“কে তুমি? কে? কেন এসেছ আমার কাছে? এই ঊষালগ্নে কি চাও আমার কাছে? ও, ও বুঝেছি, চিনেছি তোমায়। তুমি দুর্যোধন প্রেরিত দ‍্যুতি। কাল প্রাতঃকালে পাশাখেলার কথা স্মরন করিয়ে দিতে এসেছো, তাই না? কোন চিন্তা করো না তুমি, তোমার প্রভুকে আশ্বস্ত করতে পারো ‌। আমি শকুনি, এই পাশাখেলায় ভারতবর্ষের ইতিহাস নতুন করে লিখবো আমি। আগামীকাল প্রাতে রচিত হবে নতুন এক অধ‍্যায়- সে অধ‍্যায় হবে হিংসার, হবে ভাতৃঘাতী। তুমি জানো, আজ কতোদিন ধরে প্রতীক্ষায় আছি আমি এই দিনটির জন‍্য। সেই কৌরব কারাগার থেকে। যেদিন আমার মৃত পিতার বক্ষদেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম অস্থি, সেইদিন, সেইদিন থেকে এই দিনটির জন‍্য আমি অপেক্ষমান। সৃষ্টিকর্তা বিধাতার ভূল হতে পারে, কিন্তু শকুনি অমোঘ, অভ্রান্ত”

ইঞ্জেকশানটা তৈরী করে নিয়েছে আরতি, কিন্তু ঠিক সাহস হচ্ছে না তার। এইরকম সময়ে অনেক পেশেন্ট বেশ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে। তাছাড়া কাকাবাবু একটু একটু কাঁপছেন। সাহস করে একটু একটু করে এগিয়ে গেল সে, তারপর সুযোগ বুঝে ইন্ট্রা মাস্কুলার ইঞ্জেকশানটা হাতে পুশ করে দেয়। ঘড়ি দেখলো সে, রাত তিনটে বেজে পঞ্চান্ন। এবার অপেক্ষা পনেরো মিনিটের। কোন রেজাল্ট না হলে সেকেন্ড সিরিঞ্জটা রেডি করতে হবে।
কিন্তু তার আগেই কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলেন সুকুমার। আরতি আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলো সুকুমারকে। গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন তিনি। চটপট প্রেশার আর টেম্পারেচারটা পরীক্ষা করে নোট করে রাখলো আরতি। তারপর আলো নিভিয়ে বেরিয়ে এলো। অন্ধকার ড্রয়িং রুমে সোফাটায় বসলো আরতি। এরকম কেস কয়েকটা ডিল করেছে সে। তবে বেশীরভাগই চিৎকার চেঁচামেচি করে, অনেকে অশ্লীল ভাষায় চেঁচায়, কিন্তু এ আবার কি! কাকাবাবু বিকারগ্রস্ত অবস্থায় নিজেকে মহাভারতের চরিত্র মনে করছেন। শকুনি নিয়ে তাঁর কোন লেখা আছে কি? হয়তো আছে।নিজের রচিত চরিত্রগুলোর মধ‍্যে নিজেই প্রবেশ করছেন? নিজ সৃষ্ট চরিত্র গ্রাস করছে তাকে? একি অদ্ভূত হ‍্যালুসিনেশান।
সকাল সাড়ে আটটায় ডক্টর রায় এলেন। সুকুমার তখনো ঘুমোচ্ছেন। কাজের মেয়েটি এসে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আরতি পুরো রিপোর্ট দিলো। চুপচাপ মন দিয়ে শুনলেন ডাক্তার, তারপর সুকুমারের ঘরে গেলেন। পাল্স দেখলেন। তারপর ডেকে তুললেন তাঁকে। ঘুম থেকে সুকুমার উঠলেন একদম স্বাভাবিক ভাবেই। লজ্জিত মুখে বললেন, এতো বেলা হয়ে গেছে–তারপরেই ঢুকলেন বাথরুমে। ডাক্তার আরতিকে বললেন,”ইঞ্জেকশানটা দিয়ে ঘন্টা তিনেকের বেশী পেশেন্টকে ঘুমোতে দিয়ো না, জাগিয়ে দেবে।”
দ্বিতীয় অ্যাটাক হলো সেইদিনই সন্ধ‍্যায়। সেই ক্রূর, নিষ্ঠুর দৃষ্টি। দৃষ্টি নিবদ্ধ আরতির দিকে। –“কে জাহানারা, তুই এসেছিস মা? ওকী? তোর হাতে খন্জর? তুইও কি তোর ভাইদের মতো হত‍্যাকারী হয়ে উঠলি মা? আমাকে হত‍্যা করবি? আমাকে? বেশ মা, তাই আয় । নিয়ে আয় আমার তরবারি, হত‍্যা কর আমায়। আর সেই সঙ্গে আমার তরবারি আঘাত করুক তোকে। আয় মা, বাপ বেটি একসঙ্গে মৃত‍্যুবরন করি। বেহেস্তের দরজায় তোর মা, আমার মুমতাজ যে অপেক্ষা করে আছে সেই কত যুগ ধরে। আমরা দুজনে একসঙ্গে গেলে সে কতো আনন্দ করবে বলতো! আয় মা ,এগিয়ে আয়, ভয় করছিস কেন? কোন ভয় নেই, আমিও যাবোতো। ওকি , তুই পেছিয়ে যাচ্ছিস কেন জাহানারা? সম্রাট সাজাহানের কন‍্যা তুই ভয় পাচ্ছিস? এগিয়ে আয় জাহানারা, সম্রাট নির্দেশ দিচ্ছে তোকে, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের সম্রাট আদেশ দিচ্ছে, এগিয়ে আয় জাহানারা, আয়”–সেবারেও ইঞ্জেকশান দিয়ে শান্ত করতে পেরেছিলো আরতি। সুকুমারকে শূইয়ে দিয়ে বুক সেল্ফের কাছে এসে দাঁড়ায় আরতি। থাকে থাকে সাজানো বই। সবই তাঁর লেখা। বেশ কয়েকটা বই চিনতে পারলো আরতি‌ , এগুলো তার কন্ঠস্থ প্রায়। তবে বেশ কিছু বই আছে যেগুলোর কথা সে শুনেছে, কিন্তু পড়া হয় নি। যেমন এই বইটা, আমি শকুনীর অনুগামী, বা ঐবইটা, কালের সাজাহান। তলার দিকে একটা বই একটু তেরছাভাবে রয়েছে, বাংলার সিরাজ। না এই বইগুলো পড়েনি সে।
আজকের রাত্রে ঘুমনো যাবে না, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আরতি। জেগেই থাকবে সে। কাকাবাবুর শরীরটা মোটেই ভালো লাগছেনা তার। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। যেন একজন কৃত্রিম মানুষ। প্রানটা যেন টিঁকে আছে ওষুধের ওপর। খাইয়ে দিলে খান, ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুমিয়ে পড়েন। যেন এই পৃথিবীর সমস্ত চাহিদা শেষ হয়ে গেছে তাঁর। কিচ্ছু পাওয়ার নেই আর।

রাত তখন প্রায় একটা। আবার সেই আ্যটাকের কবলে পড়লেন সুকুমার। প্রস্তুত ছিলো আরতিও। ভায়াল থেকে সিরিন্জে ওষুধটা টানতে টানতে শুনছিলো সে। সুকুমার বলে চলেছেন–“লুৎফুন্নেসা, লুৎফা, বেগম আমার, আমরা বোধহয় আর পালাতে পারবোনা। সেনাপতি মীর-উল-জাফরের লোকেরা প্রাসাদ ঘিরে রেখেছে। যে কোন মূহুর্তে ওরা কোতল করবে আমাদের। ভূল ভূল, লুৎফা, সবই ভূল। রাজমাতা ঘসেটি বেগমের কথায় বিশ্বাস করা চরম ভূল ছিলো আমার। আর আমার সভাসদেরা! ঐ রায়দুর্লভ, ইয়ারলতিফ আর জগৎশেঠ–সবগুলো দোজখের পেয়াদা। সব কটা বিশ্বাসঘাতক। নরকের কীট এক একটা। আঃ, লুৎফা, একবার যদি মুক্তি পাই, এই প্রাসাদ ছেড়ে, অট্টালিকা ছেড়ে অনেক, অনেক দূরে পালিয়ে যাবো আমি তোমাকে নিয়ে। যেখানে থাকবে সহজ সরল কিছু মানুষ আর আমরা। যাবে লুৎফা, যাবে আমার সঙ্গে?”
ইঞ্জেকশানটা দেয় আরতি। খুব একটা লাভ হলো বলে মনে হলোনা। একটু চুপ করে রইলেন সুকুমার। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন–“পলাশীর যুদ্ধে মীর-উল-জাফর সৈন‍্য নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, জানো লূৎফা। নাহলে ঐ ইংরেজ সৈন‍্যদের কি ক্ষমতা ছিলো? সবাই বললো মীর-উল-জাফর বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু আমি জানি লুৎফা আসল ঘটনা কি। ঐ ঘসেটি বেগম আমার পাঞ্জা জাল করে মীর-উল-জাফরকে যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ পাঠিয়েছিলো। অথচ সবাই জানবে সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতন ঘটেছিলো–বাঃ,কি চমৎকার বাংলার রাজনীতি, কেয়াবৎ”

দ্বিতীয় ইঞ্জেকশানটাও পুশ করে আরতি। কিছু কি ইমপ্রুভমেন্ট হলো। কই মনে হচ্ছে না তো। চটপট নিজের ঘর থেকে মোবাইলে খবর দেয় ডক্টর রায়কে । নিশ্চিন্ত হলো আরতি। কিছুক্ষনের মধ‍্যেই অ্যামবুলেন্স আসছে। কিন্তু ততোক্ষন?
পাশের ঘরে এসে আরতি দেখলো সুকুমার দাঁড়িয়ে পড়েছেন। এখন তিনি সুকুমার নন, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা। তিনি দাঁড়িয়ে বেগম লুৎফুন্নিসার মুখোমুখি।–শুনতে পাচ্ছো বেগম, কাদের যেন পায়ের শব্দ। ওরা আসছে। ওরা জেনে গেছে আমরা এখানে। আর নিস্তার নেই আমাদের। আচ্ছা বেগম, আমাদের যা ধনদৌলত আছে সব যদি ওদের দিয়ে দিই, ওরা মুক্তি দেবে না আমাদের। আমার সেই গুপ্ত তোষাখানার চাবি আমি দিয়ে দেবো ওদের। আর তোমার বেগমমহলের সেই অপূর্ব কারুকার্যময় হীরা আর মনি-মানিক‍্য খচিত সেই অলংকার গুলো?”–একটু যেন দম নিলেন সুকুমার, তারপর হঠাৎ হুহু করে কেঁদে ফেললেন তিনি–“দিয়ে দাও বেগম, লুৎফা সব দান করে দাও ওদের, শুধু তার বিনিময়ে আমাদের দুজনের প্রানভিক্ষা চেয়ে নাও, বেগম, শুধু বাঁচতে চাই আমরা দুজন”।

জাপটে ধরে সুকুমারকে সামলানোর চেষ্টা করছিলো আরতি। তাঁকে আস্তে আস্তে বিছানার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। বুঝতে পারছিলো সুকুমারের শরীর ক্লান্ত হয়ে আসছে। বেশীক্ষণ আর শরীরে শক্তিথাকবেনা তাঁর। অ্যামবুলেন্সের সাইরেন কানে এলো আরতির। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো চারজন মেল নার্স আর ডক্টর রায়। আরতির হাত থেকে প্রায় অচেতন সুকুমারের দেহটা নিয়ে চলে গেলো।
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাইরে এসে সোফাটায় বসলো আরতি। বেশ অনেকটা যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। টেবিলে রাখা বোতল থেকে অনেকটা জল খেলো সে। ভোর হতে এখনো অনেক দেরি। একটু ধাতস্থ হয়ে নিজের অবস্থাটা ভাবতে বসলো সে। প্রথম দিন সে ছিলো দুর্যোধনের প্রেরিত দুতি। পাশা খেলার নির্ঘন্ট জানাতে এসেছিলো। সত‍্যিই তো তাই। জীবন সায়াহ্নে এক বৃদ্ধের অন্তিম সময়ের বার্তা নিয়েই তো এসেছিলো আরতি।দ্বিতীয় দিনে? কন‍্যা? হোতে পারে, বিদায়ের আগে নিজকন‍্যার অনুপস্থিতি তার মাধ‍্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু তৃতীয় দিন? নিশ্চিত মৃত‍্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি? আরতিকে অবলম্বন করে? বার বার জীবনভিক্ষা করেছেন তিনি আরতির কাছে। পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আরতির সঙ্গে। কেন? এর কি ব‍্যাখ‍্যা হোতে পারে?
তবে কি সুকুমার কোন অন‍্য এক সত্ত্বার বশবর্ত্তী হয়ে আরাধনা করেছিলেন? কামনা করেছিলেন আরতিকে? আর ভাবতে পারেনা আরতি। হাউ হাউ করে কেঁদে লুটিয়ে পড়ে সোফাটার ওপরে।

RELATED ARTICLES

Most Popular