অবাধ্য পা

✒️কলমে: বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

মানুষের নিজের পা যখন অবাধ্য হয়ে যায় তখনই এক একটি দৃশ্যের জন্ম হয়। কেন এরকম হয় হিরণ্য জানে না।নিজেরই তো পা , ইচ্ছে করলে বেঁধে রাখাই যায় নির্দিষ্ট পথে ও রুটিনে। তবু তার ক্ষেত্রে পথই যেন পা কে অবিরত টানে।এই যে এখন অজানা এক নম্বর থেকে ফোন এল, টুংটুং করে বেজে উঠল মোবাইল। এর পিছনে তার পায়ের কোন ভূমিকা নেই। আকস্মিক। কল রিসিভ করতে তার ইচ্ছে করছিল না।মন বলছিল- ধুর, কোথাকার কে? ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প করবে সাতকাহন। কিংবা কোন পুরনো বন্ধু তার সাফল্যের গল্প শোনাবে। দেমাক দেখাবে।কী দরকার। পাদুটো নেচে উঠল রিংটোন শুনে। অবাধ্য পা হাতকে উস্কানি দিল। অনিচ্ছে সত্ত্বেও হিরণ্য বলে উঠল – হ্যালো।
কতদিন পর সৌম্যর গলা অথচ বুঝতে কোন কষ্ট হল না।কথার মাঝে হাজার ওয়াটের সেই হাসির ঝলক।একই রকম থেকে গেছে সৌম্য। এ কথা সেকথার পর সৌম্য স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে বলল- কাল আমাদের অনুষ্ঠানে আসতে পারবি? তোর কবিতা শুনব।

হিরণ্য না বলতেই যাচ্ছিল।কবিতা বিদায় নিয়েছে কতদিন।জোর করে কবর খুঁড়ে তাকে বাঁচিয়ে আর কি লাভ? এখন টিউশনই তার ধ্যান জ্ঞান।ক্লাস নাইনেরএকটা ব্যাচকে আসতে বলা আছে কাল।পরীক্ষার আগে শেষ মুহূর্তের কিছু টিপস দেওয়া বাকি। পাদুটো চিড়বিড় করে উঠল এক নিমেষে। মাথাটা নড়ে গেল। কৌতূহল নিয়ে হিরণ্য বলে ফেলল- কোথায়?
কবিতা কর্নার। ঠিক বিকাল পাঁচটায়।
কলেজের স্মৃতি নিয়ে জেগে উঠল কবিতা কর্নার। দু ঘণ্টার বাস রাস্তা ঠেঙিয়ে জেলা শহর।সেখানের প্রাণকেন্দ্র এই আড্ডাঘর। সারাদিনের ধকল।পা দুটো তবু সোৎসাহে বলে উঠল – চলো হিরণ্য।
দুপুরের বাস সাধারণত ফাঁকাই থাকে। কিন্তু আজ তেমন নয়। ভিড় বাসে চোখ কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে।যদি আগামী স্টপেজে কেউ নামে এই স্বপ্নে ফাঁকা সিটের সন্ধানে সামনের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায় হিরণ্য।
অরুনিমা। হ্যাঁ অরুনিমাই তো। কোঁকড়ানো চুল।চোখে সানগ্লাস। গালের নীচে সেই তিল ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। তখনই বুঝতে পারে হিরণ্য পা আজ পথ ভুল করে ফেলেছে। মারাত্মক ভুল। অরুনিমার মুখোমুখি হলে তার চোখে ফুটে উঠবে সেই জিজ্ঞাসা- তুমি এখনও একজন পরস্ত্রীর পিছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছো হিরণ্য? কী চাও তুমি ? আমার সংসারের শান্তি বিঘ্নিত করতে?

কী করবে সে? বাস থেকে আবার বাড়ি ফিরে যাবে? তারপর কোন একসময় সৌম্যকে ফোন করে জানিয়ে দেবে – যেতে পারলাম না রে, শরীর খুব খারাপ লাগছিল।
অরুনিমা তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে।এই ভিড় বাসে একা একা কোথায় চলেছে সে? একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের বউ হয়েও অরুনিমা কেন একটি লোকাল বাসে উঠে পড়বে নিজের খেয়ালিপনায়? ওর পাদুটোও কি তাহলে অবাধ্য হয়ে গেছে আজ ?
যদি মুখোমুখি হয়ে যায় দুজনে যদি প্রশ্ন করে আবার এসেছো তুমি? ফেসবুকে তোমাকে ব্লক করেছি। তবু তোমার এতটুকু লজ্জা হয়নি? কী বলবে হিরণ্য?
ইউনিভার্সিটির সেই কোন এক মলিন বিকেলে ছলছল চোখে অরুনিমা জানিয়েছিল- তুমি খুব কষ্ট পাবে জানি,আমিও পাচ্ছি। সামনের মাসে এক ডাক্তারের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে বাবা। আমার একদম ইচ্ছে নেই।কিন্তু কী করব বলো, বাবার অবাধ্য হব?
হিরণ্য গম্ভীর ভাবে বলেছিল- না, একদমই না। এটাই তো স্বাভাবিক এখন । প্রেম হচ্ছে বিয়ের আগে দুবছরের বিএড কোর্স।
তুমি রাগ করছো?

উদাস ভাবে হেসেছিল হিরণ্য – সে হিম্মতও আমার নেই। আমি শুধু আমার অবাধ্য পা দুটোর কথা ভাবছি এতদূর পথ সে ভুল করে কেন হেঁটে এল।
একটি কথা বলবো ?
বোলো
আমাদের ছবিগুলো জমিয়ে রেখো না , ডিলিট করে দিও গ্যালারি থেকে। মেসেজগুলো মুছে দিও। নইলে কষ্ট পাবে। ধরে নাও আজ থেকে আমরা কেউ কারোও পরিচিত নই। আমাদের আর দেখা না হওয়াই উচিত এবং পারলে ফেসবুকে আমাকে ব্লক করে দিও।
প্রতিটি কথা বর্ণে বর্ণে পালন করলেও ফেসবুকের জানলাটা বন্ধ করতে পারেনি হিরণ্য।পরে সেই দরজাটাও একদিম দড়াম করে বন্ধ করে দিয়েছিল অরুনিমা।
ভাবনার মগ্নতা কেটে যেতেই সামনের দিকে তাকাল হিরণ্য। অরুনিমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে কখন নেমে পড়েছে বাস থেকে।তার সিটে একজন অন্য মহিলা।
কবিতা কর্নারে এসে মনটা ঠান্ডা হল।চারপাশে তাকিয়ে অন্রকক্ষন দেখল হিরণ্য। সৌম্য অবিকল সেরকম আছে।চারপাশ কত বদলে গেছে। এখন আর চেনা যায় না অনেককিছু।একদিন শব্দের প্রবল উন্মাদনায় তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল তার অবাধ্য পা দুটোই। নইলে তার চৌদ্দ পুরুষের কেউ কখনও এ রাস্তায় আসেনি।
গান ভেসে আসছে এখন।কবিতার গান। এ তো তারই কবিতা, বহুদিন আগের। সেই সুর বাইরের বাতাসকে কেমন চঞ্চল করে দিয়েছে। এই স্বরক্ষেপন অরুনিমার ছাড়া আর কারোও হতে পারে না ।তার কবিতাকে এভাবে একমাত্র সেই তো আত্মস্থ করেছিল।
হলের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল হিরণ্য। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখল কে গাইছে এই গান? এই শাড়িটা পরেই তাকে আজ বাসে আসতে দেখেছে হিরণ্য। ঠোঁটের নীচে জ্বলজ্বল করছে কালো একটি তিল।গান শেষ হতেই সে ঘুরে দাঁড়াল আলোর দিকে,এখন তার চোখে সানগ্লাস নেই।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চোখ মুখ, ভ্রূর ভঙ্গিমা।অরুনিমা নয়। অথচ অরুনিমার মতোই।
মেয়েটির সাথে পরিচয়ের আগ্রহ নিয়ে সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওর পা দুটো চেঁচিয়ে উঠল –যেও না হিরণ্য।
থমকে গেল সে।
সৌম্য এগিয়ে এল- তোর কি খুব শরীর খারাপ লাগছে, এই শীতেও ঘামছিস কেন ?
হিরণ্য বলল- কিচ্ছু হয় নি আমার। তোকে শুধু একটাই অনুরোধ,যে মেয়েটি এতক্ষণ গান গাইছিল ওকে বলিস সানগ্লাসটা পরে থাকতে, অন্তত আরও কিছুক্ষণ।

RELATED ARTICLES

Most Popular