Homeসাহিত্যরবিয়াণীএকটি হলুদ রবিবারে

একটি হলুদ রবিবারে

✍️কলমে: আশিস মিশ্র

পর্ব –১১

বাঙালি অনেক ঐশ্বর্যমণ্ডিত। তার ঘরে অনেক ধন- দৌলত আছে। মণি- মাণিক্য আছে। আর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ আছে, তা হলো রবীন্দ্রগান। শুধু ২৫ শে বৈশাখ বা ২২ শে শ্রাবণ নয়, সেই গান প্রতিদিনের প্রাণের আরাম আত্মার শান্তি।
সেই গানও আঁতেলদের হাত থেকে রক্ষে পায়নি। জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি যে সব কটু মন্তব্য, তাঁকে বিদ্ধ করেছিলো, সে- সব সহ্য করেও তিনি ছিলেন সৃষ্টিতে অটল। তিনি তো বলেছিলেন তাঁর কোনো কিছু না থাকলেও গান থেকে যাবে। — এ যেন ধ্রুবতারার মতো সত্য। তিনিই বলেছিলেন, “সেই সত্য রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। ”
আমরা যখন ভারচুয়াল বিপ্লবের পথে পা রেখেছি, তখন আমাদের রবি আড্ডার দিনগুলিতেও তাঁকে ধরবার চেষ্টা করেছি ভারচুয়ালি। এই প্রথম ২২ শে শ্রাবণ কবিগুরু হয়ে উঠলেন যেন প্রকৃত ভারচুয়াল রিয়্যালিটি। সেখানেও তিনি মৃত্যকে জয় করে হয়ে উঠলেন মৃত্যুঞ্জয়। তিনি শুধুই ছবি নয়, শুধু পটে লেখা নয়– তিনি সুদূর নীহারিকা নয়, তিনি আমাদের সকলের পরম বন্ধু, পরম আশ্রয়। তাই আমরা এই আড্ডার নাম কেউ করলাম ‘ রবির খেয়া’ কেউ করলাম ” রবিআড্ডা” কেউ করলাম ” রবিসন্ধ্যা” কেউ করলাম ” রবিরশ্মি ” কেউ করলাম ” রবীন্দ্রযাপন”।

সে যাই হোক, তাঁকেও বিকৃত করতে বাঙালির হৃদয় টাল খায় না। কতোভাবে তাঁকে কতটা নীচে নামানো যায়, তারও নমুনা আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি। এখনো দেখছি। তাঁর রচনা থেকে সত্ত্ব উঠে যাওয়ার পর আমরা দেখেছি, ট্রেনে – বাসে হকারবন্ধুদের হাতে হাতে অপরিচ্ছন্ন মুদ্রণে ” গীতাঞ্জলি “। কতো বানান ভুল সেখানে। কতো কবিতা দু’ ফর্মার বইয়ের মধ্যে, তাও বিক্রি হলো সাধারণের মধ্যে। আমরা সেই ঘটনা দেখে বিন্দুমাত্র কষ্ট পেয়েছি কি? না। বরং তা কিনে নিয়ে এসেছি। কবিগুরুর গানের মায়াবী টানে, ছাপা বইয়ের ধূসর পাতা, অপরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদ দেখেও কিছু বলিনি। কেননা, কবিগুরু যে আমাদেরই — আমাদেরই যেন পরিবারের তিনি গুরু। তাঁর বইকে তো আর অমর্যাদা করা যায় না। মন যে তাই শত দুঃখের সময়ও গুনগুন করে ওঠে — “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,/ দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে।। ”
তবুও তাঁর বুকে বিষম ব্যথা। তিনি তাঁর কন্যাসম ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখছেন–” বিধাতার কৃপায় খুব মজবুত শরীর নিয়েই জন্মেছিলেম,তাই আমার জন্মভূমি আমাকে যত মার মেরেছে তাতে টিকে আছি। বিশেষত বন্ধুদের হাতের গোপন ও প্রকাশ্য।..
একটা দুঃখ মলেও ঘুচবে না তা হলো এই বাংলাদেশে আমাকে অপমানিত করা যতটা নিরাপদ এমন কাউকে না। মহাত্মাজি চিত্তরঞ্জনকে ছেড়েই দেওয়া যাক, বঙ্কিম – শরৎ- হেম বাঁড়ুজ্যে – নবীন সেন কাউকে আমার মতো গাল দিতে কেউ সাহস করে না। ”
মত্যুযণ্ত্রণায় কাতর রবীন্দ্রনাথ তবুও তাঁর সৃষ্টিকে সংকীর্ণতায় বেঁধে রাখেননি। তিনি লিখে চলেছেন। মনে হয় আজও তিনি আমাদের মধ্যে থেকে অদৃশ্যে বসে লিখে চলেছেন!
যতদিন যাচ্ছে, তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি নতুন করে। তাই বারবার ফিরে আসি সেই কবিতার কাছে। ২৭ জুলাই ১৯৪১, ১১ শ্রাবণ ‘ ৪৮; জোড়াসাঁকো, কলকাতায় বসে লিখেছিলেন ” প্রথম দিনের সূর্য ”
” প্রথম দিনের সূর্য / প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নূতন আবির্ভাবে–/ কে তুমি? / মেলেনি উত্তর। / বৎসর বৎসর চলে গেল।/ দিবসের শেষ সূর্য / শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল/ পশ্চিমসাগরতীরে / নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় –/ কে তুমি? / মেলেনি উত্তর।। ”
সত্যি তাই। আজও তিনি যে কতখানি আমাদের কাছে, উত্তর পেয়েও মেলেনি উত্তর।

( চলবে)

RELATED ARTICLES

Most Popular