অনুগল্প

✍️কলমে: সুচরিতা চক্রবর্তী

আউট

রোশোনওয়ারা এক চিলতে বারান্দায় দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবেকার এক মরা ফুলে ছোট এক প্রজাপতিকে বসতে দেখে মুচকি হেসে, আ মরণ! দেখে শুনে মরা ফুলে! কানা নাকি?
মরা ফুলে কত মধু পাবি?
মিনসেটা এই মরা ফুলটার মতো আমাকে মেরে দিলে গেলো।
তা আবাগীর বেটা, ওই ঘেঁটু ফুলে কত মধু পেলি! বুঝবি তোর সব রস চুষে যখন লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে এখানেই আসতে হবে তোকে। ঘেঁটুর আবার মধু!
মরণ দশা।

আজ রবিবার, রোশনওয়ারা কাজে যাবে না। নিয়মিত ইউনিয়নে পয়সা দেয়। অনেক বিবাদ করে লড়াই করে ছুটি ধার্য হয়েছে। তিন বাড়িতে ঠিকে কাজ করে রোশন। সপ্তাহে কাজ করবে ছয় দিন কিন্তু এই একদিন শুধু ওর। সেদিন কারো গোলাম না, সেদিন সময় ওর গোলাম।
নিজের ইচ্ছে মতো রাঁধবে খাবে ইচ্ছে মতো থাকবে। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে হাতের কাঁচের চুরি নাড়তে নাড়তে কত কিছু ভাবছে রোশন । ভাবছে কাজের বাড়িগুলোর কথা। মিত্রদের বাচ্চাটা ওর খুব ন্যাওটা। রোজ ব্যাট বল খেলতেই হবে নইলে আঁচল ধরে কান্না। খেলো না রোশু পিসি, পরে কাজ করো। এত ভালো লাগে বাচ্চাটাকে! বুকে জড়িয়ে ধরে রোশনওয়ারা। আস্তে করে চেপে রাখে স্তনের মধ্যে । মাতৃত্ব সুখ। কী যে উপাদেয় জীবনের জন্য, মিত্রদের বাচ্চাটাকে জড়িয়ে বুঝে নেয়। দুধের স্বাদ তো ঘোলে মেটার নয়। বেশি আদর করলে আবার বৌদিদি রাগ করে। গা জ্বলে যায় রোশনের। ভালোবাসা সে যেমনই হোক ভাগ বোধহয় কেউই দিতে চায় না। রোশন বুক থেকে নামিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।
পুকুর পাড়ের কাজের বাড়ির দাদা আবার আরেক লোক। সব সময় খিটিরমিটির লাগিয়েই রেখেছে বাড়িতে। আজ রান্না ভালো না তো কাল বৌদির বাপের বাড়ি তুলে গালাগালি। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেড়িয়ে আসতে পারলে বেঁচে যায় রোশন।
পাশের বাড়িতে প্রেশারে সিটি দিচ্ছে দুটো তিনটে চারটে।
নিজেদের বুদ্ধি সেদ্ধ করছো নাকি হালিমা বৌদি!! সে তো কবেই করে ফেলেছো। এখন প্রেশারকুকারে কার মাথা সেদ্ধ করছো?
নিজের মনেই বলতে থাকে রোশন।
যেদিন থেকে রোশনওয়ারার মরদের সাথে ভিড়িয়ে নিজের ননদের ভার হাল্কা করেছিলো সেদিন থেকে মনে প্রাণে শাপ- শাপান্ত করে হালিমার চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে রোশন।
আর ওকে বলেই বা কী হবে! মিনসেটা কেমন লোক গো! আমার কথা একবার ভাবলি না? আমিও তো তোকে ভালোই বেসেছিলাম। কী কম ছিলো আমার যে ওই ঘেঁটুর সাথে চলে গেলি। চোখে জল এসে গেলো রোশনের। পরক্ষণেই গাল বেঁকিয়ে বললো –
আমি ভালোই আছি, নিজের গতরের পয়সায় খাই কারো ধার ধারি না।
এক বছর আগে যখন মারাত্মক এক্সিডেন্টে পায়ের অপারেশন হলো একবারের জন্যও দেখতে আসেনি মিনসে। সরকারি দয়ায় আবার নিজের ভাত জোগারের কাবিল হয়েছে বটে কিন্তু সে তো ব্যানার্জি বাবুর জন্যই। লোকটা অনেক ছুটাছুটি করে কাগজ পত্তর বানিয়ে দিলো বলেই না বিনা পয়সায় সব হলো। অবশ্য ব্যানার্জি বাবুকে এই নিয়ে কম কথা শোনায়নি ব্যানার্জি গিন্নি। মানুষের উপকারেও কলংক লাগাতে এদের বাঁধে না মাইরি। তাই বলে ওমন দেবতার মতো মানুষটাকে ছোট বড়ো কথা শোনাবি?
ক্লাশ সেভেন পর্যন্ত পড়েছে রোশন। বাবুদের বাড়ির পেপার বই বিক্রির সময় যে গুলো চোখে লাগে ছবিওয়ালা বইগুলো বাড়ি নিয়ে আসে। উলটে পালটে দেখে, পড়ে।
নিঃসন্তান রোশন, না নিঃসন্তান বলা যায় না , কদিন আর পেলো স্বামীকে!
এই ভালো আছে, একা নিজের মতো। বেশ হাসি খুশি রোশন বসতির দুটো ছোট বাচ্চাকে অ আ A B শেখায় সন্ধে বেলা।

ওদের চটপটি, বিস্কুট দেয় আদর করে। মায়ের মতো।
দুপুরে সবে চোখ লেগেছে গুলাবির ফোন।
“একটু শুতে দিবি না মাইরি, বলেছি তো বিকেলে যাবো। এখন ফোন রাখ তো। ”
“আরে রোশন ফোন রাখিস না।
বিকেলে তোকে আসতে হবে না, আমি যাবো,
তোকে যার কথা বলেছিলাম তাকে নিয়ে। মনে আছে তো! আরে সেই মহিলা যার খুব নাম ডাক আছে, কী সব সিনেমা টিনেমা করে। সেই পার্কে আলাপ মনে নেই?
‘ কী যে করিস না। সবে চোখটা লেগেছে। ‘
“আচ্ছা রাখছি রে। থাকিস। আমরা যাবো।”
ঘুমের চোখে আবছা মনে পড়লো সেই ফরসা মহিলার কথা। কি সুন্দর দেখতে মাইরি।
“শোন গুলাবি আমি তিনটে বাড়ি কাজ নিয়ে নিয়েছি। তুই শুধু শুধু নিয়ে এলি ওনাকে।”
“না গুলাবি আমাকে আনেনি।
আমি নিজেই বলেছি তোমার সাথে দেখা করবো। আমি কাজের জন্য ও আসিনি। তোমার গল্প শুনতে এসেছি। তুমি এই টুকু একটা মেয়ে কি করে সমস্ত আশ্রয় হারিয়ে এতো হাসতে পারো। কি করে এতো লড়তে পারো? ”
“কেনো দিদিমনি সিনেমা হবে এই গল্প নিয়ে?
খুব ভালো হবে তো তাহলে।
নায়িকা কে হবে? মানে আমার চরিত্র কে করবে? আর নায়ক?
কিন্তু দিদিমনি যে মেয়েটা আমার মিনসেকে নিয়ে ভেগেছে তাকে কিন্তু খুব বিচ্ছিরি দেখতে করবেন।
ও কি ভালো হতে পারে বলুন। আমি পছন্দ করে দেবো কিন্তু সেই বিচ্ছিরি মেয়েটাকে। রাজি তো? ”

“আমি কোনো সিনেমা করবো না। কোনো নায়ক নায়িকা নেই এখানে।
শুধু তুমি আর আমি।
আমায় শিখিয়ে দাও, কী করে হাসবো! গান গাইবো! বাঁচবো বাঁচার মতন।
বুকের পাথর কেউ দেখবে না, সবাইকে ক্ষমা করতে পারবো। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে ঘুমোতে পারবো।
রোশন, গুলাবীর কাছে তোমার গল্প শুনেছি আর ভেবেছি তুমি যদি পারো আমিও পারবো। ”
” কেনো দিদিমণি তোমার মিনসেও কি! ”

ততক্ষণে গুলাবি রোশন আর দিদিমণির বুকের আঁচল ভিজে যাচ্ছে।

সবার কাছে জীবনটা চু কিত কিত খেলার চৌখুপী নয়। প্রত্যেক ঘর হেঁটে পার করতে হয়। দাগে পা পড়লেই আউট। আউট তুমি আউট।

RELATED ARTICLES

Most Popular