Homeএখন খবরদুই শাবককে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও তলিয়ে গেছিল মা-হাতি! ৯বছর পরে তাঁদের স্মরণে...

দুই শাবককে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও তলিয়ে গেছিল মা-হাতি! ৯বছর পরে তাঁদের স্মরণে শালবনীতে হাজার হাজার জনতা

পলাশ খাঁ, গোয়ালতোড় :- জল দেখে খেলতে নেমেছিল ২টি হস্তি শাবক। পুকুরের গভীরতা বুঝতে পারেনি। নেমে হাবুডুবু খেতে থাকে ওরা। সন্তানদের বাঁচাতে পুকুরে নামে মা। দীর্ঘ ৫ঘন্টার লড়াই। না, শেষ অবধি মা পারেনি তাদের বাঁচাতে কিন্তু ছেড়েও আসেনি স্বার্থপরের মত। নিজের জীবনই যাদের কাছে বড় হাতি তাদের মত ‘চালাক’ নয়। তাই সন্তানদের সাথে শেষ অবধি মা ও বরণ করে মৃত্যুকে। অর্থাৎ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস দিয়েও লড়ে গেছিল মা। এক মায়ের সেই অসম লড়াইকে শ্রদ্ধা জানাতে মাথা নত করে শালবনীর সেই গ্রামে ভেঙে পড়ল হাজার হাজার জনতা।

৯ বছর আগের সেই ঘটনা স্মরণে তিন হাতির মৃত্যু কে স্মরণ করে পাথরাজুড়ি গ্রামে সুসজ্জিত সেই তিনটি হাতির মূর্তি বসেছিল অনেকদিন আগেই। শুক্রবার ভোর থেকে সেখানেই জড়ো হয়েছেন পাথরাজুড়ি, চন্দনকাঠ সহ আশেপাশের প্রায় দশ বারোটি গ্রামের হাজার হাজার নারী-পুরুষ। এখন এই এলাকা হাতি পূজো ও মেলা নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই প্রচলিত লোকবিশ্বাস ও বন্যপ্রাণের প্রতি অসীম ভালবাসার বন্ধনে গত প্রায় দেড় দশক হাতিঠাকুর হয়ে উঠেছেন পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ গ্রামের সর্বজনীন দেবতা।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবীর প্রত্যন্ত পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ নামের এই দুটি গ্রাম আজ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে হাতিঠাকুরের কল্যাণে। জঙ্গলমহলে ক্রমশ বাড়ছে হাতি ও মানুষের সংঘাত। কয়েকশো হাতির দল দলমা ছেড়ে ঘাঁটি গেড়েছে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন বনাঞ্চলে। তাদের কেউ কেউ ‘স্থায়ী বাসিন্দা’ হয়ে সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে এলাকাবাসীদের । প্রতি মরশুমে কৃষকদের ফসল ও সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দিতে কালঘাম ছুটছে বন দফতরের। ঘটছে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনাও। এত কিছুর পরেও জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের হৃদয়ে জঙ্গলের হাতি শুধু বিভীষিকা হয়ে নয়, রয়েছে হাতিঠাকুর হিসেবেই৷ হাতিঠাকুরের দাপটে রাতের ঘুম ছুটে যায় বাসিন্দাদের, ফসল বাঁচাতে রাতপাহারা দিতে হয়। ব্যতিক্রম শুধু পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ । এই দুই গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, হাতিঠাকুর গ্রামের রক্ষক। তাই জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে হাতি ঢুকে পড়লেও ক্ষতি করে না কোনও।

৩৪ নং জাতীয় সড়কের পাশেই গোদাপিয়াশাল চক থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরেই পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ দুটি গ্রাম। কয়েক বছর আগেই প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় তৈরী হয়েছে পিচ সড়ক। সেই সড়ক উজিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি ছাতিম গাছের তলায় হাতিঠাকুরের মন্দিরের ঠিকানা। শালবনী ব্লকের কর্ণগড় পঞ্চায়েতের এই গ্রাম দুটি ঘন শালজঙ্গলে ঘেরা। গ্রাম-লাগোয়া জঙ্গলে সারা বছরই তিন-চারটি স্থানীয় হাতি ঘোরাফেরা করে। দলমার পরিযায়ী হাতির দলও যাতায়াত করে এই এলাকার জঙ্গল দিয়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা গোপীনাথ দত্তসেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারন করতে গিয়ে বলেন, “সালটা ছিল ২০১৩ সাল ।বাঙলার ১৪১৯ সন৷ সবে বসন্তের ফাগের বনে আগ লেগেছে। ৩রা ফাল্গুন, বেশ গরম ছিল দিনটা। সম্ভবতঃ সেই অস্বস্তি থেকে সেদিন গভীর রাতে দুই শাবক পুকুরে নেমেছিল। কিন্তু তলিয়ে যেতে থাকে গভীর জলে। এরপরই মা হাতি তাদের বাঁচাতে নামে পুকুরে। কিন্তু শেষ অবধি তারা আর ডাঙ্গায় উঠতে পারেনি। পুকুরের জলে ডুবেই মৃত্যু হয় ওই তিনটি হাতির। পরদিন গ্রামবাসীরা দেখেন পুকুরের জলে তিন টি হাতি মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হাতির মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন হয়েছিলেন এই দুই গ্রামের বাসিন্দারা। খবর দেওয়া হয় গোদাপিয়াশাল রেঞ্জ অফিসে। বনকর্মীরা এসে মৃত হাতিদের দেহ উদ্ধার করে পুকুরের পাশেই সমাধিস্থ করে। তার পরেই বনদপ্তরের উদ্যোগে দুই গ্রামের বাসিন্দারা ঠিক করেন, হাতির স্মৃতিতে মূর্তি তৈরি করা হবে.”

দুই গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বাস। যাদের চাষাবাদই প্রধান পেশা। গরিব গ্রামে এই হাতি পুজোকে অনেকেই ‘আদিখ্যেতা’ বলে ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি। হাতিঠাকুরের থানে বসে চন্দনকাঠের বাসিন্দা সুধীর সিং বলেন, ‘‘প্রথমে দুই গ্রামের গুটিকয় গ্রামবাসী ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেননি। আমরা কয়েকজনই বনদপ্তরের উদ্যোগে এই মূর্তি বানানোর সিদ্ধান্ত নিই।’’ এখন এই হাতিঠাকুরেই আমাদের এই দুই গ্রাম সহ পাশাপাশি প্রায় দশ বারোটি গ্রামের সার্বজনীন ঠাকুর হয়ে উঠেছে। ওই বছরই পাথরাজুড়ি ও চন্দনকাঠ এই দুই গ্রামের সংযোগ স্থলে মাঠের মাঝে একটি ছাতিম গাছের নিচে পাকার বেদী নির্মান করে বসে হাতিঠাকুরের মূর্তি। ফ্রী বছরই ফাল্গুন মাসের ৪ তারিখ ও ৫ তারিখ ব্রাহ্মণ দিয়ে বিষ্ণু পুজোর নিয়ম মেনে পুজো করা হয়। হাজার হাজার মানুষ এসে ধুপ, সিন্দুর, বাতাসা, কলা নারকেল দিয়ে পুজো দেন। পুজোকে কেন্দ্র করে দুদিন ধরে মেলা চলে। আয়োজন করা হয় ঝুমুর গান, মোরগ লড়াই সহ নানান সাংস্কৃতিক অনু্ষ্ঠানের। প্রথম বছর খরচের ব্যয়ভার বহন করে বনদপ্তর, পরের বার থেকে এগিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা। তৈরি হয় হাতি মেলা কমিটি। এখন সেই কমিটিতে চন্দনকাঠের সুধীর সিং, কমল রায়, শম্ভুচরণ রায়, নান্টু রায় পাথরাজুড়ির গোপীনাথ দত্ত, সুশান্ত দোলুই, কার্তিক দোলুই দের মতো গ্রামের অনেকেই রয়েছেন। এই দুই গ্রাম ছাড়াও স্থানীয় কামারমুড়ি, রণা, বেওচা, কুলাপাছুড়িয়া, গোদাপিয়াশাল প্রভৃতি গ্রামের মানুষেরাও যোগ দেন।

এবার পুজো ৯ বছর অতিক্রম করলো। এখন যে কোনও শুভ কাজে এলাকার মানুষ হাতিঠাকুরের পুজো দেন এখানে এসে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশান্ত দোলুই বলেন, ‘‘হাতিঠাকুরের মৃত্যুর পর থেকে এলাকায় তিনি দেবতা হয়ে রয়েছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের গ্রামকে রক্ষা করছেন তিনি,’’ বলেন । চন্দনকাঠ গ্রামের এক বধূ এসেছিলেন হাতির থানে। তিনি বলেন, ফসলের ক্ষয়ক্ষতি যাতে না হয়, হাতির দলের সামনে পড়ে যাতে প্রাণ না যায়, সেই প্রার্থনাই করলেন। মেদিনীপুর সিটি কলেজের বিএডের ছাত্রী, চৈতা গ্রামের অপরূপা সিং বলেন , পরীক্ষার আগে হাতিঠাকুরের থানে নারকেল ফাটিয়ে ভোগ দিয়ে যান তিনি।

গোয়ালতোড়ের হুমগড়ের প্রবীণ লোকসংস্কৃতি গবেষক শঙ্কর মহাপাত্র বলেন, জঙ্গলমহলের প্রতিটি গ্রামের ‘গরাম থান’-এ (দেবস্থান) পোড়া মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়ার ছোট ছোট ‘ছলন’ (মূর্তি) থাকে। গরাম থানের গ্রামদেবতাকে গ্রামের সব শক্তির উৎস ও বিঘ্নবিনাশক হিসেবে মনে করা হয়। আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এই লোকবিশ্বাস। তিনি আরো বলেন, হাতির বিশাল আকৃতি ও অসীম শক্তির কারণে প্রাচীন কাল থেকেই তার উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। হাতির নামে জঙ্গলমহলে আছে অজস্র গ্রাম— হাতিবাড়ি, হাতিধরা, হাতিলোট, হাতিগেড়িয়া, হাতিপাতা, হাতিমারা প্রভৃতি । মানুষের বিশ্বাস, দেবস্থানে হাতি থাকলে গ্রামের কারও কোনও ক্ষতি হবে না। হাতির দল ফসলের ক্ষতি করে, ঘর ভাঙে, হাতির সামনে পড়ে মানুষের প্রাণ যায়। কিন্তু হাতির মৃত্যু হলে দলে দলে মানুষ সিঁদুর মাখিয়ে ধূপ জ্বেলে তাকে প্রণাম করেন। সেই বিশ্বাস থেকেই এই এলাকায় মানুষ হাতি পুজো করে আসছেন! ”

দলমায় হাতিদের থাকার পরিবেশ নেই। অথচ বছর বছর হাতি বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের হাতিরা জঙ্গলমহলের বিভিন্ন বনাঞ্চলকেই নিজেদের ডেরা হিসেবে ধরে নিয়েছে৷ ধান ও আনাজের খেতের ফসলে পেট ভরাচ্ছে। হুলা পার্টির তাড়া খেয়ে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলের মধ্যে ঘুরছে হাতির দল। গৃহস্থের ঘর ভেঙে ধান-চাল সাবাড় করছে, স্কুলের ভাঁড়ারের দরজা ভেঙে খেয়ে নিচ্ছে মিড-ডে মিলের চাল। এলাকা থেকে হাতি তাড়ানোর দাবিতে প্রায়ই ঘেরাও, বিক্ষোভ, পথ অবরোধ হয়। কিন্তু সেই হাতিই রেলে কাটা পড়লে, তড়িদাহত বা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে শোকে ভেঙে পড়েন এলাকাবাসী। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য!

RELATED ARTICLES

Most Popular