Homeএখন খবরপাখির খোঁজের ঝিল্লী।।পার্থ দে

পাখির খোঁজের ঝিল্লী।।পার্থ দে

পাখির খোঁজের ঝিল্লী                                                                                  পার্থ দে

“লাল শালুক ফোটা
শান্ত দিঘীর জলে
বালিহাঁসের ডুব সাঁতারে
হৃদয় কথা বলে।”

অনেকদিন থেকে একটা বাইক সফর করার পরিকল্পনা ছিল। দিনটা ছিল দোল পূর্ণিমা। তিনবন্ধু বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য ঝাড়গ্রামের ঝিল্লী পাখিরালয়। পথে খড়গপুরের কাছে একটু ব্রেক নিতে হল। প্রাতরাশ পর্ব সেরে আবার যাত্রা শুরু। গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখার রূপে মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষন থমকে গেলাম। বর্ষার সময় ছাড়া এনদীতে জল বিশেষ থাকে না। আর শরতে নদীর দুই পার কাশফুলে সেজে ওঠে। বেশ লম্বা সেতু পেরিয়ে গোপীবল্লভপুর বাজারে প্রবেশ। প্রথমেই গোবিন্দজীউর মন্দির দর্শন করলাম। নদীর পাশেই সাজানো গোছানো ইকো পার্ক। বাজারের একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরা নেওয়া হল।

গোপীবল্লভপুর তিনমাথার মোড় থেকে জামশোলার রাস্তা ধরলাম। মসৃন পিচ রাস্তায় ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। কেন্দুয়াবাঁধি স্টপেজ থেকে মূল রাস্তা ছেড়ে গ্রামীন রাস্তা ধরলাম। মাঠ-ঘাট, জঙ্গল, বড় জলাশয়, ছোট ছোট মাটির ঘর, ঘরের উঠোনে চঞ্চল শিশুদের দেখতে দেখতে একসময় ঝিল্লি লেকের পারে পৌঁছলাম। সবুজ বনানীর মাঝে “U” আকৃতির লেকটির আয়তন প্রায় ১৫০ বিঘা। লেকের ওপারে পঞ্চায়েত সমিতির সাজানো দুটি কটেজ। শাল, সেগুন, মহুয়া, কেন্দু, অর্জুন, বয়ড়া, সোনাঝুরির ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রোমাঞ্চকর ২ কিমি পথ পেরিয়ে কটেজের প্রবেশ ফটক। লেকের জলে লাল শালুকের মেলা। ফুলের মাঝে ঝাঁক ঝাঁক পরিযায়ী পাখিদের খুনসুটি দেখতে বেশ লাগে। সারাদিন পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত প্রকৃতি। Bird Photographer-দের জন্য আদর্শ জায়গা। প্রতিবছর  শীতে বালি হাঁস, সরাল, খড়ি হাঁস মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি ভিনদেশি পাখি আসে।  ভেতরে একটি ওয়াচ টাওয়ার ও প্যাভিলিয়ন আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে লেকের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। এখান থেকে পাখিদের গতিবিধি ও সূর্যাস্ত ভালো করে ক্যামেরাবন্দী করা যায়। লেকের জলে বোটিং করার ব্যবস্থা আছে।

পঞ্চায়েত সমিতির নম্বরে ফোন করে কটেজ বুক করা ছিল। কেয়ারটেকার মোতিলাল মুর্মূ নাম ধাম লিখে নিয়ে কটেজের দরজা খুলে দিল। মোতিলালের সঙ্গে কথা বলে রাতের খাওয়ারের একটা বন্দোবস্ত হল। সে বলল, ২ কিমি দূরে একটা গ্রাম আছে। ওখানকার মুদি দোকান থেকে সে চাল-ডাল-তেল-মশলা কিনে এনে দিলে তাদের রাঁধুনী মধু রান্না করে দেবে। তবে মাছ-মাংস এখন পাওয়া যাবে না। কারন বাজার এখান থেকে ১০ কিমি দূরে। বললাম, আমাদের বেশি কিছু চাই না। ভাত, ডাল, আলুভাজা আর লঙ্কা ভাজা দিয়ে মাখা বেগুন পোড়া (বাগানের গাছে অনেক বেগুন হয়েছিল)। ব্যাস এটুকু ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। মুর্মূ ২ কিমি রাস্তা সর্টকাট করার জন্য নিজের সাইকেলটাকে প্যাডেল বোটে উঠিয়ে নিল। রাঁধুনী মধুকে সঙ্গে নিয়ে লেক পেরিয়ে সাইকেল নিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল। মধু আবার বোট নিয়ে ফিরে এল।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হল। পূর্ণিমার চাঁদ উঠল আকাশ জুড়ে। ঝলসানোর রুটির মতোই মনে হচ্ছিল। তার স্নিগ্ধ আলোকছটা সারা লেকের জলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা তখন এক কেটলি লাল চা আর এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে বসে বসে খাচ্ছি আর গল্প করছি। এদিকে মোতিলাল আর ফিরছে না। তাই রান্নাও শুরু হয় নি। মধুর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। দেখি সে তো তখন মহুয়ার নেশায় ডুবে আছে। যদিও সে আমাদের অভয় দিয়ে বলল, মোতিবাবু চাল ডাল নিয়ে এলেই রান্না হবে। তারপর আমাদেরকে জঙ্গলে নাইট সাফারি করাতে নিয়ে যাবে। পেটেতে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। বিস্কুট আর সঙ্গের শুকনো খাবার সব শেষ। রাত আটটা নাগাদ লেকের ওপার থেকে মোতিলালের আওয়াজ ভেসে এল। সে ডাক আমরা শুনতে না পেলেও মধু ঠিক শুনতে পেয়েছিল। এবার ওপারে যাবে তাকে আনতে। আমাদেরকেও যেতে বলল। হঠাৎ করে এমন একটা সুযোগ পেয়ে যাব ভাবতে পারি নি। যেন মেঘ না চাইতেই জল। চাঁদনী রাতে লেকের জলে বোট নিয়ে ভেসে পড়লাম। অসাধারন এক অভিজ্ঞতা মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিল।

 

“আজ পূর্ণিমা !!
যেমনটি ভেবেছিলাম, তার চেয়েও সুন্দর আজকের জোছনা।
হয়তো বিগত সব জোছনাকে ছাপিয়ে গেছে তার সৌন্দর্য, তার তীব্রতা।
কিংবা কে জানে, অনেক অপেক্ষার পর এসেছে বলেই হয়তো … …
সবকিছু ভেসে যাচ্ছে অনুপম জোছনায়।
নীরব বনানীতে, অনেক দূরে শেয়ালের ডাক শুনতে শুনতে,
জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে সব কিছু ভুলে যাই।
অনেক কিছু মনে পড়বে – অতীতকে, ছোট ছোট স্মৃতিগুলোকে।
আমি অসহ্য আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে।
পৃথিবীর প্রথম মানব বোধহয় এমন করে তাকিয়েছিল;
ঠিক এই চাঁদটির দিকেই।
আমার জোছনা দেখা শেষ হয় না।
পূর্ণিমা এবং পূর্ণতার অনুভূতি নিয়ে আমি জেগে থাকি।”

জিনিসপত্র নিয়ে আসার পর মাটির উনুনে রান্না শুরু হল। রাঁধুনীর তখন টালমাটাল অবস্থা। তখন তার স্ত্রী রান্না করতে গেল। রাত ৯টা ৫০ মিনিটে রান্না শেষ হল। দশটায় পাতে গরম ভাত, ডাল, আলু ভাজা আর লঙ্কা ভাজা দিয়ে বেগুন পোড়া চলে এল। ওখানে তখন ইলেকট্রিক ছিল না। তাই হ্যারিকেনের আলোয় খাওয়া শুরু করলাম। আহা খাবারটা যেন অমৃতসম মনে হচ্ছিল। খাওয়ার পর আর নাইট সাফারির করার ইচ্ছে হয় নি।

পরেরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। কিছু পাখিদের ছবি ক্যামেরাবন্দী করলাম। তারপর লিকার চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে। জঙ্গলের মধ্যে ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। মানুষেরা মূলতঃ জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। অল্প কিছু মানুষ চাষবাস ও পশুপালন করে। প্রায় প্রতি বাড়িতেই হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল আছে। কয়েকটা বাড়িতে গরুর গাড়িও আছে। জঙ্গলবাসীদের রোজনামচা উপলব্ধি করলাম। এভাবে দুঘন্টা কাটিয়ে ফিরে এলাম কটেজে। গ্রামের মুদি দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনেছিলাম। সেগুলো দিয়ে পেট পূজো সেরে নিলাম। তারপর মোতিলালকে পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। ফেরার হাতিবাড়ি ফরেস্ট ও বনবাংলো দেখে নিলাম।

◆ যাতায়াত : কোলকাতা, মেচেদা বা খড়গপুর থেকে বাসে গোপীবল্লভপুর। ওখান থেকে অটো ভাড়া করে ঝিল্লী পাখিরালয় ২৫ কিমি।

◆ ঝিল্লী কটেজ : 9474598182 (বুকিং ম্যানেজার), 9800574317 (কেয়ারটেকার)। ভাড়া – ৮০০ টাকা/দিন
খাওয়ার কথা আগে থেকে জানিয়ে দেবেন।

◆ আশেপাশে : গোবিন্দজীউর মন্দির, হাতিবাড়ি ফরেস্ট, ওড়িশার দেউলী ড্যাম ও ঝাড়খন্ডের প্রাচীণ চিত্রেশ্বর মন্দির (বীরসাচক স্টপেজ)।

◆ কিছু কথা :

লেকের জলে বা যত্রতত্র আবর্জনা ফেলবেন না।
পাখিদের বিরক্ত করবেন না বা ধরবেন না।
খাবার ও দরকারী জিনিসপত্র গোপীবল্লভপুর থেকে কিনে নেবেন।

RELATED ARTICLES

Most Popular