Homeএখন খবরগৌড়হাটির রূপকথা ।। পার্থ দে

গৌড়হাটির রূপকথা ।। পার্থ দে

গৌড়হাটির রূপকথা                                                                              পার্থ দে

ছোটবেলায় পিসির কাছে কত রূপকথার গল্প শুনেছি। পিসি আমাদের বাড়িতে আসত চাষের শাকসবজী নিয়ে। বাবার খুড়তুতো বোন হলেও, ভালোবাসার টানে প্রতি বছর বাবাকে ভাই ফোঁটা দিতে আসতো। কয়েক বছর আগে শেষবার পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন আর কাজের চাপে ফুরসৎ মেলে না। পিসি দুঃখ করে। আমারও মন খারাপ লাগত। পিসিকে ফোন করে জানালাম, খুব শিগগির তোমাদের বাড়ি যাবো।

সেইমতো ডিসেম্বর মাসের এক সকালে বাইক আর ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাঁশকুড়া থেকে মুম্বাই রোড ধরে পশ্চিমমুখো হয়ে রওনা। ডেবরা পেরিয়ে বুড়ামালা স্টপেজ। এবার হাইওয়েকে বাই বাই। এখান থেকে বামদিকে যাত্রা। গ্রাম সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা। সোজা শ্যামচক রেলস্টেশনে গিয়েছে। ঐ রাস্তায় খানিক দূর এগিয়ে, এবার– বাঁয়ে মোড় ! দু’দিকে দিগন্ত-ছোঁয়া মাঠ। মোরাম ঢালা আঁকাবাঁকা রাঙামাটির পথ চলেছে গাঁয়ের খোঁজে। এই পথেই পড়বে গৌড়হাটি গ্রাম। আমার বাইক চলেছে রাঙা ধূলো উড়িয়ে।পিসি বলে দিয়েছিল, “রায়বাড়ি” তাদের এলাকার একটি বিখ্যাত বাড়ি। যে কোন লোককে জিজ্ঞেস করলেই, রাস্তা বলে দেবে। সেইমতো কয়েকটি মোড়ে রায়বাড়ি যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করে, পিসির বাড়ি পৌঁছতে কোন অসুবিধা হল না। ঘড়িতে তখন দশটা। বাইকের ওডোমিটার বলছে, বাড়ি থেকে ৪৫ কিমি রাস্তা এসেছি।

কী শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, মেহগিনি, শিরীষ গাছের মাঝে পিসিদের মাটির বাড়ি। অ্যাজবেস্টসের ছাউনি দেওয়া। সরকারী অনুদানে তৈরী এই বাড়ি। পাশেই শৌচাগার। বাড়ির লাগোয়া ধান রাখার হামার-ঘর আর হাঁস-মুরগী রাখার ঘর। ঘরের চালে চালকুমড়ো ও পুঁই গাছ। কয়েকটা করে বেগুন, লঙ্কা আর গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো পাশের জমিতে। সামনে বড়সড় একটা পুকুর। লক্ষ্য করলাম, পাড়ার প্রতিটি বাড়িতেই শৌচাগার ও বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। বাড়ির কাছেই একটি টিউবওয়েল বসেছে।বাড়ির সামনে আসতেই খাঁচার টিয়া “কেঁ কেঁ”করে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। রোদ পড়েছে বাইরের উঠোনে। সেখানে বসলাম। পিসি আমাকে দেখে ভারী খুশী। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটির উনুনে আগুন জ্বলল। গরম গরম চা বানিয়ে দিল পিসি। তারপরেই এল পিসিদের চাষের চালের মুড়ি। সঙ্গে বেগুনী, পিঁয়াজী ও পাঁপড় ভাজা। খাওয়া চলল গল্প করতে করতে।পিসেমশায় মূলতঃ চাষবাসই করে। চাষের কাজ থাকে না যখন, তখন রাজমিস্ত্রীর কাজে যায়। আগে সবজী ও ফুল চাষ করত, এখন সেসব বন্ধ। পিসতুতো বোনের অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ভাই, বড় অজয়
(বয়স ২২) পড়াশুনার পাট অনেকদিন আগেই চুকিয়ে দিয়ে, এখন সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে মাছ বিক্রি করে। রাত তিনটে থেকে বেরতে হয় মাছের আড়তে যাওয়ার জন্য। এটা তার নিত্যদিনের রুটিন। ছোট মোহন
(বয়স ১৭) একাদশ শ্রেণীতে পড়ছে। অজয় বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ মাছ বিক্রি সেরে বাড়ি এল। বিক্রিবাট্টার হিসাব শেষ করে, পিঁয়াজী দিয়ে পান্তাভাত খেতে বসল। খাঁচার আগল খুলে দিতে, অবাক ব্যাপার! টুনি নামের টিয়া পাখি গুটি গুটি পায়ে তার কাছে এসে হাজির। সেও পান্তা-পেঁয়াজির ভাগিদার। বিস্ময় কাটছে না আমার। ভালবাসা দিতে পারলে, বনের পাখিও বশ হয়। আমি অবাক চোখে তাকিয়েই থাকলাম।

খাওয়া শেষ হলে, অজয়কে নিয়ে বের হলাম গ্রাম পরিক্রমায়। পাড়ার মাটির রাস্তাটি ঢালাই হবে, তার প্রস্তুতি চলছে। আমাকে পাড়ার লোকেরা কোন সরকারী কর্মী বলে ভেবেছিল। হয়তো আমি রাস্তার কাজের তদারকি করতে এসেছি। পিসি পরিচয় করিয়ে দিতে তাদের ভুল ভাঙে। তারপর গেলাম ঐ পাড়ার সেই বিখ্যাত “রায়বাড়ি” দেখতে। বহুকালের পুরানো বাড়ি। বর্তমানে মেরামতি ও রং করা হয়েছে। সামনে বিরাট বড় একটা ধান রাখার হামারঘর। পাশেই দূর্গামন্ডপ ও রাসমঞ্চ। প্রতিবছর এখানে দূর্গাপূজা, কালীপূজা ও রাসপূর্ণিমায় উৎসব হয়।
রায়বাড়ির এক প্রবীন সদস্য বেরিয়ে এলেন আমাদের দেখে। আমি অজয়ের মামাতো ভাই পরিচয় দিয়ে, ঐ বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস জানতে চাইলাম। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল আমার। তা দেখে উনি, একটু সন্দেহের চোখে তাকালেন। সাবধানী মানুষটি কুলুপ এঁটে দিলেন মুখে। শুধু বললেন, এটা একসময় জমিদারবাড়ি ছিল। এর বেশী কিছু বলতে চাইলেন না।মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। এক জায়গায় দেখলাম গাঁদাফুলের ক্ষেত। কে যেন হলুদ কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে সারা মাঠ জুড়ে। চোখ ফেরানো দায়। কিছুদূর যেতেই, পৌঁছলাম আদিবাসীদের পাড়ায়। ঘরের বাইরে রোদে পিঠ দিয়ে বসে ভাত খাচ্ছে কেউ কেউ। দূরে পুষ্যি কুকুরটি বসে আছে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে। কেউ আবার পুকুরঘাটে গল্প করছে। এখানকার ঘরবাড়ি সব মাটির। ছোট ছোট আকার। সামনে একফালি করে উঠোন। দেখে মনে হচ্ছে যেন ইকো কটেজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল আছে। পিসিদের ঘরেও দেখেছি, চারটি হাঁস আর একটি মোরগ আছে। সামনে পৌষের সংক্রান্তি। অজয় মোরগটিকে তালিম দেয় মোরগ লড়াইয়ের জন্য।

গ্রামের শিব মন্দিরটির পাশ দিয়েই রাস্তা। রেলস্টেশনের দিকে চললাম আমরা। রাস্তার দু’দিকে ইউক্যালিপটাসের সারি। বাতাসে মাথা দোলাতে দোলাতে যেন নবাগতকে অভিবাদন জানাচ্ছে তারা। পাশের মাঠে রজনীগন্ধার চাষ। কিছুক্ষন দাঁড়ালাম। একটা মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছিল। ওখানে কিছু ছবি তুললাম।এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে কতটা সময় কেটে গেল, হুঁশ ছিল না। ঘড়িতে দেখি, প্রায় তিনটে বাজে। এদিকে, সেদিনই বাড়ি ফিরতে হবে। অতএব আর দেরি নয়। সোজা পিসির বাড়ির দিকে ইউ টার্ণ নিলাম। পিসির রান্না হয়ে গেছে। পিসেমশায়ও ফিরেছে মাঠ থেকে। শীতের দিন। তবুও পুকুরে স্নানের লোভ সামলানো গেল না। স্নান সেরে, কাঁপতে কাঁপতে কিছুক্ষন রোদে দাঁড়ালাম। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসলাম। গরম ভাত, সঙ্গে গন্ধরাজ লেবু, মুগের ডাল, আলুভাজা, আলু পোস্ত আর হাঁসের ডিমের ঝোল। ঘুরতে ঘুরতে খিদেও পেয়েছিল ভালোই। পরম তৃপ্তি করে খেলাম। পক্ষীরাজ মশাইও খেতে এলেন। এবার আর শরিকানা নয়। নিজস্ব থালা আছে টুনির। সেই থালাতেই খেতে দেওয়া হল তাকে।কিন্তু অবাক হওয়ার বাকি ছিল আমার। ভাতের থালার চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে নিল টুনি। কিন্ত কিছুতেই মুখ দিল না সে। মুচকি হেসে পিসি বলল, আজ যে মাছ নেই পাতে! তাই বাবুর অরুচি। দেখলাম, সত্যিই খেল না। টুনি নাকি মাছ ছাড়া ভাত খায় না। সকাল হলেই চা-বিস্কুট চাই। একটু দেরী হলেই চা-চা করে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। পিসিকে ‘মা’আর পিসেমশায়কে ‘বাবা’বলে ডাকে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম, বড় মোবাইল দেখলেই ছুটে গিয়ে ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর দিচ্ছে। কি জানি হয়তো ফেসবুক/টিকটক করবে।
খেতে খেতে পিসেমশায়ের সাথে অনেক গল্প হল। দারিদ্র সত্ত্বেও পিসিদের এই সহজ সরল গ্রাম্য জীবনচর্যায় আমি একেবারে মুগ্ধ। আজকের দিনটা জলছবির মত বহুকাল আঁকা হয়ে থাকবে আমার হৃদয়ে। মনে হল, পৃথিবীর সব সুখ এখানেই আছে।খাওয়া দাওয়ার শেষে বিদায় নেবার পালা। পিসি থাকতে বলেছিল, কিন্তু যা কাজের চাপ আমার, থাকা সম্ভব ছিল না। পিসির ভালবাসা মাখা কুঁড়েঘর, অজয়, টুনি, রায়বাড়িকে পেছনে ফেলে ফিরে চললাম। আবার এক কর্মব্যাস্ত জীবন শুরু হবে। পিসিকে কথা দিয়ে এলাম, “আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়…”

RELATED ARTICLES

Most Popular