Homeএখন খবরজঙ্গলমহলে সিলিকোসিসে মৃত্যু মিছিল,ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে মৃত্যুর মুখে আরও অনেকে

জঙ্গলমহলে সিলিকোসিসে মৃত্যু মিছিল,ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে মৃত্যুর মুখে আরও অনেকে

জঙ্গলমহলের ২৫ বছরের যুবক , ওজন ৩৯কিলো ! 

নিজস্ব সংবাদদাতা: মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের টি.বি ওয়ার্ডের ৮নম্বর বেডে গত ২৬দিন ধরে ভর্তি রয়েছেন গোবিন্দ জানা। ৪৭বছরের গোবিন্দ আড়াই মাস কটকে থাকার পর কলকাতার পিজি, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি ও নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়ে ভাঙাগড় স্বাস্থ্য কেন্দ্র ঘুরে বর্তমানে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। বাঁচার আশা খুবই ক্ষীন। শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে সিলিকোসিসের বিষ। ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল থানার কদমডিহা গ্রামের বাসিন্দা মৃত্যু পথযাত্রী গোবিন্দের স্ত্রী মলিনা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন , ” সব বেচে দিয়েছি স্বামীকে বাঁচাতে গত একবছর ধরে ঘুরছি হাসপাতালে হাসপাতালে। কিন্তু আশা নেই। দুটো পা ফুলে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি ১৭বছরের ছেলে কে নিয়ে এবার কোথায় দাঁড়াব বলুন?”


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সংক্রমন বিভাগের ৪ নম্বর বিছানার পাশের জানলাতে মাথা ঠুকছেন গোপাল দণ্ডপাঠ, একমাত্র ছেলে ২৫ বছরের তাপস, নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো। ১বছর কাজ করেছিলেন পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের জমশেদপুরের বিস্টুপুরের ক্র্যাশার বা পাথর গুঁড়ো করার কারখানায়। গুগুল সার্চ করে দেখতে পান যে এই ক্র্যাশার থেকেই ছড়ায় মারন রোগ সিলিকোসিস। আর জানতে পেরিয়েই রাতারাতি পালিয়ে আসে একবছরের মাথায় । কিন্তু পালিয়ে এসে রক্ষা নেই। প্রথমে কাশি তারপর শ্বাসকষ্ট আর জ্বর। প্রথমে কটক তারপর পিজি এবং তারপর দিল্লি এইমস। ফুসফুসে বাইপাশ। সেখান দিয়েই সরবরাহ করা হত অক্সিজেন। এরপর বাড়ি এসে ফের অসুস্থ হয়ে ৯দিন নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি। নয়াগ্রাম থানার ডাহি গ্রামের বাসিন্দা তাপসকে বাঁচাতে ঘটি বাটি সব বিক্রি হয়ে গেছে।

নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটিতে তাপস ও মেদিনীপুর মেডিক্যালে গোবিন্দ 

একই ভাবে ১বছর আট মাসের ছেলেকে নিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছেন ২০বছরের নমিতা পাত্র। নয়াগ্রাম থানার রাইপড়িয়া গ্রামের নমিতার স্বামী মাত্র ২৪বছরের মিলন গত দেড়বছর আক্রান্ত। ঘোরা হয়ে গেছে পিজিও। অকাল বৈধব্যর আশংকায় চুঁইয়ে গেছে যৌবন। তিনবছর আগে বিয়ে হওয়া তরুনী এখন যে কোনও দিনই….।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
একবছরের  মধ্যে কাজে গিয়ে ছয় মাসের মাথায় মারা  গেছে সুব্রত বেরা, মাত্র  বয়স ১৯ বছর। বাড়ি,  নয়াগ্রামের বাহিনীতে । রামকৃষ্ণ মন্ডল ওরফে সনু যার নিজের বাড়ি বর্ধমান,  বিবাহ সুত্রে থাকতেন শশুর বাড়ি ঐ নয়াগ্রামের ডাহিতে। ৮ মাসে র একটি পুত্র সন্তানকে রেখে ২১বছরে বয়সে মারা গেছে । মৃত্যুর তালিকায় আরও নাম আছে…যা এখনও আমরা যোগাড় করতে পারিনি। কারন নিজেরা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ভুলে গেছেন মৃত সহকর্মীদের নাম। যেমনটা নমিতা মনেই করতে পারছেনা তাঁর স্বামীর সঙ্গে কাজ করা সেই কালাচাঁদ নামের তরুন ছেলেটির কথা , যে সেদিনও তাঁকে বৌদি বলে ডেকেছিল, ক’দিন আগেই মারা গেছে!


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
জঙ্গল মহলের একঝাঁক তাজা প্রান একটা একটা করে এভাবেই নিভে যাচ্ছে মারাত্মক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। দিন মজুর, মৎস্যজীবী পরিবারের ছেলেরা কাজের সন্ধানে পাশের পড়শি রাজ্যের জামসেদ পুরে ক্র্যাশারে  কাজ নেয় দালাল মারফৎ। তারপর আমাদের বাড়ি বানানোর চিপস গুঁড়ো করার মেশিন থেকে বুকে ভরে নেয় সিলিকোসিস ।
কেশিয়াড়ীর নছিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এর পনশগঞ্জ গ্রামের এক দালাল , বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নয়াগ্রাম সাঁকরাইল কেশিয়াড়ী দাঁতন থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে লেবার নিয়ে যায় টাটার কারখানায়। যাঁদের অনেকেই  রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে ও দিল্লির এমস হাসপাতালে মৃত্যু র সাথে লড়ছেন বলে খবর।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
সাঁকরাইল থানার  কদমডিহা গ্রামের গোবিন্দ জানা,  নয়াগ্রামের নিমাইনগর রাইপড়িয়া গ্রামের মিলন পাত্র কিংবা সংসারে সাশ্রয়ের জন্য তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা না দেওয়া তাপস দণ্ডপাটরা তো রয়েছেই। আরও রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ীর কাঞ্চন পুর ও দাঁতনের এক জন করে মোট তিনজন। কেশিয়াড়ীর পনশগঞ্জ বাসিন্দা বুদ্ধদেব দাস পিজি হাসপাতাল হয়ে দিল্লির এইমসে চিকিৎসায় রয়েছে। এঁদের হাড়ি কাঠ  যেন খড়গপুর মেদিনীপুর পিজি সবশেষে এমস তারপর ঘরে ফিরে টুপ করে ডুবে যাওয়া। জঙ্গলমহলের ওপারে যেমন সূর্য ডুবে যায়।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
সুব্রত খড়গপুর হাসপাতালে থেকে যেদিন মেদিনীপুর রেফার করা হয় ঐ দিন মারা যায়। সনু খড়গপুর হাসপাতালে মারা যায়। প্রতিটি পরিবার দিশাহারা। দেনার দায়ে বিকিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকা পরিবারের বাকি সদস্যরা।
অথচ নিয়ম অনুযায়ী সিলিকোসিস রোগীদের পুরোপুরি সহায়তা করার কথা সরকারের। মৃতদের ক্ষতিপূরন পাওয়ার কথা। কিছুই কেউ পায়নি বা পাচ্ছেনা।

সিলিকোসিস থেকে টি.বি 

রিপোর্ট তো হাসপাতাল থেকেই সরকারের ঘরে যাওয়ার কথা তারপর সরকারি আধিকারিকদের আক্রান্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা। কোথাও পরিবার গুলির অসহায়তা দেখতে না পেরে চিকিৎসকরাই পরামর্শ দিচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার। মামলা করলে চিকিৎসা বাবদ সমস্ত খরচ দিতে বাধ্য সরকার। কিন্তু কে যাবে ওই ঝামেলা পোহাতে? এমনিতেই রোগী নিয়ে নাজেহাল।

মাত্র ৫০টাকা প্রতিদিন! আপনিও বিজ্ঞাপন দিন 

আর সেই যে বলা হয়েছিল, এরপর আর কাউকে ভিন রাজ্যে যেতে হবেনা কাজের জন্য ! কি হল কাজের? মানু্ষের বক্তব্য কাজ বলতে শুধুই ১০০দিনের কাজ যা আবার সব সময় মেলেনা। মুখ দেখে কাজ দেওয়া হয় আর কাজ পেলে বখরা দিতে হয় কখনও কখনও যাকে সোজা বাংলায় কাটমানি বলে। আর তা ছাড়া সাধারন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবক ১০০দিনের কাজ করবে কেন? এমনটাও প্রশ্ন উঠেছে। ১০০দিনের কাজ তো সরকার বদলের আগেও ছিল! এই সরকার আসার আগে বলেছিল জঙ্গলমহলে যুবকদের কর্ম সংস্থান হবে। এলাকায় শিল্প হবে। তার কি হল ? জানাচ্ছেন স্থানীয় মানুষরা।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
মিলনের স্ত্রী নমিতা বলেন, ” স্বামী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। একটা মাস মাইনের কাজ করতে চেয়েছিলেন সংসারে দুটো টাকার মুখ দেখতে। ওরা মাসে ১৪-১৫হাজার দিত।”
  হ্যাঁ মাস মাইনে। শিক্ষিত যুবকদের এটাই চাহিদা। বি.এ তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষা শেষ না করেই মাসিক ১৫হাজার টাকার চাকরিতে ভিন রাজ্যে ছুটে ছিল তাপস দণ্ডপাটও।
এই মাস মাইনের বা চাকরির মর্যাদা কে না পেতে চায়। কিছুই করা গেলনা এদের জন্য ! নীরব , নির্বিচার মৃত্যু মিছিলই কি ভবিষৎ এঁদের?  

RELATED ARTICLES

Most Popular