Homeসাহিত্যসুবর্ণরেখার কথা - ৯ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখার কথা – ৯ ।। উপেন পাত্র

দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় বাঁদরের পিঠা ভাগ
উপেন পাত্র

দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় সুবর্ণরৈখিক বাংলা লোকভাষা প্রচলিত আছে।অতীতে এই অঞ্চল(সমুদ্র তীর থেকে ধলভূম)ওড়িশার মধ্যে ছিল।পরবর্তী কালে বাংলার মেদিনীপুর জেলার মধ্যে আসে।মেদিনীপুর জেলা ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।আলোচ্য অঞ্চলও তার সামিল হয়।লর্ড কার্জন যেমন বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন রুখে দেওয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা করেন,তদ্রূপ মেদিনীপুর জেলার কালেক্টর ডগলাস মেদিনীপুর জেলাকে বিভাজিত করার জন্য কিছু উৎকল নেতাকে উস্কানি দেন।ফলে ওড়িশা এই অঞ্চলকে তার এলাকা বলে দাবি করে।

এর ফলে তার বিরুদ্ধে আলোচ্য এলাকায় তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে।এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বীরেন্দ্র নাথ শাসমল।ওড়িশা ও বাংলা উভয় পক্ষের বাদানুবাদ চরম পর্যায়ে ওঠে।বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য ১৯২৯ সালে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন (স্যামুয়েল জডওয়েল কমিশন) গঠিত হয়।উভয় পক্ষকে তাদের স্বপক্ষে তথ্য প্রমান কমিশনের কাছে দাখিল করতে বলা হয়।এই মামলায় বাংলা পক্ষের ব্যারিস্টার ছিলেন স্বয়ং বীরেন্দ্র নাথ শাসমল এবং উৎকল পক্ষের ব্যারিস্টার ছিলেন গোদাবরীশ মিশ্র (উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা)।
বীরেন্দ্র নাথ শাসমল কমিশনের কাছে যে তথ্য প্রমান দাখিল করেন,তারই ভিত্তিতে কমিশন বাংলার পক্ষে রায়দান করে।তিনি দেখান যে এলাকায় জমির বিক্রয় কোবালার সিংহভাগ বাংলা ভাষায় লিখিত হয় এবং এলাকার বিদ্যালয় গুলিতে বাংলা মাধ্যমে পঠন পাঠন হয়।বাংলার এই বিজয় লাভে কাঁথি শহরে বিজয় উৎসব পালিত হয়।সেখানে বীরেন্দ্র নাথ শাসমল মহাশয়কে “মেদিনীপুর জেলার মুকুটহীন রাজা” উপাধিতে সম্মানিত করা হয়।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কালে কোন এক অজ্ঞাত কারণে পশ্চিম সীমান্তবর্তী বেশ কিছু বাংলাভাষী অঞ্চল বিহার রাজ্যের মধ্যে চলে যায়, বিশেষত বাংলাভাষী ধলভূম বা পূর্ব সিংভূম জেলা (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বিশিষ্ট বাঙালী ভাষা সংস্কৃতি গবেষক ডঃ সুধীর কুমার করন এই পূর্ব সিংভূম জেলার ভূমিপুত্র) এবং মানভূম অঞ্চল।কিন্তু হায় তখন বাংলাকে রক্ষা করার মতো কোন বীরেন শাসমল ছিলেন না।পরে ১৯৫৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কালে মানভূম জেলার খনি আকর অঞ্চলবর্জিত শুধুমাত্র পুরুলিয়া জেলা বাংলাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার পশ্চাতে এক গভীর ষড়যন্ত্র ছিল।এক দিকে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের বাংলা বিহার সংযুক্তিকরণ প্রস্তাব বাতিল হওয়া যেমন ছিল,তেমনই তৎকালীন কলকাতা কেন্দ্রিক কংগ্রেসী নেতাদের উন্নাসিকতা ছিল।এই বিষয়ে প্রয়াত সন্তোষ রানা মহাশয়ের একটি উক্তি উল্লেখ্য– কলকাত্তাইয়া মান্য বাংলাভাষীরা দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তের উপভাষাভাষীদের বাঙালী বলে মনে করে না।
অন্যদিকে বিহারের হিন্দীভাষীরা পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে যে কোন প্রকারে বিহারের সমস্ত বাংলাভাষী অঞ্চলকে বিহারের মধ্যে রাখতে বদ্ধ পরিকর ছিল।

এই বিষয়ে বিধান রায়,রাজেন্দ্র প্রসাদ ও টাটা কোম্পানীর মধ্যে এক গোপন চুক্তি হয়।টাটা কোম্পানীর ভয় ছিল খনি অঞ্চল বাংলায় গেলে কমিউনিস্টরা শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলবে।
১৯৫৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন
জামসেদপুরে এক সার্কিট হাউসে এই বিষয়ে বাংলা ও বিহার উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ করে।কিন্তু আফসোসের কথা এই যে বাংলা পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।স্থানীয় ভাবে ধলভূম ও মানভূম অঞ্চল থেকে বাংলার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে স্থানীয় মাতৃভাষাপ্রেমী সংগঠনগুলি সাক্ষ্য দিতে যান।কিন্তু হিন্দীভাষীরা তাদের সাক্ষ্য দিতে শুধু বাধা দেওয়া নয়,শারীরিক ভাবেও নিগৃহীত করে।ফলে বিহার রাজ্যের পক্ষে একতরফা রায় হয়ে যায়।

পরবর্তী কালে সীমান্ত অঞ্চলের বাংলাভাষী ও আদিবাসী সমাজ যে ঝাড়খণ্ড আন্দোলন গড়ে তোলেন,তার বীজ এর মধ্যেই উপ্ত ছিল।পরে বিহার রাজ্য বিভাজিত হয়ে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠিত হয়, কিন্তু তার ফলে বাংলাভাষীদের এবং আদিবাসী সমাজেরও কোন লাভ হয়নি।ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হলেও পরিকল্পিত ভাবে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।ফলে পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা ভাষা ভুলে গিয়ে হিন্দীভাষী হয়ে যাবে।
বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালে পশ্চিমবাংলার অনেক ভালো কাজ করেছেন,কিন্তু বাংলাভাষী এলাকা বিহার রাজ্যকে উপহার দেওয়া তাঁর একটি নিন্দাজনক কাজ।তাঁর এই কাজের জন্য মানভূম এলাকার ভাষা প্রেমীরা কংগ্রেস ত্যাগ করে অন্য সংগঠন গড়ে তোলেন।ধলভূমের বাংলাভাষীদের মনেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।

RELATED ARTICLES

Most Popular