Homeসাহিত্যসুবর্ণরেখার কথা-৫ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখার কথা-৫ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখার কথা – ৫ ~ উপেন পাত্র

 

সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকার লুপ্তপ্রায় লোকধর্ম

সুবর্ণরেখা নিয়ে অববাহিকা অঞ্চলে তিনটি লোকধর্ম দেখা যায়, যথা– শ্যামানন্দী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম, অলখ নিরঞ্জন ধর্ম বা বকলি ধর্ম এবং যুগী বা নাথ ধর্ম। আজ শ্যামানন্দী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কথা বলি–
শ্যামানন্দী গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখার প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্যামানন্দ আচার্য। কলাইকুণ্ডা বিমান ঘাঁটির নিকটে ধারেন্দা গ্রামে এক চাষী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাল্যনাম ছিল দুখী,তিনি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিশোর বয়সে এলাকার কিছু তীর্থযাত্রীর সাথে তিনি ত্রিবেণী যান।সেখানে সাথীহারা হয়ে তিনি কালনায় চৈতন্য শিষ্য হৃদয় চৈতন্য আচার্যের কাছে আশ্রয় পান।হৃদয় চৈতন্য তাঁকে মন্দির পরিচর্যার ভার দেন।
চৈতন্যদেবের মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে নানা বিকৃতি দেখা দেয়।তাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে তার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার জন্য বৃন্দাবনের শ্রীজীব গোস্বামী ব্রতী হন।এই কাজের জন্য শ্রীনিবাস আচার্য ও নরোত্তম আচার্যকে বিশেষ রূপে শিক্ষা দেন।
একদা হৃদয় চৈতন্য আচার্য বৃন্দাবন যাত্রা মনস্থ করেন,কৃষ্ণদাস তাঁর সাথী হন।বৃন্দাবনে কৃষ্ণদাস শ্রীজীব গোস্বামীর নজরে পড়েন।তিনি হৃদয় চৈতন্যের অনুমতিক্রমে কৃষ্ণদাসকে তাঁর তৃতীয় শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন।দীর্ঘকাল পাঠদানের পর শ্রীজীব গোস্বামী তিন ছাত্রকে আচার্য বা অধ্যাপক উপাধি দেন। তিনি কৃষ্ণদাসকে শ্যামানন্দ আচার্য নাম দেন।

শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীনিবাসকে গৌড় ও রাঢ় বঙ্গ, নরোত্তমকে পূর্ববঙ্গ ও শ্যামানন্দকে উৎকল দেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দিয়ে বাংলায় পাঠিয়ে দেন এবং তাদের সাথে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের লিখিত বেশ কিছু পুঁথি পুস্তক,যার মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের “চৈতন্য চরিতামৃত” কাব্য ছিল, বাংলায় প্রচারের জন্য পাঠান।
এই ত্রয়ী আচার্য বৃন্দাবন থেকে বাংলায় আসার পরই পেটিকায় রক্ষিত পুঁথিপত্র ডাকাত দল কেড়ে নেয়।এই এলাকা বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের অধীন, তাই শ্রীনিবাস অন্য দুই আচার্যকে স্থানীয় বৈষ্ণব প্রধানদের সাহায্যপ্রার্থী হতে বলে নিজে বিষ্ণুপুরে রাজা হাম্বীরের কাছে যান।ঐ ডাকাত দল আসলে রাজার পোষ্য ছিল,তারা রত্নপেটিকা ভেবে ডাকাতি করেছিল।রাজকোষে ঐ পেটিকা জমা পড়ার পর জানা গেল যে এসব বৃন্দাবন আগত বৈষ্ণব শাস্ত্র।রাজা হাম্বীর অনুশোচনায় দগ্ধ হন।শ্রীনিবাস তাঁর কাছে পৌঁছাতে তিনি পাপবোধে শ্রীনিবাসের কাছে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে হৃত পেটিকা গুরুপদে সমর্পণ করেন।

ত্রয়ী আচার্য বিষ্ণুপুরে শলা পরামর্শ করে তাঁদের পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করে নেন।এদিকে বৈষ্ণব শাস্ত্রাদি ফিরে পাওয়ায় হৃদয় চৈতন্য বিষ্ণুপুরে আসেন।নরোত্তম পূর্ববঙ্গ গিয়ে খেতুরী আশ্রম গড়ে তোলেন এবং শ্যামানন্দ ধর্মপ্রচার করতে করতে শ্রীক্ষেত্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত করেন।কিন্তু তাঁর গুরু তাঁকে মহাপ্রভুর দেখানো ঝারিখণ্ড পথে যেতে নির্দেশ দেন। ফলে তিনি প্রচলিত পথ অর্থাৎ বগড়ী (গড়বেতা)- মেদিনীপুর- নারায়ণগড়-দাঁতন পথে না গিয়ে বিষ্ণুপুর থেকেই ঝারিখণ্ড পথে যান।ঐ সময় বর্ধমান আগত কিছু পুরী তীর্থযাত্রী তাঁর অনুগামী হন।
সদলবলে শ্যামানন্দ দুর্গম অরণ্য পথে পথ চলে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ঘাটশিলাতে এসে পৌঁছান এবং নদীর নিম্নগতি ধরে দাঁতন গিয়ে প্রচলিত পুরী যাত্রার পথে যেতে মনস্থ করেন।কিন্তু মাঝপথে স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে গোপীবল্লভপুরে শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেন এবং রোহিনী গ্রাম নিবাসী তাঁর শিষ্য রসিকানন্দকে(রসিকমুরারি পট্টনায়ক) শ্রীপাটের প্রথম মোহান্ত গোঁসাই নিযুক্ত করেন।পরে ঘাটশিলার নিকট শ্যামসুন্দরপুরে দ্বিতীয় শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেন।

বর্ধমান আগত তীর্থযাত্রীরা তীর্থযাত্রা শেষে এই অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন।পরে কাঁসাই নদী তীরস্থ বহু বৈষ্ণব এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলায় এই স্থান উৎকল ভূখণ্ড হলেও বাংলা ভাষীরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হন।রসময় ঘোষের (দাস অধিকারী) পুত্র গোপীজনবল্লভ দাস রসিকানন্দের জীবন চরিত “রসিক মঙ্গল” কাব্য লিখেন।
ঐকালে প্রচলিত আদি-মধ্য বাংলা এই অঞ্চলের লোকভাষা রূপে আজও চলমান আছে।আদি-মধ্য বাংলায় লিখিত “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” কাব্যভাষার সাথে এই অঞ্চলের কথ্যভাষা বিশ্লেষণ করে ডঃ সুধীর কুমার করন মহাশয় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

শ্যামানন্দী গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখা ক্রমশ সারা মেদিনীপুর জেলা এবং ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ ও বালেশ্বর জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।নানা স্থানে এই শাখার মঠ মন্দির আছে,তার মধ্যে পুরীর কুঞ্জমঠ ও বৃন্দাবনের শ্যামসুন্দর মঠ বিখ্যাত।একদা পুরীর কুঞ্জমঠের মোহান্ত বলদেব বিদ্যাভূষণ “গীবিন্দ ভাষ্য” রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন।বর্তমানে রসিকানন্দের ষোলতম পুরুষ কৃষ্ণকেসবানন্দ দেব গোস্বামী শ্রীপাটের মোহান্ত আছেন এবং গোপীজন বল্লভ দাসের উত্তরপুরুষরাও গোপীবল্লভপুরে বাস করেন।

RELATED ARTICLES

Most Popular