Homeসাহিত্যসুবর্ণরেখার কথা ৪ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখার কথা ৪ ।। উপেন পাত্র

সুবর্ণরেখা অববাহিকার লৌকিক দেবতা পঁড়াসুরা                               উপেন পাত্র

একদা সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকায় ব্যাপকভাবে আখের চাষ হতো,বিঘার পর বিঘা আখক্ষেত দেখা যেতো।সাঁকরাইল থানার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রগড়া গ্রামের আখের গুড়ের বেশ সুনাম ছিল,যা
“রগড়ার পায়া গুড়” নামে হাওড়া,হুগলি জেলা ও কোলকাতায় চালান যেতো।গুড় রাখার জন্য এক বিশেষ প্রকার মাটির কলসি ব্যবহার করা হতো, যাকে কুঁদা বা পায়া বলা হয়।এই কারণে এই নামকরণ।বর্তমানে সুবর্ণরেখা নদীর উচ্চ ও মধ্য গতিতে আখের চাষ প্রায় সম্পুর্ন লুপ্ত হয়ে গেছে। সাঁকরাইল থানার পূর্ব প্রান্ত থেকে কেশিয়াড়ী ও দাঁতন থানা এলাকায় এখনও কিছু আখের চাষ দেখা যায়।

আখ চাষের লৌকিক দেবতা পণ্ডাসুর (স্থানীয় লোকভাষায় পঁড়াসুরা)।ইনি নামে অসুর হলেও দেবতার মতো পূজিত হন।আদি বৈদিক যুগে দেব ও অসুর সমার্থক শব্দ ছিল।অগ্নি উপাসক পার্সিদের অহুর মজদা ও বৈদিকদের অসুর মঘবা ছিলেন ইন্দ্র।সেই অর্থে পণ্ডাসুর দেবতা।পণ্ডাসুর চিরকুমার,দিগম্বর ও ইক্ষুক্ষেত্রবাসী দেবতা।পণ্ডাসুরকে দেবজ্ঞানে পূজা করা হতো,আবার ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করা হতো।অতীতে মেয়েদের বাল্যবিবাহ যেমন সার্বজনীন ছিল,তেমনই ছেলেদেরও আঠার থেকে কুড়ির মধ্যে বিয়ে হয়ে যেতো।বিবাহযোগ্য বয়ষ্ক ছেলেদের “পঁড়াসুরা” বলে ব্যঙ্গ করা হতো।
নীহার রঞ্জন রায়ের বাঙালীর ইতিহাস (১ম খণ্ড)
থেকে জানা যায় যে উত্তরবঙ্গ বা পুণ্ড্রবর্ধনে প্রথম আখের চাষ শুরু হয়,তা থেকে ক্রমশ দক্ষিণ বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।পুণ্ড্র থেকে পণ্ডাসুর কথাটি এসে থাকতে পারে।পণ্ডাসুর পূজার একটি অর্বাচীন মন্ত্র লেখক উল্লেখ করেছেন–
“পণ্ডাসুর ইহগচ্ছ ক্ষেত্রপাল শুভপ্রদ,
পাহি মাম ইক্ষুযত্রৈস্ত্বং তুভ্যাম নিত্যম নমো নমঃ।
পণ্ডাসুর নমস্তুভ্যম ইক্ষুবাটি নিবাসিনে,
যজমান হিতার্থায় গুড়বৃদ্ধি প্রদায়িনে।”

চৈত্র মাসে জমিতে আখের চারা বা কাটিং লাগানো হয় আর সাধারণত মাঘ মাসে আখ কাটা হয়,যদিও মকর পরবে নতুন গুড়ের চাহিদা থাকায় পৌষ মাসেও কিছু আখ কাটা হয়।দীর্ঘ দশমাস ব্যাপী আখ জমিনে থাকে।আখচাষের শুরু থেকে পণ্ডাসুর আখ ক্ষেতে অবস্থান করেন।আখ কাটার সময় পণ্ডাসুরের উদ্দেশ্যে ক্ষেত্রপূজা করা হয়।কিন্তু নিত্যপূজা কেবল আখশালে করা হয়। আখ মাড়াই করে গুড় তৈরীর স্থানকে আখশাল বলা হয়।
আখ কাটা শুরু করার আগে কয়েকজন আখ চাষী মিলে যৌথভাবে আখশাল তৈরী করে।আখের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরীর জন্য চুল্লী কাটা হয় এবং তার দক্ষিণ দিকে আখ মাড়াই কল বসানোর জন্য গর্ত কাটা হয়।পূর্ব পশ্চিম লম্বা চুল্লীর পূর্ব দিকে ধোঁয়া নির্গমন ও পশ্চিম দিকে জ্বাল দেওয়া হয়।চুল্লী তৈরীর পর তার ওপর বাঁশ ও খড় দিয়ে ঘর বানানো হয়।ঘরের দক্ষিণ ও পূর্ব দিক খোলা থাকে এবং উত্তরা বাতাস আটকানোর জন্য উত্তর ও পশ্চিম দিকে ছিটে বেড়ার আড়াল দেওয়া হয়।

চুল্লীর ওপর বিশাল মাপের কড়াই বা ডেক বসানো হয়।ডেকটি এত বড় হয় যে বর্ষাকালে খাল বিল জলে ভরে গেলে তা নৌকার মতো ব্যবহার করা হতো।জ্বালানি দেওয়ার গর্তের ওপর চুল্লীর পশ্চিম দেওয়ালে পণ্ডাসুরের শয়ান মূর্তি গড়া হয়।
শালঘরের দক্ষিণ দিকে আখ মাড়াই কল একটি গর্তের মধ্যে বসানো হতো।চারটি শাল কাঠের ফ্রেমের মধ্যে একটি পাটাতনের ওপর দু’টি বড় সিলিন্ডার বা বনা এবং একটি ছোট বনা থাকতো।
বড় বনা দুটিকে পরস্পর বিপরীত দিকে ঘোরানোর জন্য তার মাথায় বিপরীত খাঁজকাটা পিনিয়ান বা ফুল থাকতো,যার একটিকে আঁড়িয়া বনা ও অন্যটিকে মাই বনা বলা হতো।আঁড়িয়া বনা ও ছোট বনার মাঝ দিয়ে আখ ঢোকানো হতো এবং দুই বড় বনার মাঝ দিয়ে পেছনদিকে আখের ছোবড়া বা খুয়া বেরিয়ে আসতো।মাই বনার মাথায় একটি লোহার বড় আংটা থাকতো,যার মধ্য দিয়ে একটি শাল তাড়া ঢোকানো হতো।শাল তাড়ার সাথে গোরু হাল জোতা হতো।গোরু হাল চলার সাথে আখ মাড়াই হয়ে পাটাতন বেয়ে আখের রস সামনের গর্তে রাখা সরিষা টিনের পাত্রে পড়তো।

কুড়ি টিন পরিমান আখের রস ডেকে ঢালা হলে জ্বাল দেওয়া শুরু হতো।শুকনো আখের পাতা বা বাল্লা জ্বালানিরূপে ব্যবহার করা হতো।আখের ছোড়া বা খুয়া শুকনো করেও জ্বালানি করা হতো।
আখশাল চালু হওয়ার শুরুতে এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় পণ্ডাসুরের পূজা করা হতো।পূজার উপকরণ হলো কুকশিমা ফুল ও খই গুড়ের প্রসাদ।পূজারী হলো আখচাষী স্বয়ং।পূজার কালে পণ্ডাসুরের নামে হরিধ্বনি দিয়ে পূজা সাঙ্গ করে উপস্থিত সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করা হতো।
আখের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরী সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।প্রথম দিকে ফুটন্ত রসের ওপর কালচে গাদ ভেসে ওঠে।এই গাদ তুলে রাখা হয়,যা গোখাদ্য রূপে ব্যবহৃত হয়।পরে সোনালী রঙের গাদ ওঠে,একে ফুলিয়ারী বলা হয়,যা দিয়ে পিঠা তৈরী করা হয়।গুড় পেকে উঠলে এক মধুর সুগন্ধে আকাশ বাতাস ভরে ওঠে।
পরে যন্ত্রচালিত আখ মাড়াই কল বা থ্রাসার মেশিন আসায় গোরু দিয়ে আখ মাড়াই বন্ধ হয়ে যায়।আখ চাষ একটি জমিতে প্রায় সারাটা বছর জুড়ে থাকে, ফলে দোফসলী জমি মার খায়।এই কারণে ক্রমে আখ চাষ কমে যেতে থাকে। তাই আখ চাষ ক্রমশ বিলুপ্তির পথে যায়।

RELATED ARTICLES

Most Popular