Homeএখন খবরসুবর্ণরেখার কথা- ৩ ...

সুবর্ণরেখার কথা- ৩ উপেন পাত্র

        সুবর্ণরেখার কথা- ৩
উপেন পাত্র

(প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিতব্য ‘সুবর্ণরেখার কথা’র আজ তৃতীয় পর্ব। লেখক উপেন মাত্র যাঁর পোশাকি নাম উপেন্দ্র নাথ পাত্র প্রথম পর্বে সুবর্ণরেখার উৎপত্তি ও বিস্তৃতি বর্ননার পর দ্বিতীয় পর্বে নদী গর্ভে জেগে ওঠা এক চর নিয়ে দুই গোষ্টির লড়াই ‘ বৈশাখী পালের যুদ্ধ’ কাহিনী বিবৃত করেন। তৃতীয় পর্ব, বাংলার বর্গী হানার পটভূমিতে সুবর্ণরেখার প্রেক্ষিত। দক্ষিন পশ্চিম বাংলার সীমান্ত অংশে বর্গী হানার প্রেক্ষিত অনেকটাই বড়।
সংলগ্ন বর্তমান ওড়িশা যার ভেতরেই ছিল আধুনা বঙ্গের এই অংশ সেই অংশের বহুদূর অবধি বিস্তৃত ছিল বর্গী হানার মানচিত্রে। আঘাত প্রত্যঘাত দুই-ই হয়েছে। লেখক এরমধ্যে একটি অংশকেই ধরেছেন তাঁর কলমে। নাতি অথচ গভীর বিশ্লেষনে আখ্যায়িত এই পর্ব। এই পর্বের জন্য ফের একটি প্রচ্ছদ আঁকলেন রামকৃষ্ণ দাস।)

সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকায় বর্গী হানা

“ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে।”
মা মাসিরা এই ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন।বর্গী জুজুর ভয়ে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়তো।সুদুর মহারাষ্ট্র থেকে বর্গীরা এদেশে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল।তাদের অত্যাচারে বাংলা ও উৎকলে হাহাকার পড়ে যায়।তারা জবরদস্তি করে চৌথ আদায় করে,গ্রামে গ্রামে লুন্ঠন চালায়।কোলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তাদের ভয়ে
মারহাট্টা ডিচ খুঁড়েছিল।
কিন্তু দ্বিবিধ কারণে তারা সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকায় অত্যাচার করেনি।এই এলাকা তাদের গোপন আশ্রয় ঘাঁটি ছিল।অতীত কালে সুবর্ণরেখা নদী ছিল সুনাব্য।নদীখাত গভীর ছিল,নদীর প্রসার কম ছিল।তাই নদীতে বানিজ্য পোত বা বজরা যেমন চলতো,তেমনই রণপোত চলতো।বর্তমান কালের প্রায় মজে আসা নদী দেখে তা ধারণা করা কষ্টসাধ্য।রোহিণী গ্রামের নিকট “জাহাজ ডুবি শোল” আর জাহানপুর পীর ডাঙার “সওদাগর পুত্রের কবর” নদীর অতীত নাব্যতার সাক্ষ্য দেয়।

দাঁতন থেকে গোপীবল্লভপুর পর্যন্ত বর্গীদের তিনটি সেনানিবাস ছিল।সেগুলি হলো ভসরাঘাট, যা বর্গী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের নাম থেকে এই নামকরণ হয়,দেউলবাড় গ্রাম ও গোপীবল্লভপুরের নিকট “বর্গীডাঙা”। বর্গীরা দেউলবাড় গ্রামে শিব মন্দির নির্মাণ করে,যা রামেশ্বর শিব নামে প্রসিদ্ধ। বর্গীডাঙার সেনানিবাস আকার আয়তনে বেশ বড় ছিল।বর্তমানে ঐ স্থলে সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।
দাঁতনের কাছে মোগলমারীতে এবং তার উত্তর পশ্চিম দিকে কুরুমবেড়াতেও বর্গীদের সেনানিবাস ছিল।রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দাঁতন বা দণ্ডভুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।দ্বারভাঙ্গা উত্তরের দ্বারবঙ্গ হলে,দক্ষিণের দ্বারবঙ্গ হলো দাঁতন।গৌড় বঙ্গ থেকে শ্রীক্ষেত্র গমনের পথ যেমন দাঁতনের মধ্য দিয়ে যায়,তেমনই মোগল-পাঠান,গৌড়-উৎকলের সেনা আগ্রাসনের গতিপথ এই দাঁতনের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে।

বর্গী তথা মারাঠারা হলো শৈব গাণপত্য।তারা যেখানে যায় সেখানে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছে,শিব মন্দির বানিয়েছে।সুবর্ণরেখা নদীতাঈরে দেউলবাড় গ্রামের শিব মন্দিরটি বর্গীরা বানিয়েছে।কিন্তু মন্দির নির্মাণ শেষ হওয়ার পূর্বে আলিবর্দি খাঁর সেনার হাতে বর্গী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যু ঘটায় মন্দির নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পরবর্তী কালে কুলটিকরীর রাজা মন্দিরের কিছু অংশ সংস্কার করেন।
সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকা বর্গীদের আশ্রয় ঘাঁটি হওয়ার কারণে তারা যেমন স্থানীয় লোকজনের ওপর অত্যাচার করেনি,এটি একটি কারণ।দ্বিতীয় কারণ হলো শ্যামানন্দী গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখার সাথে মারাঠাদের পূর্ব সদ্ভাব।বৃহত্তর ভারতে বৈষ্ণবদের চার শাখা আছে, যারা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পৃথক শাখা রূপে স্বীকার না করায় বিতর্ক শুরু হয়।বিবাদ নিরসনের জন্য রাজস্থানের জয়পুরে জয়পুরের মহারাজা ও বরোদার মারাঠা অধিপতির উপস্থিতিতে একটি বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়।

ঐ সভায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রতি শাখার পক্ষ থেকে কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিকে পাঠানো হয়।শ্যামানন্দী বৈষ্ণব শাখার পক্ষ থেকে পুরীর কুঞ্জ মঠের অধ্যক্ষ বলদেব বিদ্যাভূষণকে পাঠানো হয়।ঐ সভায় বলদেব বিদ্যাভূষণের যুক্তি প্রতিযুক্তি,পাণ্ডিত্য ও বাগ্মীতায় সকলে মুগ্ধ হন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পঞ্চম শাখা রূপে স্বীকার করা হয়।ঐ সভাস্থলে বরোদার মারাঠাপতি বলদেব বিদ্যাভূষণকে একটি প্রসংশা সূচক তাম্রপত্র দান করেন।তারই সম্মানে বর্গীরা শ্রীপাটের সাথে সদ্ভাব রেখে চলতো।

বর্গীদের সমস্ত স্মৃতি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। শুধুমাত্র দেউলবাড় গ্রামে আজও রামেশ্বর শিব মন্দিরটি আছে,শিব চতুর্দশীতে বিশাল মেলা বসতো।১৯৭০ সালে নকশাল আন্দোলনের সময় শিবরাত্রির মেলা সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।এখন ঐ স্থানে শিবরাত্রির মেলা হয় বটে,কিন্তু আগের মতো জমজমাট ভাবটা আর নেই।

RELATED ARTICLES

Most Popular