Homeএখন খবরঅসমের ডিটেনশন ক্যাম্প, গোয়ালপাড়া থেকে মিউনিখের দাচাউ, ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি

অসমের ডিটেনশন ক্যাম্প, গোয়ালপাড়া থেকে মিউনিখের দাচাউ, ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি

ডা: সুবর্ণ গোস্বামী :আসামের গোয়ালপাড়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ডিটেনশন ক্যাম্পের নির্মাণ সম্প্রতি শেষ হল। ২৫ বিঘা জমির উপর নির্মিত এই ক্যাম্পে তিন হাজার মানুষের থাকার বন্দোবস্ত। কেমন সে বন্দোবস্ত, তা আসামেরই অন্য চালু ডিটেনশন ক্যাম্পে একবছর কাটিয়ে সম্প্রতি জামিন পাওয়া সানাউল্লার কাছে জানা গেল। সানাউল্লা ইন্ডিয়ান আর্মিতে দীর্ঘ ৩০ বছর চাকরীর পর অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালে।তিনিও নিজেকে নাগরিক প্রমাণ করতে ব্যর্থ।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
জানা গেল, এক একটা ঘরে গড়ে ৩০-৪০ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় শুতে হয় মেঝেতে। খেতে দেওয়া হয় সকালে একটুকরো করে বাসি পাঁউরুটি আর চিনি ছাড়া লিকার চা, দুপুরে একমুঠো ঠান্ডা ভাত, জলের মত একহাতা ডাল আর অখাদ্য একটা সব্জী, রাতেও তাই। টয়লেট প্রতি চল্লিশজনের জন্য গড়ে একটা করে।

এই ধরণের ডিটেনশন ক্যাম্পের কনসেপ্ট নাৎসী জার্মানী থেকে নেওয়া। ১৯৩৩-এর ৩০-শে জানুয়ারি হিটলার জার্মানীর চ্যান্সেলর হয়েই ২৪-শে মার্চ এনাবলিং অ্যাক্ট পাশ করিয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা হাতে নেয়। আর ৩০-শে মার্চ মিউনিখের কাছে দাচাউয়ে প্রথম ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরীর কাজ শুরু হয়। ১-লা এপ্রিল ইহুদী ব্যবসাদারদের বয়কটের ডাক দেওয়া হল, ৭-ই এপ্রিল অনার্য পেশাদার ও আইনজীবীদের সরকারী দপ্তরে চাকরী করা নিষিদ্ধ হল, ১০-ই মে সারাদেশে জার্মান ছাড়া অন্য সমস্ত ভাষায় লেখা বই পোড়ানো ‘উৎসব’ পালিত হল।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
ঘোষণা হল, কোন ইহুদী তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রী করে দেশ ছেড়ে পালাতে চাইলে তার ৯০ শতাংশ অর্থ ট্যাক্স হিসেবে জমা দিতে হবে সরকারী কোষাগারে। ১৯৩৫-এর সেপ্টেম্বরে ন্যূরেমবার্গ অ্যাক্টের মাধ্যমে জার্মান রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য জার্মানদের সঙ্গে ইহুদীদের বিয়ে বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হল, কোন ইহুদী পরিবারে ৪৫ বছরের কমবয়সী কোন জার্মান মহিলার কাজ করা নিষিদ্ধ হল। একইসঙ্গে রাইখ সিটিজেনশিপ অ্যাক্টে বলা হল যারা প্রমাণ দিতে পারবে যে তাদের বাপ-মা তো বটেই, ঠাকুর্দারা ও ঠাকুর্মা-দিদিমাও জার্মান, তারাই নাগরিকত্ব পাবে।

গোড়ার দিকে জার্মান কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা শুরু হল, তারপর রাখা হল হোমোসেক্সুয়ালদের, তারপর রোমা বা রোমানিদের। এরপরের টার্গেট হল ট্রেড ইউনিয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, গবেষকরা। ১৯৩৮-এর ৯-১০ নভেম্বর অস্ট্রিয়া দখলের সঙ্গে সঙ্গে রাতভর (কুখ্যাত ‘নাইট অব্ ব্রোকেন গ্লাস’) সারাদেশের সমস্ত ইহুদী মহল্লায় মুখঢাকা নাৎসী পার্টির গুন্ডারা লোহার রড্ হাতে ভাঙচুর, লুঠপাট, মারধর চালালো। পরেরদিন যারা আক্রান্ত, সেই ইহুদীদেরকেই গণ-গ্রেফতার করা হল। বেছে বেছে অ্যাডাল্ট পুরুষদেরকেই অবশ্য গ্রেফতার করা হল যাতে মহিলা ও শিশুদের নিয়ে নাৎসী যুবরা এট্টু ফূর্তি করতে পারে!

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
এরপর নাৎসি পার্টির সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হল ‘ফাইনাল সলিউশন টু দ্য জিউস কোয়েশ্চেনস্’। সেইমত প্রত্যেক শহরে ইহুদীদের জন্য পৃথক মহল্লা ইয়ারমার্কড্ করে দেওয়া হল, যার বাইরে কোন ইহুদী থাকতে পারবে না। কয়েক হাজার এরকম ইহুদী বস্তি বা ghetto চিহ্নিত করে সেগুলোকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলা হল, যেখানে প্রতি ঘরে গড়ে ৩০-৪০ জনকে থাকতে বাধ্য করা হত।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
পরের বছর সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড আক্রমণ করল জার্মানী। অধিকৃত পোল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় তৈরী করা হ’ল সবচেয়ে কুখ্যাত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো। মোট পাঁচ কিসিমের ক্যাম্প করেছিল নাৎসিরা – এক) ‘দেশের শত্রুদের’ জন্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প; দুই) প্রতিবাদীদের জন্য ফোর্সড্ লেবার ক্যাম্প; তিন) ট্রানজিট ক্যাম্প – ডেথ চেম্বারে পাঠানোর আগে এখানে অপেক্ষা করানো হত; চার) পোলিশ ও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের জন্য থার্ড ডিগ্রী টর্চার ক্যাম্প, পাঁচ) কিলিং সেন্টার অর্থাৎ গ্যাস চেম্বার – ভেন্টিলেশন-বিহীন বন্ধ একটা ঘরে কয়েকশোজনকে একসাথে হাত বেঁধে ঢুকিয়ে কয়লার ইঞ্জিন চালিয়ে কালো ধোঁয়া (কার্বন মনোক্সাইড) দিয়ে অথবা জাইক্লেন বি (হাইড্রোজেন সায়ানাইড) নামক কীটনাশক প্রয়োগ করে মারা হত।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ও ফোর্সড্ লেবার ক্যাম্পে এক একটা ঘরে গড়ে ৭.২ জনকে রাখা হত, দৈনিক মাথাপিছু ২৫৩ ক্যালরির খাবার বরাদ্দ ছিল (সেসময় জার্মানদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল দৈনিক ২৬১৩ ক্যালরি), ৩০ জন পিছু একটা করে টয়লেট ছিল। অপুষ্টিতে আর টাইফাসে ভুগেই মারা গেল আদ্দেক বন্দী। বাকীদেরকে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। চিকিৎসকরা যাদের দুর্বল, প্রতিবন্ধী বলে সার্টিফিকেট দিত, তাদের লাইন করে ঢোকানো হত গ্যাস চেম্বারে। নাৎসি ডাক্তাররা অবশ্য তার আগে তাদের যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট ট্রায়াল দিয়ে নিত এদের উপর গিনিপিগের মত। প্রতি ক্যাম্পে গ্যাস চেম্বার খুলতে খরচ বেশী, তাই মোবাইল গ্যাস ভ্যান চালু ছিল যা এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে শিফটে পাঠানো হত। প্রতিদিন গড়ে ছ’হাজার মানুষকে মারা হত এভাবে। মোট যে ষাট লক্ষ ইহুদীকে মেরেছিল ফ্যাসিস্টরা, তার অর্ধেককেই এই ক্যাম্পগুলোতে মারা হয়েছিল। এই অপারেশন রেইনটার্ড কার্যকরী করত গেস্টাপো বাহিনী, আধাসামরিক ‘সুৎজ্ স্টাফেল’ (এসএস) বাহিনী এবং নাৎসি পার্টি একযোগে।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদতে রাজ্যগুলিকে একাধিক ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরীর নির্দেশ এসেছে অমিত শাহের দপ্তর থেকে। এমনকি প্রত্যেক ডিটেনশন ক্যাম্পে প্রস্তাবিত স্টাফিং প্যাটার্নও নাৎসি ক্যাম্পের মতই – একজন কম্যান্ড্যান্ট ও তাঁর সহায়ক কর্মচারীবৃন্দ, ডিটেনশন অফিসার ও তাঁর সহায়কবৃন্দ, অ্যাডমিন ও সরবরাহ দপ্তর এবং একজন প্যারামিলিটারী ডাক্তার। ফ্যাসিবাদ আপনার দরজায় কড়া নাড়ছে, এখনো ঘুমোচ্ছেন ?(মতামত লেখকের নিজস্ব)

RELATED ARTICLES

Most Popular