Homeএখন খবরডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা: এক আলোকবর্তিকা (প্রথম ভাগ) ।। অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা: এক আলোকবর্তিকা (প্রথম ভাগ) ।। অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা: এক আলোকবর্তিকা-১                               অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

গুরুর টেলিস্কোপে প্রথম ব্রহ্মান্ড দর্শন শিষ্যের

অখণ্ড মেদিনীপুর একটি অতি প্রাচীন জেলা। বাংলা এবং উড়িষ্যার মাঝখানে এর অবস্থান। আয়তন এবং লোকসংখ্যাতে ও মেদিনীপুর প্রায় সর্বপ্রধান জেলা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে। তবে মেদিনীপুর কেবলমাত্র একটি জেলা নয়, অখণ্ড ভারতবর্ষের বিভিন্ন যুগপর্বের অন্যতম এক সংস্কৃতি ধারার কেন্দ্র যার উৎপত্তি সুপ্রাচীনকালে হয়েছিল। ইতিহাস বিজ্ঞানবিদ (Buckle) তাঁর রচিত ‘History of Civilization’ গ্রন্থে বলেন, “দেশের জলবায়ু, খাদ্য, মৃত্তিকা ও স্বাভাবিক অবস্থার উপর মনুষ্যের শারীরিক ও সামাজিক অবস্থা অনেক পরিমানে নির্ভর করে।” – মেদিনীপুর জেলার ভিন্ন প্রকার জলবায়ু, খাদ্য, মৃত্তিকা – এই জেলাকে অনেক কৃতিসন্তান উপহার দিয়েছে, যাঁদের কৃতিত্বে আজ অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ভারত তথা বিশ্বের দরবারে অত্যন্ত পরিচিত নাম। মহাপুরুষেরা তীর্থঙ্কর, তাদের জন্ম, মৃত্যু বা কার্য স্থলে একটি বিশেষ পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য বিরাজ করে। বীরসিংহের সিংহশিশু ‘বিদ্যাসাগর’ তো মেদিনীপুরকে তীর্থ করে গেছেন। তেমনিভাবে আর এক বিস্ময় প্রতিভা সম্পন্ন বিজ্ঞানী ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক সবুজ ঘেরা ছোট্ট গ্রাম ‘সাউরী’ কে সারা ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের কাছে মহাতীর্থে পরিণত করে গেছেন।

ছোট্ট সবুজ ঘেরা গ্রাম ‘সাউরী’ তে তখনও শোভা পেত লম্ফ কিংবা হ্যারিকেনের আলো। বেশিরভাগ ঘর-বাড়ি জীর্ণ, মাটির দেওয়াল দেওয়া, সাথে খড়ের ছাউনি। গ্রামের অধিকাংশ রাস্তাই কাঁচা। এই গ্রামের বাসিন্দা রাজেন্দ্রনাথ ছিলেন ঈশ্বর পরায়ণ। তাঁর স্ত্রী নাকফুড়ি দেবী অত্যন্ত সহজ, সরল এক দেবীমূর্তি। স্বামী, স্ত্রী দুজনেই ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। রাজেন্দ্রনাথ কাঁসা ও পিতলের দক্ষ কারিগর, মন্দিরে পিতলের নক্সা অতি সূক্ষ্ম ও সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। সাউরী বাস-রাস্তার উপরে ছোট্ট একটি বসতবাড়ি, মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল দেওয়া, অভাব অনটন নিত্যসঙ্গী, তবু রাজেন্দ্রনাথ ও নাকফুরীদেবী পাশের ‘প্রপন্নাশ্রমে’ পরমেশ্বরের কাছে মিনতি করেন সন্তান কামনায়। ভক্তের ডাকে পরমেশ্বর ‘সাউরী’ তে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে প্রেরণ করেন, যিনি পরবর্তীকালে ‘সাউরী’ কে বিশ্বের দরবারে সম্মানিত করেন।

১৯৫৪ সালের ১০ই অক্টোবর ‘সাউরী’ গ্রামে নাকফুঁড়ি দেবীর কোল আলো করে জন্ম নেন ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা, সারা গ্রামের আদরের ‘নারাণ’। বাবা রাজেন্দ্রনাথ প্রবল দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতেও ঘরে একটি পাঠশালা চালাতেন। বাবার কাছে প্রথাগত শিক্ষার শুরু, শুভঙ্করীর শ্লোক লেখা, খোলা আকাশের নিচে বাবার সাথে মুখে মুখে অঙ্ক শেখা – যেন সূচনা নির্দেশ করে পরবর্তীকালের মহান -এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে। বাবার পাঠশালাতে ‘নারাণ’ -এর মাঝে মাঝেই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়, পড়াতে পড়াতে বাবা যখন কাঁসা ও পেতলের কাজ করতে উঠে যেতেন, তখনই ‘নারাণ’ শুরু করত মাস্টারি অন্যান্য ছাত্রদের উপর। ছাত্রদের না বোঝা পড়াগুলি ‘নারাণ’ সুন্দরভাবে তাদের বুঝিয়ে দিতেন ওই ছোট্ট বয়েসে। বাবার পাঠশালা থেকে সরাসরি, “সাউরী প্রাথমিক বিদ্যালয়” -এ তৃতীয় শ্রেণীতে ১৯৬১ সালে ভর্তি হন। এই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক (পশুপতি মিশ্র মহাশয়) সেই ছোট্ট মেধাবী ছেলেটির অঙ্কে মেধা ও সুন্দর হস্তাক্ষর দেখে চমৎকৃত হয়ে বলেছিলেন, “এই ছেলেটি পড়াশুনায় বহুদূর যাবে।” সত্যি সত্যি সেদিনের সেই ছোট্ট মেধাবী দরিদ্র ‘নারাণ’ পরবর্তীকালে হলেন বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী যশস্বী গবেষক ও অধ্যাপক ডঃ নারায়ণচন্দ্র রাণা।

বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিজ্ঞানী সাধকেরা দুই ধরণের। প্রথম ধরণের বিজ্ঞানী যাঁরা বিস্মকর আবিষ্কার করেছেন অথচ তাঁদের অনেকের প্রতিভার বিচ্ছুরণ, বিদ্যাবুদ্ধির দীপ্তি ছোটবেলাতে সেভাবে প্রকাশ হয়নি- বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। সর্বকালের অন্যতম সেরা উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন, বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন, এই ধরণের বিজ্ঞানী। শিক্ষকেরা এদের মধ্যে কোনো বিশেষ গুনের সন্ধান পাননি যার ভিত্তিতে তাঁরা অনুমান করতে পারতেন এদের ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। দ্বিতীয় প্রকার বিজ্ঞানী যাঁদের বিস্ময়কর প্রতিভা, অসাধারণ মেধাশক্তি, বহুমুখী চিন্তাধারা ও অসামান্য ধীশক্তির পরিচয় ছোটবেলা থেকেই ফুটে ওঠে। জ্যোতির্বিদ ডঃ রাণা ছিলেন দ্বিতীয় ধরণের বিজ্ঞানী।

প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ করে গ্রামের স্কুলে “সাউরী ভোলানাথ বিদ্যামব্দির” -এ ভর্তি হন নারাণ। চরম দারিদ্রতাকে সঙ্গী করেও চলে তার কঠিন অধ্যাবসায়, অসম্ভব নিষ্ঠা, অনমনীয় আত্মবিশ্বাস ও প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করেই মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ‘বিস্ময়-বালক’ হয়ে উঠলেন সমস্ত শিক্ষক মহাশয়ের কাছে। সারাদিন হয়ত অভুক্ত তবুও ইস্কুল থেকে ফিরে ভেঙে পড়তেন না। ক্ষুধার জ্বালায় ছট ছট করতেন, অপেক্ষা করতেন যতক্ষণ না তাঁর মা গ্রামের সম্পন্ন বাড়ি থেকে কাজ করে অল্পকিছু খাবার নিয়ে ফিরতেন। এই সীমাহীন দারিদ্র হয়তবা তাঁকে আর দৃঢ়চেতা করে তোলে। অপরের বাড়ি থেকে ধার করে নিয়ে আসা বই উনুনের আগুনের আলোতে পড়তে থাকতেন, রাত জেগে লিখতে থাকতেন বই এর পড়া যতক্ষণ পর্যন্ত না লেখা শেষ হয় – হয়ত মনে মনে আওড়াতেন “হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান।”

মেধাবী ‘নারাণ’ ছিলেন কামিল্যা বাড়ীর ছেলে, সাথে সহপাঠী হিসেবে পান গৌর (ডঃ গৌরহরি রাউত) যিনি নমঃশুদ্র বাড়ীর। তখন সরকার তপসীলি জাতি ও উপজাতি ছাত্রদের জন্য হোস্টেল চার্জ ও বেতন এবং গোল্ডস্মিথ ছাত্রদের জন্য কেবলমাত্র বেতনভার বহন করতেন। ফলে সপ্তম শ্রেণী থেকেই ইস্কুলের ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পান নারাণ ও গৌর। ডঃ রাণার হোস্টেলের খরচ প্রায় পুরোটাই বহন করতেন তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মহাশয় শ্ৰীযুত শ্রীনিবাস নন্দ। শিক্ষকরাই জাতির মেরুদণ্ড, সমাজ গঠনের কারিগর – চেতনার আলোকে প্রজ্ঞা জ্বালান শিক্ষকেরা। নিত্য গুরু বন্দনায় তাই ধ্বনিত হয় “অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলকয়া। চক্ষুরুন্মীলিতং, যেন তস্মৈ শ্রী গুরুব নমঃ”।শিক্ষকই প্রকৃত জ্ঞানদাতা, এমন মর্যাদা সম্পন্ন মহত্বমন্ডিত ব্যক্তির কাছে সমাজ শ্রদ্বাবনত হয়, জ্ঞানী, আচার নিষ্ঠ কর্তব্য পরায়ণ শিক্ষকই ছাত্র গড়ার প্রকৃত কারিগর।এমনই এক প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষক শ্রীযুত মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী ১৯৬৩ সালে ‘সাউরী ভোলানাথ বিদ্যালয়’ -এ যোগদান করেন। এই শিক্ষক যেন সেই পরশ পাথর যার চরণ স্পর্শে এই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পড়ে, ছাত্র ‘নারাণ’ -এর জীবনপথ এক অন্যদিকে মোড় নেয়।

এই জন্মশিক্ষক ‘মনী বাবু’ হাতে নাতে Practical করতেন সারাক্ষন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন মডেল তৈরী করতেন। কানে হেডফোন লাগিয়ে অবসর সময়ে বিদেশের থেকে আনা বিভিন্ন বই পড়াশুনো করতেন। এছাড়া ‘মণীবাবুর’ আকাশ পর্যবেক্ষণ করার এক নেশা ছিল। সারাদিন শিক্ষকতার পর গভীর রাতে যখন চারিদিক নিস্তব্ধ তখন নিঃশব্দে ঘরের দ্বার খুলে ইস্কুল মাঠে এসে দাঁড়াতেন মণীবাবু, হাতে টেলিস্কোপ। তিনি জানতেই পারতেন না কখন চুপিসারে তারই অতি প্রিয় ছাত্র পেছন পেছন অনুসরণ করে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সারারাত ধরে এই গুরু শিষ্য রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। তাই হয়ত প্রাচীন ভারতে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ধ্বনিত হতো “মাতৃ দেবভব, পিতৃ দেবভব, আচার্য দেবভব।” আকাশ ভরা তারা দেখে বিস্ময় ও কৌতূহল দুজনেরই। গুরু শিষ্য আকাশের অলিগলিতে তারামণ্ডল, ছায়াপথ, নীহারিকার জগতে হারিয়ে যান সারা রাত। মনিবাবু বলতে থাকেন- এই ‘আকাশ’ অবশ্যই কাল্পনিক কারণ চারপাশে আছে কেবলই শূন্যস্থান। বিস্মিত নারাণ অবাক চোখে দেখে এত অগুনতি তারা আকাশের মানচিত্র (Sky Map) নিয়ে শিক্ষক-ছাত্র খুঁজে বেড়ান, ক্যাসিওপিয়া, কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল…..পার্সিয়ুস, আন্ড্রোমিডা, দ্য সোয়ান।

একমনে নারাণ শুনে চলেন শিক্ষক মণীবাবুর কথা- এ মহা বিশ্বে তারা জগতের মোট সংখ্যা কত, তা জানবার কোন উপায় নাই। এ পর্যন্ত প্রায় দশকোটি তারা জগৎকে গোনা সম্ভব হয়েছে আলোর ও বেতার দূরবীনের সহায়তায়। বেতার দূরবীন একদিন হয়ত আমাদের আরো অনেক তারা জগতের সন্ধান এনে দেবে কিন্তু নাগালের বাইরে যে কত তারা জগৎ রয়ে গেল তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য।একমনে শিক্ষকের কথা শুনতে থাকেন, টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে থাকেন নারাণ। হঠাৎ স্যারকে জিজ্ঞেস করেন- আচ্ছা আমাদের ঘরের কাছের তারা হলো সূর্য- যা আমাদের অন্য তারাদের চিনতে শিখিয়েছে। সূর্যের সর্বাঙ্গ প্রচন্ড তাপে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, সূর্যে যে রাসায়নিক পদার্থ আছে এরা রয়েছে জ্বলন্ত গ্যাস রূপে- এখন সেগুলো যে আদৌ গ্যাস রূপে রয়েছে, সে কথা বিজ্ঞানীরা টের পেলেন কি করে? গুরু শিষ্যের প্রশ্নোত্তরে কেটে যায় রাত।এভাবেই মনিবাবুর হাতধরে মহাকাশ সম্পর্কে ধারণা ও আকাশ দেখার নেশাই যেন পরবর্তীকালের ভাবি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্ব ছিল।……আগামীকাল-দ্বিতীয় ভাগ

Reference (তথ্য সূত্র):

১. ‘ডঃ নারায়ণ চন্দ্র রানা’র ভাই শ্রীযুত সুজন কান্ত রানা এর সাক্ষাৎকার।
২.সৃজন, সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারক পত্রিকা, সাউরী ভোলানাথ বিদ্যামন্দির (২০০৮)।
৩.প্রবন্ধ: ডঃ নারায়ণ চন্দ্র রানা, বঙ্কিম বিহারী মাইতি।

RELATED ARTICLES

Most Popular