Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল - ৪১

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৪১

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৪১
মৃত্যুঞ্জয় শিব মন্দির, নাড়াজোল (দাসপুর- ১) 
চিন্ময় দাশ


৬০০ বছরেরও বেশি সময়কাল আগের কথা। মেদিনীপুরের নাড়াজোল পরগণায় জনৈক উদয় নারায়ণ ঘোষ একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন ৮২০ বঙ্গাব্দ, ইং ১৪১৩ সাল। বাংলার ইতিহাসে সেটি এক যুগসন্ধিক্ষণ। ইলিয়াস শাহী বংশের গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের পতন, আর রাজা গনেশের শাসন পত্তন হচ্ছে সেসময়।
উদয় নারায়ণ রাজধানী গড়েন নাড়াজোল গ্রামে। মেদিনীপুর নগরী থেকে ১২ ক্রোশ (প্রায় ৪০ কিমি) দূরে। শিলাবতী আর কংসাবতী– দুই নদীর উর্বর অববাহিকা অঞ্চল সেটি।


উদয় নারায়ণের পর, বাংলায় নবাবী শাসনের শেষ পর্ব পর্যন্ত, ক্রমান্বয়ে ১৩ জন জমিদারী করেছেন– প্রতাপ নারায়ণ, যোগেন্দ্র নারায়ণ, ভরত নারায়ণ, কার্তিকরাম, জয়মণি, শ্যামসিংহ, বলবন্ত, গুণবন্ত, মহেশচন্দ্র, অভিরাম, যদুদাস এবং মতিরাম। এখানে দুটি-একটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। ১. ৫ম জমিদার কার্তিকরাম নবাব দরবার থেকে ‘রায়’ খেতাব পেয়েছিলেন। ২. পরে, ৮ম জমিদার বলবন্ত ‘খাঁন’ উপাধি পান। তখন থেকে এই বংশ ‘খাঁন’ পদবি ব্যবহার করে আসছে। ৩. ১৭৫২ সালে মতিরাম খাঁন পুত্রহীন অবস্থায় মারা যান। তখন এই বংশে ‘জ্যেষ্ঠাধিকার’ রীতির বাইরে বেরিয়ে, মতিরামের খুড়তুতো ভাই (সভারামের পুত্র) সীতারাম খাঁন জমিদার হয়েছিলেন।


সীতারাম ছিলেন নবাবী শাসনকালের শেষ জমিদার। তাঁর পর এই বংশের সকলেই ইংরেজ আমলে জমিদারি করেছেন। সীতারামের শাসনকাল ৩২ বছর, ১৭৫২ থেকে ১৭৮৪ সাল। তাঁর শাসনের ৫ম বছরেই পলাশীর যুদ্ধ, বিদেশী শাসনের সূচনা। সীতারামের পুত্র আনন্দলাল জমিদার হয়ে, অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। তখন তাঁর ভাইপো অযোধ্যারাম জমিদার হন। অযোধ্যারামের পর তাঁর পুত্র মহেন্দ্রলাল, পরে মহেন্দ্রলালের পুত্র নরেন্দ্রলাল জমিদার হন।জমিদারী বংশাবলী রেখে, মন্দির প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, শেষ দুই জমিদারের প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা দরকার। মহেন্দ্রলাল ছিলেন এই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি এবং পার্শি ভাষায় যেমন ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন, তেমনই সঙ্গীতপ্রিয় ও কাব্যনুরাগী। পরিণত বয়সে অনেকগুলি কাব্য এবং সংগীত বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন– সংগীত-লহরী, মানমিলন, গোবিন্দ গীতিকা, মথুরা মিলন, শারদোৎসব ইত্যাদি তার অন্যতম। ১৮৮৭ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ খেতাবে ভূষিত করেছিল।


মহেন্দ্রর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ইংরেজি ভাষায় নাড়াজোল রাজবংশের ইতিহাস রচনা। মৃত্যুর ৩ বছর পূর্বে, ১৮৮৯ সালে HISTORY OF THE MIDNAPORE RAJ নামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশক—THAKER, SPINK & Co. । গ্রন্থের প্রচ্ছদে লেখা হয়েছিল– COMPOSED BY RAJAH MOHENDRO LALL KHAN, ZEMINDAR OF MIDNAPORE AND NARAJOLE, &c.
মহেন্দ্রলালের পত্নী রানি নিস্তারিণী দেবী। তাঁদের একমাত্র পুত্র রাজা নরেন্দ্রলাল খাঁন। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ভাষায় সুদক্ষ নরেন্দ্রলাল সঙ্গীত অনুরাগীও ছিলেন। শিক্ষাপ্রসার এবং জনকল্যাণে বহু অর্থ ব্যয় করেছিলেন তিনি। নাড়াজোলের রাজপ্রাসাদ, মেদিনীপুরে গোপগড়ে একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ তাঁরই সুকীর্তি। পরবর্তীকালে, গোপগড়ের প্রাসাদটিতে মহিলা মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ১৮৯৫ সালে ইংরেজ সরকার নরেন্দ্রলালকে ‘রাজা’ খেতাব প্রদান করে।
তবে, নরেন্দ্রলালের বিরল কীর্তি, মেদিনীপুর নগরীতে পানীয় জলের ট্যাংক নির্মাণ করা। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হাত ধরে, ‘খিলান-রীতি’র কারিগরী এসেছিল বাংলায়। সেই রীতিতে বহু মন্দির, মসজিদ, গির্জা নির্মিত হয়েছে। নরেন্দ্রলাল এক বিরল পথে হেঁটেছিলেন। খিলান কারিগরি ব্যবহার করে, সাধারণ মানুষের পানীয় জলের জন্য, মেদিনীপুর শহরে জলাধার নির্মাণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘RAJA NARENDRA LALL KHAN WATER WORKS’ নামে আজও সেটি সচল অবস্থায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।


রাজকাহিনী থেকে আমরা এবার মন্দির প্রসঙ্গে যাই। রাজধানী নাড়াজোলের দুটি অংশ– ভিতরগড় আর বাহিরগড়। ভিতরগড়েই রাজপ্রাসাদ, ঠাকুরবাড়ি ইত্যাদি। বংশের আদিপুরুষ উদয় নারায়ণ এখানে জয়দুর্গা মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত অন্দর মহলের বিখ্যাত মন্দির গোবিন্দজীউর নবরত্ন। এখানে অযোধ্যা থেকে আনা বেলেপাথরের আর একটি মন্দির হোল সীতারাম জীউর মন্দির।


ঠাকুরবাড়ির ঠিক বাইরে, পশ্চিমমুখী একটি শিবমন্দির গড়ে তোলা হয়। রাজা মহেন্দ্রলালের পত্নী, এবং রাজা নরেন্দ্রলালের মাতা রানি নিস্তারিনী দেবী এটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের দ্বিতলের দেওয়ালে একটি প্রতিষ্ঠালিপি দেখা যায়।
উঁচু পাদপীঠ আর প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ সহ ইটের তৈরী আট-চালা শৈলীর মন্দির। অলিন্দ নাই, সরাসরি গর্ভগৃহে প্রবেশ। দ্বারপথটি খিলান-রীতির। তবে, বাকি তিন দিকেও, তিনটি ‘চাপা-জগমোহন’ এবং ‘প্রতিকৃতি দ্বারপথ’ রচিত আছে।
মন্দিরের কার্নিশগুলির বঙ্কিম ভাবটি বেশ নয়ন মনোহর। সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বহু টেরাকোটা ফলকে অলংকৃত করা হয়েছিল মন্দিরটিকে। কার্নিশগুলির নীচ বরাবর এবং কোনাচগুলির গায়ে খাড়া সারিতে ফলকগুলি লাগানো। মোটিফ হিসাবে দেখা যায়– সীতা সহ রামের রাজ্যাভিষেক, রাধাকৃষ্ণ, হস্তিবাহন বিশ্বকর্মা, গরুড়বাহন বিষ্ণু, ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ, বকাসুর বধ, হলধর বলরাম, দশাবতার ইত্যাদি।


এগুলি পৌরাণিক বিষয় নির্ভর। সামাজিক বিষয় হিসাবে আছে– ইউরোপীয় পোশাকে সৈনিকপুরুষ, রাখাল বালক, সন্ন্যাসীমূর্তি, অনেকগুলি নর্তকী মূর্তি ইত্যাদি। সন্ন্যাসীবেশে দ্বারপালক মূর্তিও আছে মন্দিরে। দ্বারপথের মাথার প্রস্থটিতে পঙ্খের কারুকাজ করা।
তবে, আশঙ্কার কথা, জীর্ণতা গ্রাস করতে শুরু করেছে মন্দির এবং ফলকগুলিকে। মন্দিরে দেবতার সেবাপূজা প্রচলিত থাকলেও, মন্দিরের উত্তরের নাটমন্দিরটি পরিত্যক্ত। প্রতিবেশীদের অত্যাচার শুরু হয়েছে সেই অংশটিতে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সর্বশ্রী সন্দীপ খাঁন, অরিজিৎ খাঁন, দেবাশীষ ভট্টাচার্য– নাড়াজোল।
অরিন্দম ভৌমিক– মেদিনীপুর শহর।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর শহর থেকে নাড়াজোল যাওয়ার সরাসরি গাড়ি আছে। এছাড়া, পাঁশকুড়া কিংবা ঘাটাল থেকে বকুলতলা হয়ে, নাড়াজোল আসা যাবে।

RELATED ARTICLES

Most Popular