Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-৮৩।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-৮৩।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
                                          চিন্ময় দাশ 

খড়্গেশ্বর শিব মন্দির, ইন্দা (খড়্গপুর শহর) ‘বাংলায় ভ্রমণ’ নামে ভারতীয় রেলপথ বিভাগের প্রকাশিত একটি গ্রন্থ আছে। সেখানে খড়্গপুরের পরিচিতি হিসাবে বলা হয়েছে– “রেলের কল্যাণে খড়গপুর একটি নগন্য গন্ডগ্রাম হইতে প্রশস্ত রাজবর্ত্ম শোভিত ও বিদ্যুৎ-আলোকোজ্জ্বল বিশাল শহরে পরিণত হইয়াছে। … পূর্বে এই স্থানে একটি বিস্তীর্ণ মরুভূমির মত তরুলতাহীন উচ্চ ভুখন্ড ছিল। চারিদিকে সমতল ভূমি হইতে ইহা প্রায় ৪০ ফুট উচ্চ ছিল এবং লোকে ইহাকে ‘ খড়্গপুরের দমদমা ‘ বলিত। ইহার উপর হইতে চতুর্দিকে বহুদূর গ্রামগুলিকে নিম্নভূমি বলিয়া মনে হইত। খড়্গপুরে মাটির রঙের পরিবর্তন লক্ষিত হয়। এখান হইতেই পাথুরে মাটি ও গৈরিক রঙ আরম্ভ হইয়াছে। ”
খড়্গপুর বা মেদিনীপুর শহর হল ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্বদিকের প্রলম্বিত প্রান্তদেশ। প্রকৃতপক্ষে এখান থেকেই রক্তবর্ণের উচ্চাবচ ভূমির সূচনা। কিন্তু রেল পত্তনের আগে যে খড়্গপুর গন্ডগ্রাম ছিল, একটি প্রাচীন শিবালয় ছিল সেখানে। ছিল মহাভারতের সাথে কিংবদন্তির সুতোয় বাঁধা দেবী হিড়িম্বেশ্বরী-র একটি মন্দিরও।
অবশ্য রেলবিভাগ এই দুটি মন্দিরের বিষয়ও উল্লেখ করেছে গ্রন্থটিতে– ” স্টেশনের নিকট ইন্দাগ্রামে খড়্গেশ্বর নামে শিবের একটি পুরাতন মন্দির আছে। ইহা খড়্গপুর থানার কলাইকুণ্ডা গ্রামের ধারেন্দার রাজা খড়্গ সিংহের নির্মিত। মতান্তরে বিষ্ণুপুর রাজ খড়্গমল্ল ইহার প্রতিষ্ঠাতা। মন্দিরটি একটি বিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে অবস্থিত। এই স্থানের নাম ” হিড়িম্বডাঙা “। প্রবাদ, বনবাসকালে পঞ্চ পান্ডব এই স্থানে আগমণ করিলে হিড়িম্ব রাক্ষসের সহিত তাহাদের সংঘর্ষ হয় এবং ভীমের হস্তে হিড়িম্বের নিধন ঘটে। হিড়িম্বের ভগিনী হিড়িম্বা ভীমের রূপে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করে। হিড়িম্বের নাম হইতেই ‘ হিড়িম্বডাঙ্গা’ নাম। ”
খড়্গপুর শহরের ইন্দা মহল্লায় আজও এই মন্দির দুটি অবস্থিত আছে। তবে, তার ভিতর খড়্গেশ্বর শিবের প্রাচীন মন্দিরটি প্রকৃতপক্ষে কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার নিস্পত্তি আজও হয়নি। পাঠক-পাঠিকা বর্গের অবগতির জন্য, আমরা দুই খড়্গসিংহ-এর সময়কালটি পেশ করতে পারি এখানে। ১. ধারেন্দার পাল রাজারা মেদিনীপুরে এসেছিলেন হুগলি জেলার দশঘরা থেকে। সেখানে তাঁরা ‘সেঙ্গাই বেঙ্গাইর জমিদার’ নামে পরিচিত ছিলেন। মুসলমান রাজকর্মচারীদের অত্যাচারে গঙ্গা পার হয়ে মেদিনীপুর জেলায় এসে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই পালবংশে খড়্গসিংহ পাল রাজা হয়েছিলেন ইং ১৬৮০ সাল নাগাদ।
২. অপরদিকে, বিষ্ণুপুরে মল্লবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইং ৬৯৪ সালে, আদিমল্ল-এর হাতে। সেই বংশে খড়্গমল্লের শাসনকাল ৮৪১ – ৮৬২ সাল।
পালরাজার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকলে, মন্দিরে বয়স দাঁড়ায় সাড়ে তিনশো’ বছর। মল্লরাজার হলে, সেটি এগারশো বছরেরও বেশি আগের কথা। মেদিনীপুর জেলায় এত প্রাচীন কোনো মন্দির নাই। সেকারণে, মন্দিরটি পাল রাজাদের হাতে নির্মিত বলেই আমাদের অভিমত।পালবংশের শেষ রাজা ছিলেন জনৈক নারায়ন চন্দ্র পাল। ‘রাজাবাবু’ নামে পরিচিত দানশীল রাজা নারায়ণের সময় অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে সমূহ জমিদারী নিলাম হয়ে যায়। মেদিনীপুর শহরের খ্যাতনামা উকিল কৃষ্ণলাল মজুমদার ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে মন্দির সহ সমগ্র ইন্দা মৌজা ইজারা হিসাবে নিয়ে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন।
মেদিনীপুর জেলার সমাজ জীবনে এই মজুমদারবংশের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। মেদিনীপুর শহরে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর পত্তন হয়েছিল এই মজুমদার বাড়িতেই। নজরুল ইসলাম, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, জলধর সেন প্রমুখগণ এসেছেন সেখানে। স্বদেশী আন্দোলনেও ভূমিকা ছিল বাড়িটির। এই বাড়ির হলঘরে আয়োজিত সভায় যোগ দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, বিপ্লবী দীনেশ চন্দ্র প্রমুখ। আনি বেসান্ত বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছেন সেই হলঘরে।
যাইহোক, মন্দিরের মালিকানা কৃষ্ণলাল মজুমদারের হাতে আসার পূর্বেই, কালাপাহাড়ের আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল মন্দিরে। অন্যান্য ক্ষতি ছাড়াও, জগমোহন এবং মূলমন্দিরের দুটি চূড়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বহু অর্থ ব্যয় করে, কৃষ্ণলালই ভগ্ন মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন। দেবতার সেবাপূজায় একটি শৃঙ্খলার পত্তন হয় তখন থেকে।
কৃষ্ণলালের পৌত্র, বিশিষ্ট প্রবীণ আইনজীবী, লহর মজুমদার বর্তমানে মন্দির আর সেবাপূজার তত্ত্বাবধায়ক। জানা যায়, বিশেষ উৎসবগুলি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠিত আছে। স্থানীয় খড়্গেশ্বর বয়েজ ক্লাব-এর সদস্যগণও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন উৎসবগুলিতে।
খড়্গেশ্বরের পূর্বমুখী এই মন্দির মাকড়া পাথরের সৌধ, নির্মিত হয়েছে শিখর-দেউল রীতিতে। সামনে জগমোহন, মাঝখানে একটি অন্তরাল অংশ এবং পিছনে বিমান বা মূলমন্দির– এই তিনটি নিয়ে মন্দিরের গড়ন। পাদপীঠটি মাঝারি উচ্চতার। তার উপর একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে।বিমান সৌধটি আয়তাকার– দৈর্ঘ্য ১৯ ফুট, প্রস্থ ১৫ ফুট। জগমোহন সম্পূর্ণ বর্গাকার– দৈর্ঘ্য প্রস্থ দুইই ১৮ ফুট হিসাবে। মাঝখানে মাত্রই ফুট তিনেকের একটি অন্তরাল। বিমান, অন্তরাল এবং জগমোহন– তিনটি সৌধেরই ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মাণ করা হয়েছে প্রাচীন ‘লহরা রীতি’ অনুসরণ করে।
কলিঙ্গ অভিযানের পথে, পাঠান সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির আক্রমণ করেছিলেন। অন্যান্য ক্ষতি তো ছিলই, বিমান এবং জগমোহন দুটি সৌধেরই মাথার ছাউনি, শীর্ষক বা চূড়া সম্পূর্ণ এবং গন্ডীর উপরের অর্ধেক অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছিল সেসময়। পরবর্তীকালে মন্দিরের সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু মন্দির তার পূর্ব চেহারা ফিরে পায়নি। রদবদল করে ফেলা হয়েছে স্থাপত্যরীতির। ১. জগমোহনের শীর্ষক বা চূড়া সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে। তার অস্তিত্বই নাই আর। ২. গন্ডী অংশটিও বিলুপ্ত, কোনও রকমে একটি ছাউনি গড়ে নেওয়া হয়েছে মাত্র। ৩. বিমানের শীর্ষকটি বদল করে ফেলা হয়েছে। ৪. বাঢ় এবং গন্ডী জুড়ে ‘সপ্ত-রথ বিভাজন’ ছিল মন্দিরে। গন্ডীর উপরের অংশে সেটি ‘ত্রি-রথ’ হিসাবে নির্মিত হয়েছে। ৪টি ‘অনুরথ’ সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে। ৫. একই রদবদল হয়েছে বাঢ়ের নীচের অংশেও। এইসকল কারণে, দুটি সৌধের উচ্চতা উল্লেখ করিনি আমরা।
কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। অন্তত বর্তমানে নাই। পূর্বে অর্থাৎ কালাপাহাড়ের আক্রমণের পূর্বে, কিছু ছিল কি না, তা আজ আর বলা যায় না। তবে কলিঙ্গশৈলীর একটি নমুনা আছে মন্দিরের বিমান অংশে। বাঢ় অংশের ‘রাহাপাগ’-এর উপর ‘পঞ্চ-রথ রেখদেউল’ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি রচিত আছে উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম– তিনদিকের দেওয়ালেই।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী লহর মজুমদার, আইনজীবী– মেদিনীপুর শহর। সূর্যকান্ত দে, শম্ভূনাথ পাল– ইন্দা।
যাত্রাপথ : যে কোনও দিক থেকে ট্রেন বা বাসযোগে খড়্গপুর শহর। স্টেশন কিংবা বাসস্ট্যান্ড থেকে ইন্দা এসে, সেখানে কালীমন্দির থেকে সামান্য পূর্বদিকে মন্দিরটি অবস্থিত।

RELATED ARTICLES

Most Popular