Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল—৬৪

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল—৬৪

জগন্নাথ মন্দির, শরশঙ্কা (থানা– দাঁতন, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ শরশঙ্কা শব্দটিতে প্রথমে কোনও মন্দিরের কথা মনে আসে না। বরং মনে পড়ে যায় বিশালাকার এক দীঘির কথাই। আপন মহিমা আর ঐতিহ্যের গৌরবে যে দীঘি স্থান করে নিয়েছে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে।
পাঁচ হাজার ফুট দীর্ঘ আর আড়াই হাজার ফুট প্রস্থ নিয়ে এই জলাশয়ের আয়তন। কে খনন করেছিলেন এমন একটি দীঘি, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তিনটি অভিমত বেশি শোনা যায়– ১. প্রথমটি রামায়ণ-এর সাথে যুক্ত। বলা হয়, শশাঙ্কদেব নামের পাণ্ডববংশের এক রাজা পুরী যাত্রার সময় এটি খনন করেছিলেন। তবে এটির কোনও ভিত্তি আছে বলে, আমাদের মন হয় না।


২. দ্বিতীয় অভিমতটি এক কলিঙ্গ রাজার নামের সাথে জোড়া। পুরীর মন্দিরের বিখ্যাত ‘মাদলা পঞ্জী’তে শশাঙ্ক নামে গঙ্গবংশীয় এক রাজার নাম পাওয়া যায়। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, বাংলার মেদিনীপুর জেলা এই গঙ্গবংশীয় নৃপতিদের শাসনে ছিল। সেই সাড়ে চারশ’ বছরের কোনও এক সময়ে রাজা শশাঙ্ক এটি খনন করেছিলেন বলে বলা হয়।
৩. বাংলার ইতিহাসেও শশাঙ্ক নামে বিখ্যাত এক রাজার নাম আছে। ৭ম শতাব্দীর একেবারে প্রথম পর্ব তাঁর শাসনকাল। তিনিই প্রথম বাঙালি সম্রাট। তিনিই বর্ষ গণনায় ‘বঙ্গাব্দ’ প্রচলন করেছিলেন। জানা যায়, তাঁর গৌড় রাজ্যের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। তবে, ওডিশার গঞ্জাম পর্যন্ত নিজের শাসনে এনেছিলেন শশাঙ্ক। এই শশাঙ্কই শরশঙ্কা দীঘি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন– এমন অভিমত অধিকাংশেরই।


এহেন একটি জলাশয়কে বুকে ধারণ করে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল, তার নামও হয়েছিল– শরশঙ্কা। দীঘির পশ্চিম পাড়ের নীচে, বায়ুকোণ ঘেঁষে জগন্নাথদেবের একটি প্রাচীন মন্দির আছে, আজকের জার্নালে সেটি নিয়েই আমাদের আলোচনা।
শরশঙ্কা গ্রামে জগন্নাথ দেবের এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন স্থানীয় এক জমিদার। মেদিনীপুর জেলার সর্ব দক্ষিণের দুটি থানা– মোহনপুর এবং দাঁতন। এই থানা দুটিতে ” করণ ” নামক একটি বিশেষ জাতি সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর মেদিনীপুর জেলা কলিঙ্গ রাজাদের শাসনে থাকার সময়, ওডিশা রাজ্য থেকে বহু করণ পরিবার এই এলাকায় চলে এসেছিল।


বল্লাল সেনের কুলীন প্রথা স্বীকার না করায়, একসময় বাংলা থেকে ওডিশা চলে যেতে হয়েছিল করণদের। সেই রাজ্যের রাজা বা জমিদারদের দপ্তরে মুখ্যত করণিক হিসাবে কাজ করতেন তাঁরা। করণ বা করণিক হোল বৃত্তিবাচক শব্দ। করণ সম্প্রদায়ও চিত্রগুপ্তকে নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসাবে গণ্য করেন। বাংলায় করণদের জাতিগত অবস্থান সম্পর্কে ‘দ্য ট্রাইব্স এন্ড কাস্টস অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে এইচ. এইচ. রিসলে বলেছেন– এঁরা হলেন ” ইন্ডিজেনাস রাইটার কাস্ট অব ওড়িশা। ”


রিসলে সাহেবের বিবরণ থেকে আরো জানা যায়, করণদের সামাজিক অবস্থান ব্রাহ্মণদের ঠিক পরের ধাপে। করণরা উপবীতও ধারণ করেন। এগুলিও তাঁর রিপোর্টে আছে– ” করণস রাঙ্ক নেক্সট টু ব্রাহ্মিনস ইন দ্য স্কেল অব সোশ্যাল প্রিসিডেন্স কমনলি রেকগনাইজড ইন ওড়িশা … করণস উইথ সেক্রেড থ্রেড … ” ইত্যাদি। দেখা যায়, এখনও কোন কোনও করণ পরিবারে বিবাহের সময় উপনয়ন হয়ে থাকে।


এবার আমরা মন্দিরটির কথায় ফিরি। মেদিনীপুর জেলায় একেবারে দক্ষিণে দাঁতন থানার কুরুলচোর পরগণা। সেখানে জেনকাপুরের জমিদার রায়বংশের এক কন্যার বিয়ে হয়েছিল দাঁতুনিয়াচোর পরগণায় পলাশিয়াগড়ের জমিদার দাসমহাপাত্র বংশে। উভয়েই করণ সম্প্রদায়ভুক্ত। এই সম্প্রদায়ের প্রাক-বিবাহ পর্বে নির্বন্ধক, সুইকার, পানখিলি, জলসাধা, গায়েহলুদ ইত্যাদি কিছু আচার প্রচলিত আছে। সুইকার এবং গায়েহলুদ উপলক্ষে তত্ত্ব পাঠানোর রীতিও আছে। শরশঙ্কা গ্রাম ছিল জেনকাপুর জমিদারদের মহাল। জগন্নাথ মন্দিরটি তাঁরাই নির্মাণ করেছিলেন। বিয়ের তত্ত্ব হিসাবে রায় বাড়ি থেকে বিপুল সম্পত্তি দেওয়া হয়েছিল জামাতাকে।
সম্পত্তির সাথে জগন্নাথ দেবের এই মন্দিরটিও দেওয়া হয়েছিল জামাতাকে। তখন থেকে দাস মহাপাত্র পরিবারই মন্দির এবং দেবতার সেবাইত হিসাবে বহাল আছেন।


নাগর শৈলীর অনুসারী ‘শিখর দেউল রীতি’তে নির্মিত এই মন্দির। ৩টি অংশ এর– পিছনে মূলমন্দির বা বিমান। একেবারে সামনে একটি নাটমন্দির। আর, এই দুইয়ের মাঝখানে সংযোজক হিসাবে একটি উন্মুক্ত অষ্ট-দ্বারী অন্তরাল। বিশেষ উল্লেখের ব্যাপার হল, এই মন্দিরে কোনো জগমোহন নির্মিত হয়নি। সারা জেলায় এমন উদাহরণ নাই।
নাটমন্দিরের মাথায় অর্ধ-গোলাকার চালা ছাউনি। চালার জোড়মুখগুলিতে বিষ্ণুপুরের রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।


অন্তরালটি ক্ষুদ্রাকার শিখর মন্দিরের আদলে গড়া। মাথায় বেঁকি, আমলক, দণ্ড শোভিত। দুটি দ্বারপথ– নাটমন্দির এবং গর্ভগৃহের সাথে যুক্ত। মন্দিরের ৯টি দ্বারাই খিলান-রীতির।
বিমান সৌধটিতে রথ-বিন্যাস করা। ১টি রাহাপাগ, দুই কোণে ২টি কণকপগ এবং এগুলির অন্তর্বতী অংশে দুটি করে ৪টি অনর্থপগ– এই নিয়ে সপ্ত-রথ বিন্যাস। শীর্ষক অংশে বেঁকি, বড় আকারের আমলক, ২টি কলস এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত।
বিশেষ ভাবে বলতে হয় মন্দিরের পাদপীঠ বা ভিত্তিবেদীর কথা। শত শত বছর ধরে শরশঙ্কা দীঘির বিশাল উঁচু পাড় ধোয়া মাটির নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে সেটি। এখন কেবল পাদপীঠের চিহ্নটুকুমাত্র দেখা যায়।


মন্দিরে অলঙ্করণ নাই বললে চলে। গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’দিকে দুটি দ্বারপাল মূর্তি আছে। দ্বারপথটির মাথায় বিভিন্ন দেবদেবীর একসারি মূর্তি। এবং সামনের দেওয়ালে বরন্ড-এর উপর একটি জীর্ণ মিথুন-মূর্তি– এইমাত্র। সবই একান্তই মোটা দাগের কাজ, এবং বারংবার রঙের প্রলেপে শ্রীহীন।
সাক্ষাৎকার : শ্রীমতী রীনা দাস মহাপাত্র, সর্বশ্রী শুভাশিষ দাস মহাপাত্র, বিশ্বজিৎ পাহাড়ী (পুরোহিত)– শরশঙ্কা। দেবাশীষ দাস মহাপাত্র– তলকুই, মেদিনীপুর শহর।
সহযোগিতা : সর্বশ্রী সূর্য নন্দী, তরুণ সিংহ মহাপাত্র– দাঁতন।

পথ-নির্দেশ : বাস কিংবা ট্রেনে খড়গপুর – বালেশ্বর রুটে দাঁতন। সেখান থেকে পূর্বমুখে ৪ কিমি পাড়ি দিয়ে শরশঙ্কা। নিয়মিত ছোট গাড়ি যাতায়াত করে। তবে, নিজের বাহন কিংবা ভাড়াগাড়ি থাকলে ভালো। ঐতিহাসিক শরশঙ্কা দীঘিটি পরিক্রমা করে নেওয়া যাবে। যা সারাজীবনের সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে।

RELATED ARTICLES

Most Popular