Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৩৯

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৩৯

জোড় বাংলা মন্দির– চন্দ্রকোণা (দক্ষিণ বাজার)
চিন্ময় দাশ

আমাদের আজকের আলোচনা একটি জোড় বাংলা মন্দির নিয়ে। এই রীতির মন্দির নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলেন — এই রীতির উদ্গাতা বাংলার সুত্রধরগণ। কিন্তু এক পাথুরে প্রমাণ আছে এর বিপরীতে। সারনাথ আমরা যাঁরা সফর করেছি, সেখানে সংগ্রহশালাটির কথাও জানি। একটি পাথরের রেলিং সংগ্রহ আছে সেখানে, যার উপর একটি জোড় বাংলা মন্দির-এর ছবি আঁকা আছে। রেলিংটি শুঙ্গ আমলের।
শুঙ্গ রাজাদের শাসনকাল মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৭ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত। মৌর্য বংশ পতনের পর, পুষ্যমিত্র শুঙ্গ এই বংশের পত্তন করেছিলেন। স্বল্পকালের শাসন হলেও, এই আমলে শিক্ষা, শিল্প, দর্শন ইত্যাদির চর্চা বিকশিত হয়েছিল খুব। ছোট আকারের টেরাকোটা মূর্তি, বড় আকারের পাথর খোদাই, পাথরের সৌধ ইত্যাদি নির্মাণও এই সময়ে বিকশিত হয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। ভারহুত স্তুপ, সাঁচী স্তুপ ইত্যাদি এই সময়কালেরই সৃষ্টি। রেলিংটির খোদাই থেকে প্রমাণ হয় যে, খ্রীষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দী বা তার পূর্বকাল থেকেই জোড় বাংলা রীতির মন্দিরের ধারণা এবং অস্তিত্ব বর্তমান ছিল।
বাংলার সুত্রধরগণ এই রীতি সম্পর্কে অবহিত হতে পেরেছিলেন নিশ্চয়ই। কেননা, শুঙ্গ সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল পশ্চিমে উজ্জ্বয়িনী থেকে পূর্বে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। যাকগে, এসব পুরাবিদ পণ্ডিতগণের গবেষণা ও চর্চার বিষয়। আমার মত মেঠো-সমীক্ষকের এক্তিয়ারের বাইরে।

 


বহু কালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। সেখানে দক্ষিণ বাজার এলাকায় এই জোড় বাংলা রীতির একটি মন্দির দেখা যায়। মন্দিরটি কার হাতে নির্মিত, তাই নিয়েও ভিন্ন মতের শেষ নাই। বিশদে না গিয়ে, ৩টি মতের উল্লেখ করা যায়– ১. ধর্মপ্রাণ কেউ কেউ বলেন, স্বয়ং বিশ্বকর্মা এটির স্রষ্টা। কেননা, দেবশিল্পী ছাড়া এমন অনুপম সৃষ্টি আর কার হতে পারে? ২. কেউ বলেন, আদতে এটি ছিল বৌদ্ধ মন্দির। মন্দিরের পিছনের দেওয়ালের মিথুন-মূর্তিগুলি বৌদ্ধ-ধর্মসংস্কৃতির সাথেই সাজুয্যপূর্ণ। ৩. ইতিহাসের মানুষজন বলেন– এটি মল্ল রাজবংশের কীর্তি। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে আদি মল্ল বা খয়ের মল্ল তাঁর শাসনকালে যখন চন্দ্রকোণায় রঘুনাথ মন্দির, মল্লেশ্বর শিবমন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করেন, তখন এই জোড় বাংলা মন্দিরটিও নির্মাণ করেছিলেন। পরে, ১৫৬৭- ৬৮ সালে, কালাপাহাড়ের হাতে এটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ৪. কেউ আবার অনুমান করেন, ১৭৩২ সালে বর্ধমান রাজা কীর্তি চন্দ্র তাঁর চন্দ্রকোণা আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলি নতুন করে নির্মাণের সময়, এই মন্দিরটিও নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।

 


লোকশ্রুতি থেকে জানা যায়, মন্দিরটি রামচন্দ্রের। রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, হনুমানের বিগ্রহ ছিল মন্দিরে। মন্দিরটি ভয়ানক জীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত হলে, চন্দ্রকোণা থেকে অনেক দূরে, কেঠে নদী পার হয়ে, নির্ভয়পুর গ্রামের রামানুজ সম্প্রদায়ের অস্থল বা ঠাকুরবাড়িতে বিগ্রহগুলি নিয়ে রাখা হয়েছে।
সুখের কথা, কয়েক বছর পূর্বে, ২০০৭ সালে, রাজ্য সরকারের তৎপরতায় মন্দিরটির পূর্ণ সংস্কার করে, নবজীবন দান করা হয়েছিল। সেসময়, পাথরে খোদাই করা দুটি যুগল পদচিহ্ন পাওয়া যায় মাটির তলা থেকে। সেগুলি রামচন্দ্র এবং সীতাদেবীর– এই বিবেচনায় মন্দিরে স্থাপন করে পূজার্চনা করা হয়। ৪৫ বছর ধরে পূজা করছেন যে পুরোহিত , তিনি কমল কৃষ্ণ চক্রবর্তী। একটি বিষ্ণুশীলাও প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
চক্রবর্তী বংশকে কেউ পুরোহিত নিযুক্ত করেননি। নিজেদের সময়, শ্রম আরার অর্থ ব্যয় করে, পূজার কাজটি করে চলেছে পরিবারটি। যাতে মন্দিরটি অনাদরে অবহেলায় আবার বিনষ্ট না হয়ে যায়।

কিন্তু পাঁচজনে না চাইলে, একের কী সাধ্য দেবালয়কে বাঁচাবার? অনাদর অবহেলা তো আছেই, তার সাথে এখন শুরু হয়েছে অত্যাচার। দেবালয় হয়ে উঠেছে গুদামঘর। জ্বালানিকাঠ রাখা, দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়া, কাঁথা-কানি জড়ো করে রাখা এসব কাজ করছে লাগোয়া বাসিন্দারা। বাধা দেওয়ার, বুঝিয়ে বলবার তাগিদ কার আছে? প্রশাসনও উদাসীন।
সওয়া ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য আর প্রায় ৮ফুট প্রস্থের দুটি আয়তাকার দো-চালা মন্দিরকে পিঠোপিঠি জুড়ে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। পরিমাপ দাঁড়িয়েছে সওয়া ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য, পৌণে ১৬ ফুট প্রস্থ আর উচ্চতা ২০ ফুট। সামনের অংশটি মুখশালা বা জগমোহন আর পিছনেরটি গর্ভগৃহ। সামান্য উঁচু পাদপীঠের উপর একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে।
জগমোহনকে দুটি অংশে ভাগ করা। প্রথমে একটি অলিন্দ রচনা করা হয়েছে।

 

পরের অংশে দু’পাশে দুটি ছোট চাপা-কুঠুরি গড়ে, মাঝখানে সংকীর্ণ পরিসর বেয়ে গর্ভগৃহে পৌঁছানো যায়। জগমোহনে প্রবেশের তিনটি দ্বারপথ। ইমারতি থাম আর দরুণ খিলান দিয়ে গড়া। গর্ভগৃহের দ্বারপথ একটিই। জগমোহনের সিলিং টানা-খিলান আর গর্ভগৃহের সিলিং লহরা বা করবেলিং রীতিতে নির্মিত।
দুটি চালার উপরের ছাউনি হস্তীপৃষ্ঠের মত বর্তুলাকার। সেগুলির উপর তিনটি করে শীর্ষক রচিত। প্রথমে বেদী, তারপর ক্রমান্বয়ে বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস এবং দন্ড। এছাড়া, সামনের কার্নিশের ওপরেও অনুরূপ তিনটি শীর্ষক রচিত হয়েছে। এটি একটু বিরল দৃষ্টান্ত। সচরাচর দেখা যায় না।
মাকড়া পাথরের দক্ষিণমুখী মন্দির। টেরাকোটা ফলক নাই। অলংকরণ বলতে বা-রিলিফ রীতির কিছু স্টাকোর কাজ আছে। কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা, দুই সাথী সহ ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ মূর্তি ইত্যাদি। পিছনের দেওয়ালে তিনটি মিথুন ফলক।
এরকমই সামান্য কিছু। কিন্তু সর্বোপরি মন্দিরটি ভারী সৌন্দর্য্যমন্ডিত। নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া শ্বেত শুভ্র মরালের মত সুন্দর এই মন্দির। কিন্তু সমঝদার নাই, রক্ষক নাই, যা আছে তা কেবল নির্বোধ মানুষের অত্যাচার। যা আবার তার জরা আর ব্যাধিকেই ডেকে আনছে।

ছবিগুলি থেকেই সৌধটির দুরবস্থা উপলব্ধি হবে সকলের।
যাওয়া-আসা : জেলা শহর মেদিনীপুর, পাঁশকুড়া স্টেশন কিংবা চন্দ্রকোণা রোড স্টেশন থেকে চন্দ্রকোণা শহরে আসা যাবে। সেখানে গাছশীতলা মোড় থেকে সামান্য দক্ষিণে, দক্ষিণ বাজারের খিড়কি বাজারে মন্দিরটি অবস্থিত। চন্দ্রকোণা হোল মন্দির-নগরী। জোড়-বাংলার সাথে, আরও অনেকগুলি বিখ্যাত মন্দির দেখে নেওয়া যাবে একই দিনে।
সমীক্ষা-সঙ্গী : সর্বশ্রী গণেশ দাস– চন্দ্রকোণা। পার্থ দে– পাঁশকুড়া। শোভন মাইতি– কলকাতা।

RELATED ARTICLES

Most Popular