Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৪৯

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৪৯

শীতলা মন্দির, আজুড়িয়া (দাসপুর)
চিন্ময় দাশ


আজকের জার্ণালের শিরোনামে ভুল থেকে গেল একটি। ” জীর্ণ ” নয়, ” বিলুপ্ত মন্দিরের জার্নাল ” লেখাই সঙ্গত হোত। কেননা, আমরা মন্দিরটি সমীক্ষা করেছিলাম ঠিক এক বছর আগে, ২০১৯ সালের ১৩ই মার্চ। তখনই মন্দিরটি ছিল– বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত এবং অর্ধ-ভগ্ন। কিন্তু আজকের প্রতিবেদন যখন পাঠক-পাঠিকা পড়বেন, তখন মন্দিরটির কোনও অস্তিত্বই নাই আর। এক প্রবল বর্ষার রাতে, ঝোড়ো বাতাসের দাপটে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে গিয়েছে মন্দিরের কঙ্কালটি। আমাদের সমীক্ষার দিন কয়েকের মধ্যে, সেই মার্চেই। সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে সৌধটি, কোনও চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। আমাদের কাছে এমন ঘটনা এই প্রথম।
নদী-নালার দেশ মেদিনীপুর জেলার দাসপুর। বন্যার আক্রমণ সে এলাকায় ফি-বছরের ঘটনা। সেখানে আজুড়িয়া গ্রামে এই ভাঙা শীতলামন্দিরটি দেখতেই পৌঁছেছিলাম আমরা। মন্দিরের পাদপীঠ বা ভিত্তিবেদীটি দেখতে পাইনি। ২০০ বছর বয়সের ভার ছিলই মন্দিরের দেহে। তার উপর বারংবার বন্যার আঘাত সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছিল বেদীটিকে। মন্দিরের উপরে উঠবার সিঁড়ি ছিল একটি। তার নিচের মুখের অংশটিও চলে গিয়েছিল মাটির তলায়।

পৌনে ১৭ ফুট দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের বর্গাকার মন্দির। উচ্চতা ৪৫ ফুট। চুন, সুরকি আর ২ ইঞ্চি পুরু ইটের উপাদানে গড়া পূর্বমুখী মন্দির। অনেকগুলি বৈশিষ্ট ছিল সৌধটির। কয়েকটির কথা জানানো যেতে পারে– ১. শিখর-রীতির মন্দির, এর বাইরের চার দিকের দেওয়ালে কলিঙ্গ-ধারায় সপ্ত-রথ বিন্যাস করা। কিন্তু সামনে জগমোহন না গড়ে, আবৃত (ঢাকা) অলিন্দ গড়া হয়েছিল। যা সাধারণত চালা বা রত্ন-মন্দিরের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ২. ‘রথপগ’গুলি (মাঝখানে একটি ‘রাহাপাগ’, তার দু’দিকে দুটি করে অনর্থপগ, আর দুই কোণে দুটি কণকপগ) অত্যন্ত প্রশস্ত, যা সচরাচর দেখা যায় না। ৩. অলিন্দটির বহিরঙ্গ চার-কোণা, আয়তাকার। কিন্তু এর ভিতরের গড়ন লক্ষ্য করবার মত। ভিতরের অংশটি ছয়-কোণা বা hexagonal। ৪. গর্ভগৃহের বাইরের অংশও চার-কোণা। কিন্তু ভিতরে আট-কোণা বা octagonal করে গড়া হয়েছিল। দেখলেই যেটিকে প্রায় গোলাকার বলে মনে হয়।

অলিন্দের মাথায় সিলিং ছিল টানা-খিলানের। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছিল অনেক উঁচুতে। বড় আকারের চারটি খিলানের মাথায় গম্বুজ নির্মাণ করে। মন্দিরের অলংকরণের প্রসঙ্গে আমাদের ৩টি সূত্রের উপর নির্ভর করতে হয়েছে– ১. সরেজমিনে নিজেদের প্রত্যক্ষ সমীক্ষা, ২. পূর্ববর্তী পুরাবিদগণের (প্রয়াত তারাপদ সাঁতরা, অধ্যাপক প্রণব রায়) মুদ্রিত বিবরণ এবং ৩. সাক্ষাৎকারের সময় সেবাইত পরিবারের দেওয়া বিবরণ।
অলঙ্করণের কাজ হয়েছিল দুটি রীতিতে– টেরাকোটা ফলক এবং পঙ্খের প্রলেপে। টেরাকোটা ফলকগুলি যুক্ত করা হয়েছিল বরন্ডীর উপরের অংশে। ফলকগুলির মোটিফ ছিল মা যশোদার দধিমন্থন, বকাসুর বধ, বিষ্ণুর দশাবতারের কয়েকটি অবতার, রাধা-কৃষ্ণ, জগন্নাথ দেবের একটি একক মূর্তি ইত্যাদি। বিশিষ্ট একটি ফলকের কথা প্রণব রায় উল্লেখ করেছেন। একটি মিথুন ফলক দেখেছিলেন এবং ফটোও নিয়েছিলেন তিনি। ফলকটি ‘সমকামী মৈথুন’-এর, যা সচরাচর দেখা যায় না।

পঙ্খের কাজ করা হয়েছিল সামনের দেওয়াল এবং গর্ভগৃহের পিছনের দেওয়ালে, বেদীর উপরের অংশে। সবই জ্যামিতিক প্যাটার্ন আর ফুলকারি নকশা। এই কাজগুলিতে কালো রঙের ব্যবহার করা হয়েছিল।
মন্দিরের কথা সাতকাহন করে বলা হোল। কিন্তু কে তৈরী করেছিলেন, কিংবা পরিচয়ই বা কী ছিল তাঁর, বলা হয়নি। সেকথাটি এবার বলে নেওয়া যাক।
স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন তেমন প্রচলিত হয়নি, জলপথই ছিল মুখ্য উপায়। অনেকগুলি নদী-নালার জলপথের সুবাদে মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ ঝরে পড়ত দাসপুরের উপর। শিলাবতী এবং কংসাবতীর একটি শাখা, গিয়েছে এই থানার উপর দিয়ে। এই দুই নদীর বুক বেয়ে রুপনারায়নে পড়া যেত। তারপর সেখান থেকে দূর-দূরান্তর পর্যন্ত সহজেই যাওয়া-আসা।
কংসাবতীর শাখাটির নাম– পলাশপাই খাল। তারই কোলে আজুড়িয়া গ্রাম। থানার অন্যান্য গ্রামের মত, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে অনেকগুলি ধনী পরিবারের বাস ছিল। এই গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় মাহিষ্য জাতিভুক্ত ‘মানা’ পদবীর একটি পরিবারের ছিল কাঠের ব্যবসা। মেদিনীপুর জেলারই পশ্চিম এলাকার জঙ্গল ইজারায় ডেকে নিতেন তাঁরা। সেই কাঠ কলকাতা বা দূর-দূর এলাকায় রপ্তানি করে, প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছিল পরিবারটি।

একবার সেই বংশের জনৈক হীরালাল মানা কাঠবোঝাই নৌকা নিয়ে চলেছেন। ভাঁটির টান তখন। কোলাঘাটের কাছাকাছি এলাকায় নদীর চড়ায় হীরালাল একটি পাথরের মূর্তি কুড়িয়ে পান। হেমঘট সহ মা মনসার মূর্তি। গ্রামে ফিরে, বড়-সড় আকারের একটি মন্দির গড়ে, সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। চক্রবর্তী পদবীর একটি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের হাতে দেবতার সেবাপূজা আর মন্দিরের সমূহ ভার তুলে দিয়েছিলেন চিরকালের মত। ১৭৪৮ শকাব্দ বা ইং ১৮২৬ সালের ঘটনা ছিল এটি। অর্থাৎ প্রায় দু’শ বছর আয়ু হয়েছিল এই মন্দিরের।
হীরালাল গত হয়েছেন অনেক কাল হোল। তাঁর কোনও বংশধারা নাই। বিগত এক বছর যাবৎ নাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটিও। পাশেই অন্য একটি মন্দিরে দেবীর বিগ্রহ স্থাপন করে, চক্রবর্তীরাই সেবাপূজাটি চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাক্ষাৎকার : শ্রী শশাঙ্ক শেখর চক্রবর্তী, শ্রী গৌতম চক্রবর্তী, শ্রীমতী কৃষ্ণা চক্রবর্তী, শ্রীমতী মণিমালা চক্রবর্তী– আজুড়িয়া।
যাওয়া-আসা : দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে ঘাটালগামী রাস্তায় গৌরা। সেখান থেকে পলাশপাই খালের উত্তর পাড় ধরে আজুড়িয়া। সেখানে খাল পার হয়ে, সামান্য দক্ষিণে চক্রবর্তীদের বাড়ি এবং মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ। (আজুড়িয়া পর্যন্ত সবরকম গাড়ি যেতে পারবে।)

RELATED ARTICLES

Most Popular