Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জানাল-- ৫৮

জীর্ণ মন্দিরের জানাল– ৫৮

জীর্ণ মন্দিরের জানাল – ৫৮
জানকীনাথ মন্দির, নন্দীগ্রাম (নন্দীগ্রাম– ১ / মেদিনীপুর )
চিন্ময় দাশ

রানির হাতে মন্দির পত্তনের কথা উঠলে, মেদিনীপুর জেলায় ২ রানীর নাম উল্লেখ করে থাকেন ঐতিহাসিকেরা। পূর্বে মহিষাদলের রানি জানকী দেবী, আর পশ্চিমে শিলদার রানি কিশোরমণি। রাজ্য পরিচালনায় কিশোরমণি এতটাই দক্ষ ছিলেন, তাঁকে “রাজা” নামে উল্লেখ করা হোত। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ।
মহিষাদলে উপাধ্যায় রাজবংশের পত্তন হয় ষোড়শ শতাব্দীর কোনও এক সময়ে। জনৈক জনার্দন উপাধ্যায় এখানে এসেছিলেন বাণিজ্যের সূত্রে। তিনি ছিলেন উত্তর প্রদেশের সামবেদীয় ব্রাহ্মণ। তিনিই এখানে জমিদারী পত্তন করেছিলেন। জনার্দনের পর, দুর্যোধন, রামশরণ, রাজারাম ও শুকলাল জমিদার হয়েছিলেন। বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর নির্দেশে জলামুঠা, সুজামুঠা, মাজনামুঠা এবং তমলুক জমিদারীর রাজস্ব আদায়ের ভার পেয়েছিলেন শুকলাল। ১৭৩৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। শুকলালের মৃত্যুতে রাজা হন তাঁর পুত্র আনন্দলাল।
সেকালের ভূমিব্যবস্থায় নন্দীগ্রাম থানার সিংহভাগ এলাকা ছিল গুমগড় পরগণার অন্তর্ভুক্ত। জলামুঠা, সুজামুঠা ইত্যাদি পরগণার ভিতরে ছিল বাকি কিছু এলাকা। তো, একবার গুমগড় পরগনার জমিদার দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরীকে মহিষাদলের রাজা শুকলাল উপাধ্যায়ের কাছ থেকে কিছু ঋণ নিতে হয়েছিল। কিন্তু কিছুকাল তিনি তা পরিশোধ করতে পারেননি। আনন্দলাল রাজা হয়ে, দেনার দায়ে দুর্গাপ্রসাদের পুরো জমিদারিটাই কেড়ে নিয়েছিলেন।


দীর্ঘ ৩২ বছর রাজত্বের পর, ১৭৭০ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় আনন্দলালের মৃত্যু হয়। তখন তাঁর পত্নী, রানি জানকী দেবী, রাজ্য পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। জানকী দেবী রাজ্য পরিচালনা করেছেন ৩৪ বছর। ১৮০৪ সালে এই ধর্মপ্রাণা সুশাসক রমণীর মৃত্যু হয়।
৩৪ বছর সময়কালে বেশ কয়েকটি দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জানকী দেবী। তার অন্যতম একটি হোল আজকের আলোচ্য জানকীনাথ মন্দির। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে, ১৮০৩ সালে, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।
রামচন্দ, সীতাদেবী, লক্ষণজী এবং হনুমান– ৪টি বিগ্রহ মন্দিরে পূজিত হন। উচ্চতা এবং ওজনের বিবরণ দিলে, বিগ্রহ ৪টির আয়তন বুঝতে সুবিধা হবে পাঠক-পাঠিকার। বিগ্রহগুলি অষ্টধাতুতে নির্মিত। হনুমান– ২৩ ইঞ্চি, ৫০ সের। লক্ষণজী– ২৫ ইঞ্চি, ৬০ সের। সীতাদেবী– ২৫ ইঞ্চি, ৫০ সের। এবং রামচন্দ্র– ২৮ ইঞ্চি, ৭৫ সের। হ্যাঁ, হিসাব একেবারেই এমনটি।
মূর্তি ৪টি নির্মাণ সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটি লোকশ্রুতি আছে এখানে। ‘রাণা’ পদবীর এক কারিগর মূর্তি নির্মাণের ভার পেয়েছিলেন। তাঁকে সপরিবারে আনা হয়েছিল ওডিশা থেকে। অন্য মূর্তিগুলি নির্মিত হলেও, তিন-তিনবার নির্মাণের পরেও, সীতাদেবীর মূর্তিটি কিছুতেই নিখুঁত হচ্ছিল না। তখন বিচলিত কর্মকার শুদ্ধান্তঃকরণে প্রায়োপবেশনে আত্মোৎসর্গ ব্রতে বসেন। সেদিনই রাত্রিতে একটি স্বপ্নাদেশ পান তিনি। সেইমত, নিজের কন্যাকে দেবতার নামে উৎসর্গ করে, মূর্তি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। মূর্তিটিও নিখুঁত ভাবে গড়া হয়। কিন্তু সেদিনই তাঁর একমাত্র কন্যাটির মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।

মূর্তিগুলি ছাড়া, ৪টি শালগ্রাম শিলাও মন্দিরে পূজিত হয়ে থাকে। বংশানুক্রমে মন্দিরে পৌরহিত্য করেন জনৈক নিশিকান্ত পাঠক। বিগত ৪৮ বছর যুক্ত আছেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা নগরী থেকে। দুপুরে অন্নভোগ সহ নিত্য ৩ বার পূজার বিধান। তবে, মন্দিরের পূজা ছাড়া, ভক্তদের পূজাও লেগেই থাকে মন্দিরে।
বছরে দুটি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বেশ আড়ম্বরের সাথে। ১. রামনবমী– ভক্তদের আনা হাজার হাজার কলসি জলে বিগ্রহের স্নান হয় সেদিন। সারা রাতব্যাপী পূজার পর, প্রসাদ বিতরণ এবং রামায়ন পাঠের আসর বসে। ২. দ্বিতীয় উৎসবটি হোল– পঞ্চম দোল। সেই উপলক্ষে চাঁচর আর রঙের খেলায় মেতে ওঠে সারা বাজার এলাকা।

বেশ কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জানকী দেবী। তার ভিতর ৩টি মন্দির আকারে প্রকারে বেশ বড়। একেবারে রাজকীয় গড়ন বলা যায় সেগুলির। ১. মহিষাদলে রাজবাড়ীর প্রাঙ্গণের ভিতরে গোপালজীউ মন্দির। সাড়ে ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের এই মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৭০ ফুট। ২. মহিষাদলের অদূরে রামবাগ গ্রামে রামজীউ মন্দির। দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪১ ফুট, প্রস্থ ৩৭ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট। ৩. অবশিষ্ট মন্দিরটি আমাদের বর্তমান জার্নালের আলোচ্য জানকীনাথ মন্দির। জানকীনাথ মন্দিরটি ইটের তৈরী, পূর্বমুখী।

প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ যুক্ত, ফুট তিনেক উঁচু পাদপীঠের উপর প্রতিষ্ঠিত। ৪৫ ফুট উঁচু এই মন্দিরের গড়ন সম্পূর্ণ বর্গাকার– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সাড়ে ২৪ ফুট। রামবাগের মতো, এটিও আট-চালা রীতিতে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতলের চারচালাটি কিছু সংক্ষিপ্ত আকারের। সেকারণে, প্রথম তলটি আড়ে-বহরে বেশ পুষ্ট। দৃষ্টিপাতেই মনে সমীহ জাগে।
একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক ছিল পূর্বকালে। সংস্কার কাজের সময় যেটি রক্ষা করা হয়নি। তবে, পূর্ববর্তী গবেষকগণের বিবরণ থেকে সেটির বয়ান আমরা সংগ্রহ করেছি– ” সকে ১২১০ সাল/ শকে পঞ্চযুগ্মর্ষি চন্দ্রেসিতাহে/ ক্রিয়ে পঞ্চবিংশে মঠমপৌর্ণমাস্যাং/ নৃপানন্দলালস্যপত্নী তু রাজ্ঞী/ দদৌ জানকী জানকীনাথ কায়া/ ২৫ বৈশাখস্য “। সন তারিখের হিসাবে, বাংলা ১২১০ সাল, ১৭২৫ শকাব্দ বা ইং ১৮০৩ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রথমে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারযুক্ত একটি অলিন্দ।

তার পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দের সিলিং গড়া হয়েছে টানা-খিলান করে। দু’দিকে দুটি বড় খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে গড়া হয়েছে গর্ভগৃহের সিলিং। গর্ভগৃহটি বেশ প্রশস্ত। তবে, তার গড়ন একটু বিশিষ্ট রীতির। গর্ভগৃহের লাগোয়া পূর্বদিকে একটি ছোট কুঠুরি দেখা যায়। যার পরিমাপ– ১০ ফুট বাই ৪ ফুট। এই কক্ষের ভিতর থেকেই উপরে উঠবার একটি সিঁড়ি রচিত আছে।
সেই সিঁড়িটিও ভারী বিরল রীতির। তার সোপান শ্রেণীর ভাঁজে ভাঁজে মোট ৯টি ছোট প্রকোষ্ঠ নির্মিত হয়েছে। যা বাইরে থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এগুলি ছাড়াও, বায়ু চলাচলের জন্য কয়েকটি গবাক্ষও রচিত আছে সেখানে।

আরও একটি নিদর্শন আছে বিশিষ্ট রীতির কাজের। দ্বিতলের মাথায়, মন্দিরের শীর্ষক অংশে, একটি টানা বেদীর উপর ৩টি চূড়া স্থাপিত আছে। আমলক, একাধিক কলস, চক্র স্থাপিত আছে সবগুলির মাথায়।
কোনও অলংকরণ ছিল না মন্দিরে। ছবিতে যা দেখা যাবে, সেগুলি সংস্কার কাজের সময়ের সংযোজন। জানকী দেবী ৩টি মন্দিরই গড়েছিলেন উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে। দাক্ষিণাত্য এলাকার দুর্গ-মন্দির (ফোর্ট টেম্পল)-এর আদলে। নন্দীগ্রামের এই মন্দিরের সেই প্রাচীরে পরবর্তীকালে সুসজ্জিত একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।


সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অধ্যাপক দিলীপ কুমার মান্না– দেবীপুর। প্রদীপ সিংহতাল, নিশিকান্ত পাঠক (পুরোহিত)– নন্দীগ্রাম।
সহযোগিতা : শ্রী তপন কুমার রায়, কুমারী তানিয়া রায়– নন্দ নায়েক বাড়, টেঙ্গুয়া, নন্দীগ্রাম।
পথ-নির্দেশ : হাওড়া – দীঘা বাসরাস্তায়, মেচেদা হয়ে, মঠ চন্ডীপুর। সেখান থেকে পাকা রাস্তা গিয়েছে ২৩ কিমি দূরের নন্দীগ্রাম পর্যন্ত। হলদিয়া শহর থেকে লঞ্চে নদী পার হয়েও নন্দীগ্রাম আসা যাবে। বাজারেই মন্দিরটি অবস্থিত।

RELATED ARTICLES

Most Popular