Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৫৯

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৫৯

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৫৯
শীতলা মন্দির, সুজাগঞ্জ (মেদিনীপুর শহর )
চিন্ময় দাশ

একেবারে সরল বাংলা গদ্যে লেখা প্রতিষ্ঠা-লিপি। সামনের দেওয়ালেই সেটি লাগানো। তা থেকে জানা যায়, বাংলা ১৩২৬ সনে এক জমিদারবাবু মেদিনীপুর শহরে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ ঠিক একশ’ বছর আয়ু পূর্ণ হল সৌধটির। এই লগ্নেই আমরা ইতিহাস টুকে রাখছি শতায়ু মন্দিরটির।
প্রথমে ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। মীর জাফরকে বরখাস্ত করে, ইংরেজের বদান্যতায় মীর কাশিম বাংলার নবাবী পেয়েছিলেন। তার বদলে, চাকলা বর্ধমান, চাকলা মেদিনীপুর আর চাকলা চট্টগ্রামের একাংশ তুলে দিতে হয়েছিল ইংরেজদের হাতে। তখন ইং ১৭৬০ সাল। ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার আর ওডিশা তিনটি সুবা (প্রদেশ)-এরই অধিকার ইংরেজদের হাতে চলে যায়। সরকারি নথি থেকে জানা যায়, ১৭৭৪ থেকে ১৭৭৭ পর্যন্ত মেদিনীপুর জেলা বর্ধমান প্রাদেশিক কাউন্সিলের হাতে ছিল। ১৭৭৭ সালে জেলার জন্য মি. জন পিয়ার্সকে প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত করা হয়। ১৭৮৩ সালে জেলার সদর শহর হিসাবে ঘোষণা করা হয় মেদিনীপুরকে।
এই সময় থেকেই মেদিনীপুর নগরীর সমৃদ্ধির শুরু। ইংরেজের হাতে নতুন করে শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশে আলোকিত হয়ে উঠতে শুরু করে এই শহর। সেই আলোয় আলোকিত হওয়ার আকাঙ্খায় উন্মুখ হয়ে ওঠেন রাজা আর জমিদার আর বনেদি বংশগুলি। পূর্বকালে থেকে কয়েকজন জমিদারের বসবাস ছিল শহরে। তাঁদের সাথে গ্রাম এলাকার বেশ কয়েকজন জমিদারও এসে জেলা শহরে বসতবাড়ি গড়ে তোলেন। ঝাড়গ্রাম, জাড়া, মলিঘাটি, জকপুর, কোতাইগড়, খণ্ডরূইগড় প্রভৃতি জমিদারগণ তার উদাহরণ।
এই তালিকার আর একটি উজ্বল নাম মুগবেড়িয়া। নন্দ পদবীর জমিদাররা এসে, শহরের দক্ষিণ অংশে সুজাগঞ্জ পল্লীতে (বর্তমান রামকৃষ্ণ মিশনের একেবারে লাগোয়া) নিজেদের বসতবাড়ি গড়ে তুলেছিলেন।
নন্দবংশের ইতিহাসটিও দেখে নেওয়া যেতে পারে এই অবকাশে। মেদিনীপুর জেলায় এই বংশের আদি পুরুষ অপ্রতিম ( মতান্তরে– অপর্ত্তি চরণ) নন্দের নিবাস ছিল ওডিশার পুরী জেলায়। সেসময় মেদিনীপুরের মাজনামুঠার জমিদার ছিলেন যাদবরাম রায় (১৭০০ – ১৭৮০)। দেব-দ্বিজে প্রগাঢ় ভক্তিসম্পন্ন এই রাজা দক্ষিণের কিছু বৈদিক ব্রাহ্মণকে আনিয়ে নিজের জমিদারিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অপর্ত্তি চরণ এসেছিলেন পুরী জেলার সাক্ষীগোপালের নিকটবর্তী বীররামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে। সময় ছিল আনু. ১৭৪০ সাল।
নন্দবংশের ৫ম পুরুষ, অপর্ত্তি চরণের প্রপৌত্র খগেশ্বর নন্দের পুত্র, ছিলেন ভোলানাথ নন্দ (১৮১৯ -১৮৭৯)। নিজের সাহস এবং বুদ্ধিমত্তায় তিনিই প্রথম একটি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজধানি– মুগবেড়িয়া। জানা যায়, দেবী মুগেশ্বরীর নাম থেকে একটি এলাকার মুগবেড়িয়া নাম হয়েছিল। সমাজকল্যাণ, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার এবং বিশেষত দেশাত্মবোধ প্রসারে, মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণাংশে এই জমিদারবংশের ভূমিকা আজও উজ্বল।
ভোলানাথের ৩ পুত্র– গোবিন্দ, দিগম্বর এবং গঙ্গাধর। এঁদের উদ্যোগে মেদিনীপুর ছাড়াও, দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং ওডিশাতে জমিদারি মহাল প্রসারিত হয়েছিল। এঁরাই মেদিনীপুর শহরে বসবাসের জন্য একটি প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন। গোবিন্দের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্যামাচরণ, নিজেদের প্রাসাদের লাগোয়া করে, ২টি দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেন। একটি মহাদেব শিবের মন্দির। অন্যটি লোকদেবী শীতলার মন্দির। এই মন্দিরটি নিয়েই আমাদের আজকের প্রতিবেদন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯১৯ সালে শ্যামাচরণ সুজাগঞ্জ মহল্লায় এই শীতলা মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তার অর্ধ শতাব্দীরও বেশি আগে, ১৮৫১ সালে, কাছেই মেদিনীপুর শহরের বিখ্যাত বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। স্থাপত্যরীতিতে সেই মন্দিরের সাথে এই শীতলা মন্দিরের অজস্র সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায়।
ফুট তিনেক উঁচু ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ইটের তৈরী শীতলা মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। কলিঙ্গশৈলীর শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত এই সৌধের মাত্র দুটি অংশ– সামনে ৫ ফুট প্রস্থের আয়তাকার জগমোহন, পিছনে আনু. ৪০ ফুট উঁচু বিমান বা মূল মন্দির। জগমোহন অংশটি পৃথক সৌধ নয়, বিমানের সাথে লেপ্টে আছে। চার দিকে খিলান-রীতির চারটি দ্বারপথ। উত্তরের দ্বারটি গর্ভগৃহের সাথে যুক্ত।

 

জগমোহনের গড়ন– দালানের মাথায় ছাউনি দেওয়া অংশটি চালা-রীতির। তবে, ছাউনির নিচের প্রান্ত বাঁকানো নয়, ভূমির সমান্তরালে সরলরৈখিক। ছাউনি অংশটি আবার কলিঙ্গ শৈলীতে ‘ পীঢ় বিভাজন ‘ করা। ২২টি সরু থাক কেটে ছাউনিটি বিভাজন করা হয়েছে।
বিমানের গড়ন– বাঢ় এবং গন্ডী দুই অংশ জুড়ে ‘ রথ বিভাজন ‘ করা। এখানে ‘ নব-রথ বিন্যাস ‘ দেখা যায়। পূর্ব এবং উত্তরের দেওয়ালে নিচের বাঢ় অংশে একটি করে ‘প্রতিকৃতি দ্বার ‘ এবং গন্ডী অংশে একটি করে ‘প্রতিকৃতি গবাক্ষ ‘ রচিত হয়েছে।
দুটি সৌধেরই শীর্ষক অংশ ভারী সুদর্শন। রীতি অনুযায়ী বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, নিশানদন্ড এবং চক্র শোভিত।


জগমোহনের সামনের কার্নিশের দুই প্রান্তে পরস্পর অভিমুখী, হস্তীপৃষ্ঠে উপবিষ্ট, ব্যাদিত বদন দুটি সিংহমূর্তি রচিত হয়েছে। এছাড়া, অলংকরণ হিসাবে সামান্য কিছু টেরাকোটা ফলক যুক্ত আছে কেবলমাত্র এই জগমোহন অংশেই। মোটিফ হিসাবে– ব্রহ্মা, গণেশ, লক্ষ্মী, মন্দির-দর্শক, মৃদঙ্গবাদক, পঙ্খধারিনী ইত্যাদি ফলক দেখা যায়। কার্নিশের নিচে সমান্তরাল একটি সারি, এবং দুদিকের কোনাচের গায়ের দুটি খাড়া সারিতে ফলকগুলি বিন্যস্ত হয়েছে।
নিবন্ধের সূচনাতেই একটি প্রতিষ্ঠা-লিপির কথা আমরা বলেছি। সেটি আছে জগমোহনের সামনের দ্বারপথের মাথাতেই। তার বয়ানটি এই– ” মুগবেড়িয়ার ধর্ম্ম প্রাণ জমিদার শ্রীযুক্ত শ্যামাচরণ নন্দ মহাশয়ের অর্থে সুপ্রসিদ্ধ উকিল শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র নাথ মাইতি মহাশয়ের যত্নে নির্ম্মিত সেবাএত সুজাগঞ্জ বাসীগণের পক্ষে শ্রীপ্রতাপ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৩২৬ সাল। “
নিবন্ধ শেষ করবার পূর্বে ২টি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে– ১. লিপিতে উল্লিখিত সুপ্রসিদ্ধ উকিল শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র নাথ মাইতি ছিলেন সেসময়ের মেদিনীপুর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান (১৯১২ – ১৯২৪)। তাঁর সময়কালেই, নাড়াজোল রাজার অর্থে, মেদিনীপুর শহরের প্রথম পানীয় জলের জলাধারটি নির্মিত হয়। শেখপুরা মৌজায় ইটের তৈরী সেই জলাধারটিও শহরের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ সৌধ হিসাবে আজও বিরাজমান। জলাধারের ফলকেও উপেন্দ্রনাথের নাম লিপিবদ্ধ আছে।
২. মন্দির প্রতিষ্ঠার পর, শ্যামাচরণ দেবীর সেবাপূজা এবং মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেবাইত হিসাবে সুজাগঞ্জের অধিবাসীগণের হাতে দায়ভার অর্পণ করে গিয়েছিলেন। সেই দায় তাঁরা আজও বহন করে চলেছেন। দেবীর সেবাপূজা বহাল রাখা ছাড়াও, বিগত বাংলা ১৪০৯ সন কিংবা ইং ২০০২ সালে ‘ সুজাগঞ্জ দেশ কমিটি ‘ মন্দিরের সংস্কার করিয়েছিলেন। তবে, পুণরায় মন্দিরে জীর্ণতার ছাপ পড়া শুরু হয়েছে।


পথ-নির্দেশ : বাস কিংবা ট্রেন যোগে মেদিনীপুর শহর। শহরের জগন্নাথ মন্দির এবং রামকৃষ্ণ মিশনের মাঝখানে, পাকা রাস্তার উপরেই, মন্দিরটি অবস্থিত। ভৌগোলিক অবস্থান– latitude 22.40695, longitude 87.32866

RELATED ARTICLES

Most Popular