Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল - ৬৫

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৬৫

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৬৫
ব্রজনাগর মন্দির, হাঁদলাগড় (নারায়ণগড় থানা, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ

নারায়ণগড় রাজবংশ। আদি পুরুষ বা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গন্ধর্ব পাল। শেষ রাজা ছিলেন পৃথ্বীবল্লভ। দুই রাজার কালপর্বের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ছ’শ বছরের। ইং ১২৬৪ সাল থেকে ১৮৮৩।
গন্ধর্ব পালের কুলজী নিয়ে নানা মত। কেউ বলেন, তিনি ছিলেন বর্ধমানের কোনও এক অমরাবতী গড়ের দিকনগর গ্রামের অধিবাসী। অন্যরা বলেন, বর্ধমান নয়, মেদিনীপুর জেলার টানিয়া (বর্তমান দাঁতন) দন্ডপাট-এর অমরাবতীপুর এলাকার অধিবাসী ছিলেন গন্ধর্ব। অমরাবতীর রাজা ধর্মপালের বংশের কোনও রাজপুরুষ তিনি। নারায়ণপুর নামক স্থানে তাঁর নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।


আরও অতীতে অমরাবতীপুরে (বর্তমান নাম– মোগলমারী) রাজত্ব করতেন বিক্রমকেশরী নামের কোনও এক রাজা। মোগলমারী গ্রামে বহুকাল যাবৎ একটি উঁচু ঢিবি ‘শশীসেনার গড়’ বা শশীসেনার পাঠশালা’ নাম পরিচিত। বিক্রমকেশরীর কন্যা শশীসেনা বা সখীসেনা এবং জামাতা অহিমাণিক-এর প্রেমকাহিনী জড়িয়ে আছে এই ঢিবির সাথে। সম্প্রতি পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই ঢিবির নীচে উৎখনন করে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কার করেছে।
সে যাই হোক, এবার আমরা রাজবংশের কথায় ফিরে যাই। গন্ধর্বের কৌলিক পদবী ছিল পাল, আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বংশ দুটি নতুন উপাধি লাভ করেছিল– ‘শ্রীচন্দন’ এবং ‘মাঢ়-ই-সুলতান’। এই উপাধি দুটি পাওয়া সম্পর্কে বহুল প্রচারিত দুটি লোকশ্রুতি আমরা সংগ্রহ করেছি। পাঠক-পাঠিকাদের সেটি জানানো যেতে পারে।


কিংবদন্তি– ১ / ‘শ্রীচন্দন’ : বাংলা সন ৬৭১ বা ইং ১২৬৪ সাল। চরম চিকিৎসা সঙ্কটে পড়ে, ওডিশার খুরদার রাজার আসন্নপ্রসবা মহিষীর প্রাণসংশয় উপস্থিত হয়েছে তখন। কুলদেবী ব্রহ্মাণী-র স্বপ্নাদেশ পেয়ে ত্বরিতে পুরী নগরীতে উপস্থিত হন গন্ধর্ব পাল। দেবীর দেওয়া স্বপ্নাদ্য ঔষধ প্রয়োগ করে রানীর সুপ্রসবে সাহায্য করেন। রাজমহিষীর নিরাপদ প্রসব এবং নবজাতকের প্রাণরক্ষা হওয়ায়, রাজা বিশেষ সন্তুষ্ট হয়ে, গন্ধর্বকে মেদিনীপুরে একটি জমিদারীতে প্রতিষ্ঠা করেন।


জেলা কালেক্টর এইচ. ভি. বেইলী-র রিপোর্টে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। তা থেকে জানা যায়, গন্ধর্ব পালের রাজ্যাভিষেকের সময় খুরদার রাজা তাঁকে রাজছত্র এবং উপবীত পাঠিয়েছিলেন। সেই সাথে পুরীর মন্দিরের জগন্নাথদেব বিগ্রহের নাভি থেকে ‘ চন্দন ‘ তুলে পাঠিয়েছিলেন গন্ধর্বকে। সেই চন্দন পরিয়ে অভিষেক হয়েছিল গন্ধর্বের। সেদিন থেকে নারায়ণগড় রাজপরিবারের পদবী হয়– শ্রীচন্দন পাল।
কিংবদন্তি- ২ / ‘মাঢ়-ই-সুলতান’ : নারায়ণগড়ের ত্রয়োদশতম রাজা শ্যামবল্লভ শ্রীচন্দন পাল (১৬১৩ – ১৬৭৮)-এর শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৬২২ সাল, ভারত সম্রাট তখন জাহাঙ্গীর। তাঁর ৩য় পুত্র খুররম পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে, ২ বছর বাংলা অধিকার করে রেখেছিলেন। এই বিদ্রোহে পাঠান সামন্তরা এবং কয়েকজন হিন্দু রাজাও তাঁর সহযোগী হয়েছিলেন। ১৬২৪ সালে, সম্রাটের বাহিনী এলাহাবাদের কাছে খুররমকে পরাজিত করলে, তিনি মেদিনীপুরের ভিতর দিয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। মেদিনীপুর থেকে দক্ষিণাত্যগামী পথটি নারায়ণগড়ের উপর দিয়েই প্রসারিত। জানা যায়, শ্যামবল্লভ এক রাত্রির মধ্যে খুররম ও তাঁর বাহিনীর জন্য যাত্রাপথ প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন।


পরবর্তীকালে খুররম ভারত সম্রাট হলে, তাঁর নাম হয়– শাহ জাহান। সসাগরা ভারতের অধীশ্বর হয়েও, অসময়ের বন্ধুকে তিনি ভুলে যাননি। রাজা শ্যামবল্লভকে ‘মাঢ়-ই-সুলতান’ (পথের রাজা) উপাধি প্রদান করেছিলেন তিনি। পার্সী ভাষায় লেখা সেই ‘উপাধি-পত্র’টিতে রক্তচন্দনের উপর নিজের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ এঁকে দিয়েছিলেন সম্রাট। উপাধি পত্রের সাথে একটি ফর্মানও দিয়েছিলেন তিনি। যাতে স্থানীয় রাজকীয় কর্মচারীগণ, জায়গীরদার, চৌধুরী এবং কানুনগোগণকে রাজার অধিকার এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দের প্রতি যত্নবান থাকার নির্দেশ দেওয়া ছিল। সেসময় থেকে এই রাজবংশের পদবি হয়– শ্রীচন্দন পাল মাঢ়-ই-সুলতান।
নারায়ণগড় নামটির উৎস সন্ধান করা যায় একটি বিখ্যাত পুঁথি থেকে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রক্ষিত বিখ্যাত ‘ মাদলাপঞ্জী ‘তে উল্লেখ আছে, গন্ধর্ব পাল নারায়ণপুর নামক স্থানে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে গন্ধর্বের জ্যেষ্ঠ পুত্র নারায়ণচন্দ্র পাল (১২৯৬ – ১৩১৩) রাজা হয়ে, নিজের নামে রাজধানীর নাম করেন– নারায়ণগড়।
বিপুল খ্যাতির অধিকারী নারায়ণচন্দ্র গড়নির্মাণ, কুলদেবী ব্রহ্মাণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা, ৩০০ বিঘা সম্পত্তির উপর জমিদারবাড়ি ইত্যাদি তাঁরই কীর্তি। গভীর গড়খাই দিয়ে ঘেরা রাজধানী। চার দিকে চারটি দরজা– যম দরজা, সিদ্ধেশ্বর দরজা, মেটে দরজা এবং জল দরজা। জল দরজাটি ছিল কেলেঘাই নদীর গায়ে, অভিনব রীতির।
সওয়া ছ’শ বছর বড় কম সময় নয়। নারায়ণচন্দ্রের পর আরও ২৪ জন রাজা রাজত্ব করেছেন এই সময়কালে। বহু কীর্তিকাহিনীতে ভরা এই বংশের ইতিহাস। এখানে সেসব উল্লেখের পরিসর বড় কম। আমরা মন্দির প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জানিয়েই এই পর্ব শেষ করব।


এই বংশে ২২তম রাজা ছিলেন পরীক্ষিত পাল (১৭৬০ – ১৭৬৭)। তাঁর ধর্মপ্রাণা পত্নী রানী অভয়া রাজবংশের আধ্যাত্মিক জীবনে নতুন পথের সূচনা করেছিলেন। চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে প্রভাবিত হয়ে, পরিবারে বৈষ্ণবীয় রীতিতে পূজার্চনার প্রচলন করেন রানী। রানী অভয়াই নব-রত্ন রীতির মন্দির নির্মাণ করে, ব্রজনাগর নামের কৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ঘটনা।
একেবারে রাজকীয় ব্যবস্থাপনা। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বিশাল প্রাঙ্গণ। ফটক দিয়ে ঢুকে, দু’দিকে চার-চালা রীতির দুটি ছোট্ট শিবমন্দির। খানিক এগিয়ে, প্রাঙ্গণের একেবারে মাঝখানটিতে দক্ষিণমুখী ব্রজনাগর মন্দিরটি স্থাপিত। ইটের তৈরী নব-রত্ন রীতির সৌধ। বহুকাল দেবতা নাই মন্দিরে। এখন পরিত্যক্ত সৌধটির সর্ব অঙ্গে মলিনতা মাখানো। তবে, দৃষ্টিপাত মাত্রেই গড়নের ঋজু ভঙ্গিমাটি আকৃষ্ট করে। সমগ্র মন্দিরের সাথেসাথে, প্রতিটি রত্নের ঋজু গড়নটিও চোখে পড়বার মত। এককালে বড় সুদর্শন ছিল দেবালয়টি, বেশ বোঝা যায়।


পাদপীঠের উচ্চতা ফুট দুয়েক। মন্দিরের গড়ন বর্গাকার– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ উভয়ই ২২ ফুট, উচ্চতা আনু. ৪৫ ফুট। প্রথমে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ যুক্ত একটি অলিন্দ। তার পিছনে আয়তাকার এক-দ্বারী প্রশস্ত গর্ভগৃহ। দ্বিতলেও এক-দ্বারী একটি গর্ভগৃহ আছে। অলিন্দের ভিতরের ছাদ বা সিলিং গড়া হয়েছে ‘টানা-খিলান’ করে। গর্ভগৃহের সিলিং প্রথমে দুটি খিলানের উপর গম্বুজ স্থাপন করে নির্মিত।
ত্রিতল মন্দির, দুটি তলেই চালা-রীতির ছাউনি। ছাউনি দুটির চার কোণে উঁচু বেদির উপর রত্নগুলি স্থাপিত। রত্নগুলি নির্মিত হয়েছে কলিঙ্গধারায় । বাঢ় এবং গণ্ডী উভয় অংশ জুড়ে রথ-বিন্যাস এবং গন্ডী অংশে পীঢ়-রীতি প্রয়োগ করা। তাতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে সৌধটির।
মন্দিরের শীর্ষক অংশটিও বেশ সুরচিত। বেঁকির উপর আমলক, কয়েকটি করে কলস, পদ্মকোরক এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত। রাজপরিবারের মন্দির, কলসগুলি ধাতুনির্মিত।
তেমন কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। কেবল সামনের দেওয়ালে প্রথম কার্নিশের নিচে কিছু নমুনা দেখা যায়। অধিকাংশই ফুলকারী নকশার কাজ। কেবল একটি ব্লকের ৮টি খোপে কয়েকটি মূর্তিবিন্যাস করা। সবই যুগলমূর্তি। রাধা-কৃষ্ণ এবং সখীদের মোটিফে নির্মিত টেরাকোটার ফলক। তবে, বারংবার রঙের প্রলেপ পড়ে, সৌন্দর্যের কিছু আর অবশিষ্ট নাই।
তাসত্ত্বেও, পঙ্খের কাজের উৎকৃষ্ট নমুনা সহ, কেবল নির্মাণ সৌকর্যে মন্দিরটি বেশ সুদর্শন। দৃষ্টিপাতেই মন ভরে যায়। কিন্তু পরিত্যক্ত মন্দিরে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধছে একটু একটু করে– এ বড় পরিতাপের কথা।
মন্দিরের সামনেই ছোট আকারের দুটি শিবমন্দির। সেগুলি চার-চালা রীতির। রাজবাড়ির সামনেও একটি পরিত্যক্ত শিবমন্দির আছে, সেটি আট-চালা রীতিতে নির্মিত।
দাক্ষিণাত্য এলাকার মন্দির স্থাপত্যশৈলীর একটি নমুনা দেখা যায় এই রাজবাড়ির দেউড়ির মাথায়। বেশ বিস্ময়কর নিদর্শন এটি।


সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অরুণ কুমার পাল– অলিগঞ্জ, মেদিনীপুর শহর। মোহিনী কিঙ্কর পাল– হাঁদলাগড় রাজবাড়ি, নারায়ণগড়। ঝর্ণা আচার্য্য– বিনন্দপুর, কেশিয়াড়ি থানা।
যাওয়া-আসা : যে কোনও দিক থেকে মেদিনীপুর বা খড়্গপুর এসে, দক্ষিণমুখী বালেশ্বর গামী পথে নারায়ণগড়। সেখানে থানার পাশ দিয়ে পূর্বমুখে ২ কিমি মোটরেবল রাস্তায় হাঁদলাগড় রাজবাড়ি।

RELATED ARTICLES

Most Popular