Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল - ৬৯

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৬৯

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৬৯
অনন্ত পুরুষোত্তম মন্দির, মনোহরপুরগড় (দাঁতন থানা, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ

ছিলেন মোগল বাহিনীর সামান্য এক সিপাহশালার। তা থেকে বিশাল এক জমিদার হয়ে উঠেছিলেন। ইতিহাস আর কিংবদন্তির সূতোয় ঠাস বুনোটে গড়া লছমীকান্ত উত্তর রাও বীরবর-এর এই উত্তরণের কাহিনী। প্রথমে ইতিহাসের কয়েকটি পাতা উল্টে নেওয়া যাক।
যেমন সুশাসক ছিলেন সম্রাট আকবর, তাঁর সাম্রাজ্যটিও ছিল বিশাল আয়তনের। সেকারণেই অনেকগুলি যুদ্ধও করতে হয়েছিল তাঁকে। সময় যখন ১৫৬৮ সাল, সম্রাট তখন রাজপুতানার যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। পাঠান ওমরাহ সুলেইমান কররানী সেই সুযোগে বাংলা আর বিহারের শাসনকর্তা হয়ে উঠলেন। কলিঙ্গের অধিপতি তখন মুকুন্দদেব। তাঁকে পরাজিত করে, বাংলা-বিহার-ওডিশার মালিক হয়ে বসলেন। সংঘাতে গেলেন না, আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে, স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে লাগলেন চতুর কররানী। কিন্তু কররানীর মৃত্যুর, তাঁর পুত্র দায়ুদ খাঁ সেনাপতি দুর্ধর্ষ কালাপাহাড়কে নিয়ে বিদ্রোহ করে বসেছিলেন সম্রাটের বিরুদ্ধে।


রাজা টোডরমলকে বিদ্রোহ দমনের ভার দিয়ে বাংলায় পাঠালেন সম্রাট। সাথে সেনাপতি মুনিম খাঁ, আর বিশাল মোগল সেনাবাহিনী। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ৩টি বড় যুদ্ধ হয়েছিল মেদিনীপুর জেলার আজকের দাঁতন থানাতেই– প্রথমটি সেকালের টাকারুই বা আজকের তুর্কা-য়। দ্বিতীয়টি সেকালের অমরাবতী বা আজকের মোগলমারী-তে (মোগল বাহিনী জয়লাভ করলেও, যুদ্ধে অগণিত মোগল সৈন্য মারা পড়েছিল পাঠানদের হাতে। সেকারণে মোগলমারী নাম হয় এলাকাটির।)। শেষ যুদ্ধ হয় হরিপুর এলাকায়। পরাজিত হয়ে কটকে পালিয়ে যান দায়ুদ। ইতিহাসে ১৫৭৫ সালের এই যুদ্ধগুলি ‘তুকারই-এর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।


মূল বিষয়ের সূত্রপাত যুদ্ধশেষের পর। বাহিনী যখন দিল্লী ফিরে যাচ্ছে, কিছু হিন্দু সৈনিক জগন্নাথ দর্শনে পুরী যেতে চাইলেন। টোডরমল সম্মতি জানালেন আবেদনে। লছমীকান্ত উত্তর রাও নামের এক সিপাহশালারকে দায়িত্ব দেওয়া হল তীর্থযাত্রী বাহিনীর। পুরী থেকে ফিরতি পথে আবার দাঁতন এলাকায় পৌঁছল বাহিনী। এলাকাটি সুবর্ণরেখা নদীর পূর্বতীর। পশ্চিম তীরে তখন ভাটরাজ নামে এক মারাঠা দস্যুপতির একচ্ছত্র অধিকার। বিশাল রায়বনিয়া গড় অধিকার করে, নদীর পূর্ব পশ্চিম দুই এলাকায় অবাধ লুঠতরাজ চালাত ভাটরাজ। তার অত্যাচারে জনজীবন বিপর্যস্ত। ছোট্ট বাহিনী নিয়েই ভাটরাজকে দমন করলেন লছমীকান্ত।


পাঠানের দুঃশাসন আর দস্যুর লুঠতরাজ– দুইয়ের নিস্পত্তি করেছেন। স্থানীয় ভূস্বামীরাই থেকে যাওয়ার দাবী জানলেন লছমীকান্তকে। রাজস্থানের উষর মরু এলাকার মানুষ তিনি। এখানে নদীবিধৌত দাঁতনে আবহাওয়া মনোরম। উর্বর মাটি কৃষিজ সম্পদে ভরপুর। বসতি গড়বার উপযুক্ত স্থান। আপত্তি করলেন না, দিল্লি গিয়ে সম্রাটের অনুমতি নিলেন লছমীকান্ত। টোডরমলের পরামর্শে ‘বীরবর’ উপাধি আর কয়েকশ’ মৌজার জমিদারি সনন্দও পেলেন তিনি। চহ্বাণবংশের সন্তান লছমীকান্ত রাজপুতানার রেওয়া বুন্দেলখণ্ড থেকে পরিবার নিয়ে বাংলায় চলে এলেন বাঙালি হতে। তখন ইং ১৫৮০ সাল।


এই পর্যন্ত একজন রাজপুত রাজপুরুষের বাঙালি হয়ে ওঠার কাহিনী। এর পর কেটে গিয়েছে সাত পুরুষ সময়কাল। রাও থেকে পদবী হয়েছে– রায়। সপ্তম পুরুষে রুদ্রনারায়ণ নর্মদেশ্বর আর ঝিলিঙ্গেশ্বর শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা আর ধুমধামের সাথে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছেন রাজবাড়িতে। রুদ্রনারায়ণের পুত্র হরেকৃষ্ণ একবার মহাল পরিদর্শনে বেরিয়ে, একটি ব্যাঙকে বিষধর সাপ গিলে খেতে দেখেছিলেন। কেবলমাত্র দৈবানুকৃপায় এমন অলৌকিক ঘটনা সম্ভব– এই বিবেচনায় সেখানেই রাজধানি তুলে এনেছিলেন হরেকৃষ্ণ।


গড়খাই কেটে বিশাল বাস্তুর ভিতর অট্টালিকা গড়লেন। করিন্থিয়াম থামের গ্রিক স্থাপত্যের দ্বিতল প্রাসাদ। অন্দর মহলে গোপন পাতালপুরী। সরোবর নামের দীঘি। জলের মাঝখানে বিলাসভ্রমণের জন্য বাগান সহ দরখুলী নামের দীঘি– কতকিছুই। মনোহর করে গড়া হয়েছে, তাই নতুন জনপদের নাম হয়ে গেল– মনোহরপুর গড়।
এর পর দীর্ঘ ইতিহাস এই পরিবারের। সাহিত্য, উচ্চাঙ্গ সংগীত আর নাটকের চর্চা। পুরীরাজের কাছ থেকে ‘রাজা’ খেতাব আর ‘রাজছত্র’ উপহার পাওয়া। সিপাহী বিদ্রোহে সরকারকে সহযোগিতা করে কামান উপহার পাওয়া।

প্রজাদের জন্য জলাশয় খনন, জগন্নাথ সড়কের সংস্কার। গয়া, কাশী, বৈদ্যনাথ, বৃন্দাবন, ভূবনেশ্বর, কামাক্ষা, পুরী প্রভৃতি তীর্থস্থানে আহারসহ যাত্রীনিবাস নির্মাণ– বহু কীর্তি এই রাজবংশের। সেসব অন্য কাহিনী।
নতুন রাজধানী মনোহরপুরে বিষ্ণুমন্দিরটি হরেকৃষ্ণই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২টি শালগ্রাম পূজিত হোত মন্দিরে। বিগ্রহ দুটি চুরির পর থেকে, মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।
গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম, মোহনপুর এবং দাঁতন– মেদিনীপুর জেলার এই ৪টি থানা ওডিশা রাজ্যের একেবারে গা-লাগোয়া। সে রাজ্যের মন্দির-স্থাপত্যের শিখর-দেউল রীতির গভীর প্রভাব আছে এই চার থানায়। এই এলাকার বিখ্যাত মন্দিরগুলির সিংহভাগই শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত হয়েছে।


রায় বীরবর পরিবারের অনন্ত পুরুষোত্তম-এর এই মন্দিরটিও শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। এখানে মন্দিরের ৩টি অংশ– সামনে ১০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১৫ ফুট প্রস্থের পীঢ়-রীতির জগমোহন, পিছনে ১৪ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১৫ ফুট প্রস্থ আর ৩৫ ফুট উচ্চতার বিমান বা মূল মন্দির। এবং এ দুইয়ের মাঝখানে, সংযোজক হিসাবে, সংক্ষিপ্ত আয়তনের একটি অন্তরাল। সেটির দৈর্ঘ্য ২ ফুট আর প্রস্থ ৮ ফুট। পরিত্যক্ত এই মন্দিরের পাদপীঠ এখনও ফুট তিনেক উঁচু। পরিমাপ– ২৮ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১৫ ফুট প্রস্থ। তবে কোনও প্রদক্ষিণ-পথ নাই। পা-ভাগটি কয়েকটি স্তরে বিন্যাস করা।


ইট-চুন-সুরকির এই মন্দির পূর্বমুখী করে নির্মিত। জগমোহন সৌধটি চতুর্দ্বারী। পিছনের দ্বারটি অন্তরাল-এর সাথে যুক্ত। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বার। পাঁচটি দ্বারই খিলান-রীতির। মন্দির কারিগরীর মুন্সিয়ানা তার ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মাণে। এই মন্দিরের সিলিং হয়েছে চার দিক এবং চার কোণে আটটি খিলান রচনা করে, সেগুলির মাথায় গোলাকার খাঁজ কাটা গম্বুজ বা লহরা স্থাপন করে। জগমোহন এবং বিমান– দুটিতেই একই রীতির সিলিং।


রথ বিভাজন আর পীঢ়-বিন্যাস কলিঙ্গ স্থাপত্যধারার অন্যতম বৈশিষ্ট। এই মন্দিরের জগমোহন এবং বিমান উভয় সৌধেই এ দুটির প্রয়োগ হয়েছে। দুটিতেই পঞ্চ-রথ বিন্যাস করা। মাঝখানে একটি রাহাপাগ, তার দু’পশে দুটি অনর্থপগ এবং দুই প্রান্তে দুটি কনকপগ। বিমানসৌধের বন্ধন এবং বরণ্ড– দুটিই প্রকট করে নির্মিত, তাতে সৌন্দর্য বৃদ্ধিই হয়েছে মন্দিরের। পীঢ়-রীতির প্রয়োগ হয়েছে জগমোহন সৌধের গন্ডী অংশে। সেখানে প্রশস্ত আকারের ৫টি থাক কাটা।

পরিত্যক্ত এই মন্দিরের শীর্ষক অংশ ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত। জগমোহন বা বিমান কোনোটিতেই বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, বিষ্ণুচক্র– কিছুরই কোনও চিহ্ন নাই। মন্দিরের কোনও অলঙ্করণ করা হয়েছিল, এমন কোনও নিদর্শন নাই।
সাক্ষাৎকার : শ্রী ক্ষোণীশ রায় বীরবর– মনোহরপুরগড়, দাঁতন।
কৃতজ্ঞতা : শ্রী সূর্য নন্দী, কবি ও সম্পাদক। বিশ্বজিৎ ঘোষ, প্রাবন্ধিক– দাঁতন।
যাওয়া – আসা : মেদিনীপুর কিংবা খড়্গপুর থেকে বালেশ্বর গামী পথে ৬০ নং জাতীয় সড়কের উপর মনোহরপুর স্টপেজ। ট্রেন যোগে বেলদা কিংবা নেকুড়সিনি স্টেশন নেমে, বাসরাস্তায় মনোহরপুর স্টপেজ। এবার পূর্বমুখে দেড় কিমি পথ পেরিয়ে, মনোহরপুরগড় এবং পথের গায়েই জীর্ণ মন্দির।
তবে, পর্যটক মাত্রেরই এই সফরে মোগলমারী বৌদ্ধ বিহারটি দেখে নেওয়াই সঙ্গত। মনোহরপুর ও নেকুড়সিনির মাঝে, রাজপথের পাশেই মোগলমারী।

RELATED ARTICLES

Most Popular