Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল - ৭০

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৭০

শিব মন্দির, পড়িহাটি (জামবনি থানা, ঝাড়গ্রাম)
চিন্ময় দাশ

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে একেবারে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ। দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর বর্তমান মেদিনীপুরের সিংভাগ ভূখন্ড কলিঙ্গ নৃপতিদের অধিকারে ছিল। অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গদেবের হাতে এই অধিকারের সূচনা। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, অনঙ্গ ভীমদেব প্রায় সমগ্র জেলা তাঁর অধিকারে এনেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে সুলেমান কররানীর হাতে ওডিশারাজ হরিচন্দন মুকুন্দদেব নিহত হলে, এই শাসনপর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল।


মেদিনীপুরের সীমানার পশ্চিম এবং উত্তর অঞ্চল পাহাড় আর বনভূমি অধ্যুষিত। ধলভূম, সিংভূম, মানভূম, বরাহভূম, মল্লভূম ইত্যাদি এলাকা। প্রকৃতপক্ষে ছোট নাগপুর মালভূমি এলাকার প্রলম্বিত প্রান্তদেশ এগুলি। তামা, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি মূল্যবান খনিজ সম্পদের সঞ্চয় আছে এই অঞ্চলে। এই এলাকা থেকে তাম্রলিপ্ত বন্দর পর্যন্ত একটি প্রাচীন পথ ধরে তামা পরিবহন করা হত অতীতকালে।


ওডিশা শাসনাধিকারের সময়কালে, সেই রাজ্য থেকে বেশ কিছু উচ্চবিত্ত পরিবার মেদিনীপুরের এই পশ্চিমাঞ্চলে চলে এসেছিলেন। এসেছিলেন বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারও। পণ্ডা পদবীর তেমনই একটি পরিবার এসে বাস করেছিলেন পড়িহাটি গ্রামে। মেদিনীপুরের সীমান্তবর্তী জামবনি থানার অন্তর্ভুক্ত যেটি। যেখানে দু’-চার পা হাঁটলেই বিহারের (বর্তমান ঝাড়খন্ড) সীমানা ছোঁয়া যায়।


এই বংশের জনৈক লালবিহারী পণ্ডা ছিলেন ধলভূমগড় (ঘাটশিলার আগের স্টেশন) রাজবাড়ীর দেওয়ান। তিনি নিজেও একটি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে, জানা যায়। সেসময়ই তিনি মহাদেব শিবের এই মন্দিরটি নির্মাণ করান। কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নাই মন্দিরে। তবে সেবাইত বংশের ৮ পুরুষের বংশলতিকার হিসাব থেকে আমরা জেনেছি, দু’শ বছরের কিছু পূর্বে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল।


লালবিহারীর বংশধারা না থাকায়, তাঁর জামাতা, ওডিশার অধিবাসী জনৈক কুশীলব পানি, এসে মন্দিরের ভার গ্রহণ করেছিলেন। তখন থেকে পানি পরিবারই দৌহিত্রসূত্রে পাওয়া দেবতা এবং মন্দিরের অধিকারী। ষড়ঙ্গী পদবীর একটি ব্রাহ্মণ বংশ এখনও মন্দিরে পৌরহিত্য করেন।
মন্দিরের বিগ্রহটি একটু ভিন্ন ধরণের। বেলেপাথরের গৌরীপট্টের উপর স্থানীয় কালো পাথরের শিবলিঙ্গটি স্থাপিত। জমিদারী উচ্ছেদের পর থেকে মন্দিরের দুঃসময়ের শুরু। সেবাপূজাটুকু কোন রকমে ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু মন্দিরসৌধটিকে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।


দক্ষিণ ভারতের ধারায়, পাথরের উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি অঙ্গণের ভিতর মন্দিরটি স্থাপিত। পরিসরটি ছোট, কিন্তু হুবহু ‘দূর্গ-মন্দির’-এর মত পরিকল্পনা। মহাজাগতিক দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে, মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে পূর্বমুখী করে। মন্দির পূর্বমুখী হলে, দিনের উদিত সূর্য তার প্রথম আলোকরশ্মিটি দেবতার চরণে নিবেদন করে দিনের যাত্রা শুরু করতে পারে।
মন্দির গড়া হয়েছে চুন, সুরকি আর মাকড়া পাথর বা ল্যাটেরাইটের উপাদানে। ভয়ানক রকম জীর্ণ এই মন্দিরের পরিমাপ এরকম– দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৮ ফুট, প্রস্থ সাড়ে ১৩ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মন্দির প্রাঙ্গণের পূর্বদিকের ফটকটি সামাজিক কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমে নতুন ফটক তৈরী করে যাতায়াত করতে হয়।

মন্দিরটি একটু বিশিষ্ট রীতিতে নির্মিত। সামনে একটি দালান-রীতির কাঠামো। মাথায় সমতল ছাউনি। তাকে অলিন্দ কিংবা জগমোহন– যেকোনও নামে অভিহিত করা যায়। পিছনের মূল সৌধটি বাংলা চালা-শৈলীর ‘আট-চালা’ হিসাবে নির্মিত।
সামনে তিনটি দ্বারপথ। খিলান-রীতিতে রচিত। গর্ভগৃহে খিলান-রীতিরই একটি দ্বারপথ। গর্ভগৃহের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি কুলুঙ্গি। পশ্চিমের দেওয়ালে একটি বড় আকারের গবাক্ষ, জাফরি কাটা পাথরের খন্ড দিয়ে আবৃত।
সামনের অলিন্দ অংশের ভিতরের ছাদ বা সিলিং হয়েছে দুটি অর্ধ-খিলানের সাহায্যে, টানা-খিলান করে নয়। গর্ভগৃহের সিলিংয়েও সেই অর্ধ-খিলানের ব্যবহার। সিলিং নির্মিত হয়েছে চার দেওয়ালের মাথায় চারটি অর্ধ-খিলান রচনা করে। ভারী জীর্ণ দশা মন্দিরটির। মহীরুহের তূল্য বিশাল বিশাল বৃক্ষ দখল করে নিয়েছে তাকে। হৃষ্টপুষ্ট শিকড়ের বাহুবন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে মন্দিরটি।

মন্দিরের পাদপীঠ অংশটি এখনও বেশ উঁচু। একটি প্রদক্ষিণ-পথ আছে যদিও তার উপর, তবে অতি সংকীর্ণ। মূল মন্দিরের সামনের অংশটি ভারী জীর্ণ। তবে পশ্চিমের অংশটি কিছু অবশিষ্ট আছে। তাতে দেখা যায়, প্রথম তলটির গড়ন বেশ ঋজু। দ্বিতীয় তলও সংক্ষিপ্ত নয়। দুটি তলেই গড়ানো চালা-ছাউনি। কার্নিশের বঙ্কিম ভাবটি মনোরম। শীর্ষক অংশের অবয়বটি এখনও স্পষ্ট। বেঁকি, আমলক, দণ্ড কোনও রকমে টিকে আছে সেখানে।
এককালে মাকড়া পাথরের এই মন্দিরের সর্বাঙ্গ জুড়ে পঙ্খের মিহি প্রলেপ ছিল। তাতে একটি চিকন সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিল মন্দিরের সর্বাঙ্গ জুড়ে। অন্য তেমন কোনও অলংকরণ ছিল না। তবে, গর্ভগৃহের ভিতরে, উত্তর আর দক্ষিণের দেওয়ালে, দুটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি দেখা যায়। ‘ বা-রিলিফ ‘ রীতিতে খোদাই কাজ।
জীর্ণ মন্দিরটির জগমোহন অংশের সামনের দেওয়ালের বাম দিকের কিছুটা অংশের পলেস্তারা এখনও টিকে আছে। সেখানে বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের একটি মূর্তি দেখা যায়। জগমোহনে প্রবেশের কেন্দ্রীয় দ্বারপথটির মাথার উপরে একটি চতুস্কোণ শূন্য খোপ দেখা যায়। পূর্বে হয়তো সেখানে কোনও মূর্তিবিন্যাস করা হয়েছিল। পরে সেটি বিনষ্ট বা অপহৃত হয়েছে, এমন অনুমান করা যেতে পারে।

অতি জীর্ণ মুমূর্ষু এই সৌধটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে বড় একটা দেরি নাই।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী তপন পানি, পড়িহাটি। ডা. অরুণ কুমার পানি, নুনিয়া। ডা. রঞ্জিত কুমার পানি, ঝাড়গ্রাম শহর। তাপস ষড়ঙ্গী (পুরোহিত), পড়িহাটি।
সহযোগিতা : শ্রী চম্পক চক্রবর্তী, বন বিভাগের কর্মী– ঝাড়গ্রাম শহর।
পথনির্দেশ : যে কোনও দিক থেকে বাস কিংবা ট্রেনযোগে ঝাড়গ্রাম শহর। সেখান থেকে গিধনি হয়ে ২০ কিমি, কিংবা দহিজুড়ি হয়ে ২২ কিমি দূরের পড়িহাটি যাওয়ার বাস, ট্রেকার ইত্যাদি সব রকম যান চলাচল আছে। রেলপথ হলে, ঝাড়গ্রামের টাটামুখী পরের স্টেশন গিধনি থেকেও গাড়ি আছে। দূরত্ব ৪ কিমি।

RELATED ARTICLES

Most Popular